# বিভাগ-গল্প। # শিরোনাম-ভাইফোঁটা। # কলমে- ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
# বিভাগ-গল্প।
# শিরোনাম-ভাইফোঁটা।
# কলমে- ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
সসংকোচ পদক্ষেপে সিংহ দুয়ার পেড়িয়ে অবশেষে বড়ালচৌধুরী বাড়িতে ঢুকেই পড়ে শ্যামা। এই অভিজাত পরিবারের ছোট মেয়ে সে।তার ওপরে একজন জাঁদরেল দাদা আছেন। এক জন বিবাহিতা দিদি আছেন দূর প্রবাসী। আছে ছোট দুটি ভাই।শিশু কন্যাকে সযত্নে বুকে জড়িয়ে হাতে গুরুপদ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের প্যাকেটটা নিয়ে আর দাদার জন্যে একটা ধুতি ও ছোট ভাইদের জন্যে গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট নিয়ে দ্বিধাকম্পিত গলায় ডাকে-” মা ও মা”- দাদা ও বৌদি বেরিয়ে আসেন। স্পষ্টতই বিরক্ত,অপ্রসন্ন মুখ। মা বেরিয়ে আসেন। ছোট মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্টে কান্না চাপেন মা। -“কেমন আছিস “- জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে যান। কেমন যে আছে মেয়ে তা তার শীর্ণ শরীর আর দীর্ণ চাহনিই বলে দিচ্ছে। হাত বাড়িয়ে পুতুলের মতো নাতনিকে কোলে নেন সুরমা। প্রথম মুখ দেখলেন তিনি দেড় বছরের নাতনিটার।
ঘরে তখন হৈ হৈ করে ভাই ফোঁটার অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। বড় মেয়ে প্রবাসী বড় অফিসারের বৌ। তার আনা ভাইফোঁটার উপহার দাদার জন্যে বিলেতি স্যুটের কাপড়, ছোটভাইদের জন্যেও দামী জামাপ্যান্ট নিয়ে সবাই মেতে আছে। -” নজর বটে তোমার বড়ো বোনের”- বৌদি বলে দাদাকে। শ্যামা বলে -” বৌদি, কতদিন হয়ে গেলো ভাইফোঁটা দেয়া হয় নি।আজ আর থাকতে পারলাম না। এই জিনিস গুলো রেখে দাও দাদার ধুতি,ভাইদের জামাপ্যান্ট।”- দিদি বলে ওঠে -” বাব্বা,শ্যামার আবার হলোটা কী? তোর বরের প্রমোশন হয়েছে বুঝি?”- প্রহার করতে কী সব সময় চাবুক বেল্টের দরকার হয়! কষ্টে কান্না চাপে শ্যামা। -“কেন রে দিদি? আমার বুঝি ইচ্ছে করেনা? যেমন সাধ্য তেমন ভাবেই সাধ পূরণ করতে পারি না?”- রমা বৌদির দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ হাসি হাসে। -“হুম রে, কুঁজোরও সাধ হয় চিৎ হয়ে শুতে, আর গামছারও সাধ হয় ধোপার কাচানি খেতে। তবে এটা তো তোর বোঝা উচিৎ ,যে জিনিস গুলো এনেছিস আদিখ্যেতা দেখিয়ে, সেগুলো এ বাড়িতে কেউ ব্যবহারই করবে না? তুইও তো এই বাড়িরই মেয়ে! ভুলিস কী করে? বাপের বাড়ির অমর্যাদা করতে বাধে না তোর?”-এবার মা পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। কেন খরচ করতে গেলি শ্যামা? জামাইএর রোজগার তো সত্যিই তেমন নয়। মেয়েটার দুধের খরচটাও লাগে। বাজে খরচা করিস কেন? “- ধ্বক্ করে ওঠে শ্যামার বুকটা। মাও এমন কথা বললো? অতনুকে সে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল ঠিকই, কিন্তু বাড়ির অমতে তো নয়! রীতিমতো দুই বাড়ির মধ্যে অভিভাবকদের মধ্যস্থতায় বিয়ে হয়েছিলো অতনু আর শ্যামার। অতনু একটা বেসরকারি সংস্থার কারখানার কর্মী। অভিজাত বংশ কেন এই বিয়ে মেনে নিয়েছিল! কারণ বরপক্ষের কোন দাবীদাওয়া ছিলনা। শ্যামাও তেমন কিছু আহামরি সুন্দরী নয়।কাজেই বিনা পণে মেয়েকে পাত্রস্থ করার সুযোগটা তাঁরা ছাড়েননি। -“ঘাড় থেকে নামানো”-শব্দটা খুবই খেলো; রুচি বিরুদ্ধ।
গলায় কাঁটা বেঁধার মতো করে দাদা কর্কশ কন্ঠে বলেন -” ভেতরে আয়। অতনু আসেনি তো?”- যেন অতনুর উপস্থিতিতে তাদের পারিবারিক মর্যাদা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। ও যে জামাই বলে পরিচয় দেয়ার যোগ্য নয়। না,অতনু আসেনি। আসবেও না।
থালায় পাঁচ রকম মিষ্টি সাজিয়ে প্রদীপ জ্বেলে দাদার বিরক্তিতে কুঁচকে থাকা কপালে দৈ-চন্দনের ফোঁটা দেয় শ্যামা। যত্নে কেনা ধুতিখানা হাতে তুলে দেয়ার আগেই বাঁ হাতে সেটা নেয় দাদা। নির্মম হাতে মুছে ফেলে কপালে বোনের দেয়া ফোঁটার দাগ। শ্যামার গাল বেয়ে গড়িয়ে নামা অশ্রুধারা শ্যামাও নিষ্ঠুর হাতে মুছে ফেলে অলক্ষ্যে। দাদা বৌদিকে ডেকে বলে -” দারোয়ান লালজীকে ধুতিটা দিয়ে দাও।”- শ্যামার মিষ্টির থালাটা সরিয়ে দিয়ে বড়ো বোন রমার আনা নকুড় ও ভীমনাগের মিষ্টির থালা তুলে নেয়।সুরমা ততক্ষণে শ্যামার আনা মিষ্টিগুলো নাতনিকে খাওয়াতে শুরু করেছেন। দিদার কোলে বসে পরম সন্তোষে সস্তা দামের সন্দেশ চুষছে বাচ্চা মেয়েটা। এরপর দাদা একটা পাঁচশো টাকার নোট হাতে দিয়ে বলে -” একজোড়া ভালো চপ্পল কিনে নিস। তোর বৌদি দেখালো, একটা ক্ষয়ে যাওয়া চপ্পল পড়ে এসেছিস।অন্তত এ বাড়িতে আসার দরকার পড়লে ঐ চপ্পল আর বৌদির দেয়া শাড়িটা পড়ে আসবি।”- বৌদি তার একটা বাতিল করা প্রায় নতুন শাড়ি এনে শ্যামার হাতে দেয়।
মা ততক্ষণে নাতনিকে ডালভাত মেখে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। শ্যামা কোনমতে ছোট দুই ভাইকে ফোঁটা দিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসে ও বাড়ি থেকে। পাঁচশোর নোটটা বড়ো দরকার ছিলো। তবু নিতে পারলো না শ্যামা। পড়ে রইলো নোট আর প্রায় নতুন সিল্কের শাড়ি। শুধু মায়ের তার নাতনির হাতে গুঁজে দেওয়া দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট আর লুকিয়ে রাখা ছোট্ট দুটো সোনার কানের রিঙকে অস্বীকার করতে পারলো না। দেয়ালে টাঙানো বাবার ছবিতে শেষ বারের মতো প্রণাম করে বেরিয়ে এলো জন্মের মতো।
শ্যামার সেই শেষ বাপের বাড়ি আসা। শ্যামা অনেক চেষ্টায় মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করেছে। নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছে। সংসারকে মোটামুটি স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছে। আর আশ্চর্য ভাবে তার অবস্থার ক্রমোন্নতির খবর পেয়ে ভাইপো,ভাইঝিদের বিয়ে থাওয়ায় তার ও অতনুর নামে নিমন্ত্রণপত্রও সে পেয়েছে বাপের বাড়ি থেকে। লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে কারো জন্য সোনার ঝুমকো, কারো জন্য কানপাশা। কিন্তু উপস্থিত হয়নি কোনও শুভ কাজে। মায়ের মৃত্যু শয্যায়ও দেখা করে এসেছিল নার্সিং হোমে।
শুধু ভাইফোঁটার দিন কী এক দুর্বল মোহ মায়ায় আবিষ্ট হয়ে দেয়ালে ফোঁটা দিয়ে যায় প্রতি বছর।খবর পায় বৌদি নেই,দাদা নেই, দিদি নেই,ভাইরা নেই,তবু ঐ যে অপমানের গোপন রক্তক্ষরণ, অদ্ভূত এক নিস্পৃহতায় তাকে উদ্বুদ্ধ করে ভাইদের মঙ্গল কামনায়। আজও বৃদ্ধা শ্যামা প্রতি বছর নির্ভুলভাবে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় দেয়ালে যম দুয়ারে কাঁটা এঁকেই চলে। -” ভায়ের কপালে দিলাম ফোঁটা; ভায়ের কপালে দিলাম ফোঁটা;!
এ আসলে তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণের ফোঁটা। সব ভাইফোঁটাই যে বড় সুখের। বোনেদের কাছে।