।।গল্প।। “নিমফুল” কলমে: সাহানা
।।গল্প।।
“নিমফুল”
কলমে: সাহানা
-মা, রেডি হয়েছো? নীচে এসো তাড়াতাড়ি…
একতলা থেকে ঘুরে ডাকটা পৌঁছয় তিনতলার বেডরুমে।
সরোজিনী বেরিয়ে আসেন। লম্বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীচে তাকান…
মাকে দেখে বরুণ হাত ঘুরিয়ে ইশারা করে তারপর বাইরের দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।
দীর্ঘশ্বাস পড়ে সরোজিনীর। বরুণ, রায় অ্যান্ড কোম্পানির সুবিশাল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। তার সততায় ব্যবসা এখন চতুর্গুণ। কোম্পানির বেশ কিছু শেয়ার বিক্রি করে সম্পূর্ণ নতুন সেক্টরে পা রেখেছে এই বছর তিরিশের তরুণ। সংসার এবং মা’কে নিয়ে এই বসত বাড়ি বিক্রি করে অন্য শহরে যাবে, তারই প্রস্তুতি আজ।
বরুণ, বরুণ!
আজকের এই সফল, মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিটি এই বংশের যথাযোগ্য উত্তরাধিকারী। ঠিক ওর বাবার মতো। বংশমর্যাদার ধারক-বাহক!
অথচ, এই সন্তানকে তিনি জন্ম দেননি!!
ভাবলেই বড্ড অবাক লাগে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অনেক পুরনো কথা ঝপাঝপ মনে ভাসতে থাকে। যেন সিনেমার এক একটি সিন!
প্রথম দিন এ বাড়িতে আসা, রাঙা চেলি,গয়না….বরণডালা নিয়ে শাশুড়ি এবং একঘর প্রতিবেশী…
নিয়মকানুন মিটলে, শাশুড়ির কড়া নিয়মকানুন, শ্বশুরমশাইয়ের নানারকম বিধিনিষেধ। সব মনে পড়ে একে একে।
প্রথম দিনটিতেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়, এই বাড়ির ঐতিহ্য। প্রচুর, প্রচুর দায়িত্ব, এক চুল এদিক ওদিক নয়।
বিয়ের পরে যে সময়টা নবদম্পতির সবথেকে বেশি একান্তে কাটানো উচিত, নিজস্বতায়, তাও চলবে কোনো অদৃশ্য চালিকাশক্তিতে।
সবকিছুর মাঝে একটি মানুষ, তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন…সব ঝড় ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা করার যে দায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন, তার থেকেও অনেক বেশি পালন করেছেন, সারা জীবন!
সরিৎশেখর রায়!
ভাবতেই সরোজিনী মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েন। ব্যতিক্রমী চরিত্রের একটি মানুষ! অথচ তাঁর যে একটি মারাত্মক অক্ষমতা, সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল। বিয়ের পর বিশেষ রাতে তিনি নিজেই সেকথা স্বীকার করেছিলেন। চোখদুটি ভরেছিল জলে! সরোজিনী সব শুনে নির্বাক। শুধু হাতদুটি চেপে ধরেছিলেন। এক অজানা ভালোবাসার চুক্তি হয়েছিল দুজনের।
উত্তরাধিকারীর জন্য উন্মাদ শাশুড়ি অনেক চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি প্রাচীনকালের নিয়োগ প্রথাও।
সে রাতের কথা ভেবেই শিউরে ওঠেন!
সব বিপদে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন সরিৎশেখর। ব্যবসাবুদ্ধি চিরকাল প্রখর। তারই বলে বাড়ি-গাড়ি এবং শ্রীবৃদ্ধি । রায়বাড়ির গোঁড়া নিয়মকানুন, একতরফা অত্যাচার এবং দজ্জাল শাসন…অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়েছিল, তাঁর অর্থ এবং প্রতিপত্তিতে।
এক বসন্তের বিকেলে সরোজিনীকে নিয়ে গেলেন ‘চোখের আলোয়’ – দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দত্তকপুত্র নেবেন।
সেই শুরু এক নবজীবনের।
উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছনোর লক্ষ্যে যখন কয়েকটা ধাপ মাত্র বাকি, সরিৎশেখর ছুটি নিলেন! সরোজিনীর মনে হলো, এই শেষ!
তারপর বরুণ….টগবগে ঘোড়ার মত ছুটে চলে….
একতলার সিঁড়ির ঠিক পাশে একটা টেবল। তার ওপরে সরিৎশেখরের ছবিটা, একটা আঁচিল ডান ভুরুর নীচে, জন্মদাগ…ছবিটা যেন হাসছে…
ছবিটা টেবল থেকে তুলে নিজের আঁচল দিয়ে অকারণেই মুছলেন..পায়ে পায়ে চললেন সদরের দিকে। সব আসবাব নিলাম হবে, এই ছবি ছাড়া। ছবিটা শুধু তিনিই নেবেন, কাউকে স্পর্শ করতে দেননি তাই।
তিক্ত নিমগাছের সুমিষ্ট নিমফুলের মত এক প্রাণ, গোঁড়া এবং জেদী বংশের সুচারু সন্তান…তাঁর হৃদয়ের সম্পদ!!