**খুবসুরতী** কাবেরী বোস ঘোরাই নীলবৃষ্টি
**খুবসুরতী**
কাবেরী বোস ঘোরাই
নীলবৃষ্টি
বাইরে মুসুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে , রাধারানী তাঁবুর ভেতর থেকে বৃষ্টি দেখছে, তার ডাক পড়বে আরো দু ঘন্টা পর, রাধারানী তাঁবুর ধার থেকে সরে এসে ভেতরে গিয়ে চেয়ারে বসে , ওদিক থেকে না না হৈ হট্টগোল এর আওয়াজ আসছে!! লোকের হাততালি সিটি মারা নানা রকম, রাধারানী চুপ করে চোখ বুজিয়ে বসে থাকে , বাইরে বৃষ্টির হাওয়া তাকে ছুয়েঁ যাচ্ছে! কত কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে! মনে রোজই পড়ে তবে এরমভাবে মাঝে মাঝে ই মনে পড়ে, সে রাধারানী নয় সে তবাসুম তার বাবা আনোয়ার হুসেন এর একমাত্র মেয়ে! সারা গ্রামে সবচেয়ে সুন্দরী বোধহয় তবাসুমই ছিলো সবাই তার রূপের প্রশংসা করতো, আব্বু গরীব হলেও তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে ছিলো তবাসুমের খুব ইচ্ছে ছিলো বড় ডাক্তার হওয়ার কিন্তু সে স্বপ্ন অধুরাই রয়ে গেলো ,আব্বুজান মারা গেলো কি যেনো এক অজানা জ্বরে মাত্র কুড়ি দিনের মধ্যে, তবাসুম তখন সবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ দিয়েছে, আম্মি আর সে কি করবে ভেবে না পেয়ে গ্রামের সব বেচেবুচে শহরে মামুজানের কাছে চলে এলো তারা, কিন্তু মামুজান বৃদ্ধ মানুষ তাদের কি দেখবে!! মামুজানের ছেলেরাও পছন্দ করলোনা তাদের তবু আম্মি সেখানে থেকেই সেলাই এর কাজ শুরু করলো আর সেই সেলাই এর জামাকাপড় নিয়ে তবাসুম শহরের দোকানে দোকানে বেচে আসতো , পড়াশুনো করার ইচ্ছে থাকলেও আর এগোনো হয়নি, চলে যাচ্ছিলো মোটামুটি , এরপর সেলিম এর সাথে তার নিকা হলো,সেলিম খুব ভালোবাসতো তাকে কিন্তু সেলিমের মা আর বোন তবাসুম কে দুচোক্ষে দেখতে পারতোনা সবসময় ঝগড়া করতো তার সাথে, আর সেলিম এলেই তার নামে মিথ্যে মিথ্যে বলতো দুজনে! প্রথম প্রথম কিছু না বললেও পরে সেলিম চেঁচামেচি করতো তবাসুম এর ওপর ! এরপর মারধোর ও শুরু হলো ধীরে ধীরে !! তবু তবাসুম চেষ্টা করতো সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার !! কারণ গরীব বৃদ্ধ মা আর মামুজানের কাছে কি করে ফিরে যাবে!! এরপর আক্রম হলো তাদের ছেলে!! কিন্তু অশান্তি কমলোনা , তবাসুম আক্রম কে মানুষ করতে লাগলো সব অশান্তি কে দুরে সরিয়ে কিন্তু আল্লার বোধহয় অন্য মর্জি ছিলো!! এক অদ্ভুদ রোগ হলো তবাসুমের !! প্রথম প্রথম মাথার চুল উঠতে লাগলো , তারপর ভুলে যেতে লাগলো খুব সাধারণ রোজকার কথা এরপর চেহারার পরিবর্তন হলো !! ডাক্তার ঘর করে জানা গেলো এন্ডক্রিন গ্রন্থি থেকে একধরনের হরমোন বেড়িয়ে যা শরীরে লালার মাধ্যমে মিশে যায় যা গাছ বা পত্রে বেড়োলে তার বিকাশ ঘটে কিন্তু মানুষের শরীরে বেড়োলে মানুষ দৈত্যকার ধারণ করে!!
ওতো সুন্দর মুখ ধীরে ধীরে চামড়া ঝুলে গালের ও চোয়ালের হাড় বেড়ে কুশ্রী এক মানবীতে রূপান্তরিত হলো সে !! সেইসঙ্গে হাত পায়েরো বৃদ্ধি ঘটলো!!সবাই ভয় পেতো তাকে দেখে!! তবাসুম নিজেও আয়নার কাঁচ ভেঙেছিলো নিজেকে দেখে!! এর ইলাচ প্রচুর খরচাসাপেক্ষ!! সেলিম তাকে তালাক দিলো!!আক্রম কে কেড়ে নেওয়া হয় তার থেকে!! সবাই তাকে ঘেন্না করলেও ওই ছোটো শিশুটা তাকে ঘেন্না বা ভয় পায়নি সে আসতো তার কাছে গভীর রাতে নিজের বিছানা থেকে উঠে আম্মি বলে জড়িয়ে ধরে আদর করতো!! তবাসুম এর চোখ দিয়ে হু হু করে জল পড়তো!!সেই ছেলেকে কেড়ে নিয়ে তাকে বের করে দেয় সেলিম!! তবাসুম
ফিরে যায় মামুজানের ঘরে , মামুজান মারা গেছে ততদিনে , মা ও খুব অসুস্থ !! তবাসুম কি করবে ভেবে পায়না!! তার চেহারা দেখে কেউ তাকে কাজ দেয়না!!লোকে হাসাহাসি করে!! এরপর প্রায় না খেতে পেয়েই মা চলে যায়!!! মামুজান এর ছেলেরা তাকে তাড়িয়ে দেয় !! তবাসুম ভালো করে চলতেও পারেনা পায়ে অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে!! সে ভিক্ষে করে যা পায় কোনোরকমে দিন চলে তার সারাদিন বোরখায় মুখ ঢেকে রাখে সে!! তবু কিভাবে যেনো ব্রজদা জানতে পারে তার কথা!! একদিন ব্রজ দা আসে তার কাছে এই বটতলায় বলে,” আমার তাঁবুতে শো করবে?অনেক পয়সা পাবে!!” তবাসুম হাঁ করে থাকে !!এই বিভৎস রূপই তার রোজগার হবে!! সবাই তাকে দেখবে টাকা দেবে এটাই কাজ!! তবাসুম রাজি হয়ে যায় আর উপায়টাই বা কি!! বাঁচতে হবেতো!! সেই থেকে ব্রজদার সাথে সে , ব্রজদাই তার নাম দিয়েছে রাধারানী !! ব্রজ দার তাঁবুতে সেইই মূল আকর্ষণ !!প্রচুর পয়সা টাকা পড়ে সে এলেই!! ওই কুৎসিত মুখ থেকে সবাই পয়সা ছোঁড়ে হাসে সিটি মারে!! তবাসুম অবাক হয়ে দেখে তার চেয়েও কুৎসিত মনের মানুষগুলোকে!! কি আর করবে অভ্যাস হয়ে গেছে এখন!! হঠাৎ ব্রজদার গলা পায় ” রাধা চলো তোমার সময় হয়ে গেছে !!” তবাসুম চোখ খুলে দেখে বৃষ্টি থেমে গেছে !! সে আস্তে আস্তে বাইরে যায় সবাই তাকে দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ে চেঁচায়!! হাত তালি দেয়!! মুঠো মুঠো টাকা আর পয়সা পড়ে তার পায়ের কাছে!!! তবাসুম তার লেহেঙ্গা টা নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাঁটে এদিক থেকে ওদিকে!! তার চেয়েও কুৎসিত উল্লাসে ফেটে পড়ছে সবাই!! তার অসুখ বহু মানুষকে সুখ দিচ্ছে আজ !!! হঠাৎ পেছনে চেঁচামেচির শব্দ পাওয়া যায় !! সবাই শো থামিয়ে ছুটে যায় তবাসুমও যায় !! দেখে একটা অল্প বয়সী ছেলে মাটিতে পড়ে কাঁদছে তার মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে!আর যে তাকে মেরেছে সে ওর বুকের ওপর বসে বলে চলেছে ,” তু হাসা কিউউ ! !মার ডালুঙ্গা তুঝে মার ডালুঙ্গা !! ” সবাই সেই ছেলেটাকে হাত ধরে টেনে তোলে!!! সেই ছেলেটি এবার তবাসুমের দিকে ছুটে এসে তার গলা জড়িয়ে গালের ঝুলে যাওয়া চামড়ায় চুমু খেয়ে বলে,” আম্মি তুম দুনিয়াকি সবসে খুবসুরত আম্মি হো , ওর ম্যায় তুমারা বেটা আক্রম হু!!” তবাসুম দু চোখে জলের ধারা নিয়ে ছেলে কে জড়িয়ে ধরে বুকে আর ভাবে ইতনি জিল্লৎ ভরি জিন্দেগে কে বাদ ভী খুবসুরতী আভি ভী জিন্দা হ্যায় ওর শায়দ উস্কে নামহি আল্লাহ হ্যায়!!
#নীলবৃষ্টি
স্বত্ব সংরক্ষিত