# পুজো আসছে# ✒️✒️ কলমে — অরণ্যানী অরণ্যানী

# পুজো আসছে#
কলমে — অরণ্যানী অরণ্যানী

  1. পুজো বললেই ছোটবেলার কিছু স্মৃতি তো আসেই মনে। পুজোর আগে পুজোর গন্ধ আসার অভিজ্ঞতাটা নিশ্চয়ই অনেকেরই স্মরণে আছে! আর ছোটবেলা গ্রামে কেটে থাকলে তো আরোই স্মৃতিতে থাকবে। বিশ্বকর্মা পুজো দিয়ে মা দুর্গার আগমণী বার্তা আসত গ্রামের ঘরে ঘরে। গ্রামে অনেক বাড়িতেই রান্না পুজো হতো সেদিন। আগের দিন রাত্রে সমস্ত রাত্রি জেগে কম করে পাঁচ প্রকার ভাজা সহ ডাল, ইলিশ মাছ ও কচুর শাক রান্না তো উচ্চ নিম্ন সব অর্থনৈতিক অবস্থার মানুষেরই ঘরে ঘরে হতোই। (প্রয়োজনে কম খেয়ে জমিয়ে, ধার করে হলেও) অবশ্য যাদের রান্না পুজো ছিল। যদিও এটি বেশি প্রচলিত ছিল তথাকথিত নিম্ন বর্গের মানুষের মধ্যে। তবে মধ্যবিত্তের মধ্যেও দেখেছি আমাদের গ্রামে। দুর্ভাগ্য বশত আমাদের বাড়িতে এ পুজোর প্রচলন ছিল না। তাই যখন সমস্ত রাত্রি ধরে বহু প্রকার পদ রান্নার গল্প শুনতাম অনেকের মুখে, তখন মনটা একটু খারাপ লাগত। বার কয়েক আমরা দুই বোন প্রস্তাব দিয়েছি মাকে এই অনুষ্ঠানটি আয়োজিত করতে। কিন্তু বাবা আগের রাত্রের বাসি রান্না খাওয়ার প্রস্তাব স্বভাবতই বাতিল করে দিতেন আন হাইজেনিক বলে।

যে সকল বাড়িতে রান্না পুজোর প্রচলন ছিল, তারা ভাদ্র মাসের শেষের দিকে ঘর বাড়ি ঝাড়া মোছা, বিছানার চাদর থেকে লেপের ওয়ার, দীর্ঘদিনের জমিয়ে রাখা জামাকাপড়, সমস্ত কিছু কাচাকাচি করে ঘর থেকে দোর পর্যন্ত পরিষ্কার করে তুলতেন। এ যুগের মতো ঝাঁ চকচকে ঘর বাড়ি তো তখন সাধারণত দেখাই যেত না। ফলে কষ্ট করে সেই পুরনো বাড়িকেই সাজিয়ে তুলতে হতো। আর এই রান্না পুজোকে কেন্দ্র করেই দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি তাদের একরকম সম্পূর্ণ হয়ে থাকত।

আমরা ছোটবেলায় পুজোর গন্ধ পেতাম, জানলা খুলেই বাড়ির সামনে নারায়ণ ঘরের কাছে শিউলি গাছটায় দু চারটে করে ফুল ধরতে শুরু করলেই। আর বর্ষার পর ভাদ্র মাসে রোদ উঠলেই বড় বড় পুরনো ট্রাঙ্ক ও সুটকেসে জমিয়ে রাখা ভালো জামাকাপড়, মায়ের পুরনো ভালো মন্দ জমিয়ে রাখা সব শাড়ি যখন তালপাতার চ্যাটাইয়ের উপর রোদে দেওয়া হতো, তখনো একটা উৎসবের গন্ধ যেন পেতাম। ট্রাঙ্ক সুটকেস গুলো ফাঁকা হয়ে যেত হঠাৎ করেই! এই দিনটির জন্য আমরা অনেক আগে থেকেই অপেক্ষা করে থাকতাম। মায়ের বিয়ের বেণারসী রোদ খেত! বিস্ময়ে দুই বোন সমস্ত বাড়ি জুড়ে কী যেন এক মহানন্দে মেতে উঠতাম। কখনো খালি বাক্স গুলো থেকে ন্যাপথলিনের পুরনো গন্ধ নিতাম, কখনো মায়ের রোদে দেওয়া পুরনো শাড়ির গন্ধ আঘ্রাণ করতাম। আহ্, এই তো পুজোর গন্ধ এসে গেছে। কাজের দিদি বা মাসি ঘোষণা করত আর এক মাস কত দিন পর যেন পুজো। ফাঁকা হয়ে যাওয়া ট্রাঙ্ক সুটকেস গুলো হয়ে উঠত ভীষণ কৌতুহলের বস্তু! মা তো সেদিন কাজের লোক সহ সমস্ত দিন কাজেই ব্যস্ত। আমাদের স্নান খাওয়ার তাড়া কেউ দিচ্ছে না। দুই বোনে মিলে যতটুকু সময় ওই ট্রাঙ্ক সুটকেস গুলো ফাঁকা পাই, তার মধ্যে আমাদের সমস্ত পুতুলকে ঢুকিয়ে তাদের দেশ বিদেশ ঘোরানোর খেলা শুরু করে দিতাম। একই সঙ্গে অসময়ে, অনিয়মে খাওয়া দাওয়া করার, আর একদিনে মায়ের এতো পরিশ্রমের জন্য বাবার বকাবকি চলতে থাকত মাকে। বাবার মতে একদিনে সব কাজ নয়, দিনে দিনে করা। কিন্তু মা একবার কাজে উৎসাহিত হয়ে উঠলে তাকে তখন ঠেকায় কে? সত্যিই দশভূজা দুর্গা! আর শিব পার্বতীর মতো ঝগড়াও লেগে যেত রীতিমত এক এক সময়। এগুলোও আমরা খুব উপভোগ করতাম। বাবার তাগিদে বাবা সহ আমাদের খাওয়া হয়ে যেত। হাজার চেষ্টা করেও বাবা মাকে খাওয়াতে অক্ষম হয়ে গজগজ করতে করতে আবার স্কুলে ফিরে যেতেন(বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন। বাড়ির কাছে স্কুল হওয়ায় ক্লাস অফ থাকলে বাড়িতে ঘুরে যেতেন)। আমরা কোনো ঝামেলা না করে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে, মা ট্রাঙ্ক সুটকেসে আবার শাড়ি, উঠানোর আগেই বাকি খেলাটুকু শেষ করতাম।

শুধু যে জামাকাপড় রোদে দেওয়া হতো তাই নয়। ধীরে ধীরে বালিশ, বিছানা তোশোক, এমনকি লেপ ক্যাঁথাও সব বের করে একে একে রোদে যেত। খাট তো আমাদের ছিল না। বিছানা হীন খালি চৌকি গুলোও বছরের ওই একটা দিনের জন্য বড়ই অচেনা আর নতুন লাগত। সেখানেও খানিক খেলা চলত। তারপর বাইরের রকে, যেখানে সব কিছু রোদে দেওয়া আছে, পুতলদের সহ সেখান গুলিও পর্যবেক্ষণ শুরু হয়ে যেত। নরম লেপের উপর মায়ের অগোচরে একটু শুয়ে নেওয়া, আর মাথার উপর ঘন নীল খোলা আকাশ! না, রোদের তেজ অনুভবে আসত না। দেখতে পেয়ে মায়ের তেড়ে আসা, আর সাথে সাথে লেপ ছেড়ে ঘরে দৌড়। এই ছিল পুজোর পূর্বাভাস।

এরপর পুজো টের পাওয়া যেত ঘরের সমস্ত কিছু কাচাকাচি আর ঘর ঝাড়পোঁছের সময়। সেযুগে মাটির উনানে ঘুঁটে কয়লা ও গুল সহকারে বেলা দশটা সাড়ে দশটার মধ্যে রান্না সেরে শুরু হয়ে যেত ঘর ঝারপোঁছ। দীর্ঘদিনের পুরনো ভাড়া বাড়ি আমাদের। দেওয়ালের প্লাস্টার খুলে গিয়ে চুন বালি ঝরত দেওয়াল থেকে। বাড়িওয়ালাকে বললে ভাড়া থেকে কেটে সারিয়ে নেওয়ার কথা বলতেন। কিন্তু একজন হাই স্কুলের শিক্ষকের বেতন তখন কত? তার মধ্যে সংসার চালিয়ে, কাজের লোক রেখে, প্রতিবেশীর সুবিধা অসুবিধায় তাদের পাশে থেকে, অতিরিক্ত কিছু তো হাতে থাকত না। ফলে চুন বালি ঝরা বাড়িতেই বাস করতাম সারা বছর। দিনের মধ্যে তিন চার বার মাকে ঘর ঝাঁট দিতে হতো। তিন চার বছর অন্তর বাড়িওয়ালা চুনকাম করে দিতেন। ঘরে রঙ করা কী জিনিস, তা জানতাম না তখনো। আর এতো কাজের চাপে রোজ দিন ঝাড়পোঁছ করার সময় না হয়ে ওঠায় পুরনো বাড়ি মাকড়সার ঝুলে ভরে যেত। প্রথমেই শুরু হতো ঘরের বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ার, মশারী, এগুলো টেনে নিয়ে সাবান জলে ভেজানো। অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়টা না থাকার কারণে এগুলিই শুকিয়ে গেলে তারপর আবার ব্যবহার করতে হতো! যেটা এখনও হয়তো দরিদ্র শ্রেণীর মানুষেরা করে থাকেন। মা এসবের জন্য বাবাকে দায়ি করতে করতেন (দ্বিতীয় কোনো বিছানার চাদর বা বালিশের ওয়ার না থাকার জন্য)। রাগত ভাবে কাজের লোককে সঙ্গে নিয়ে ব্যস্ত হাতে কাজ করে যেতেন। মায়ের দ্রুত হাতের কাজের সঙ্গে তার সহকারী পাল্লা দিয়ে না উঠতে পারার জন্য মাঝে মধ্যেই ধমক খেত। বাড়ির পরিবেশ সে সময় বেশ উত্তপ্ত থাকত । কখনো বা কাজের লোকটিকে সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে কিভাবে কাজ করতে হয়, তা মা-ই দেখিয়ে যেতে থাকতেন। বেচারা কাজের লোকটি বোকার মতো ভয়ে ভয়ে মায়ের কাজের প্রচুর প্রশংসা করতে থাকত।

এই উত্তেজনা পূর্ণ পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে বাবা দ্রুত খাওয়া সেরে স্কুলে বেরিয়ে যেতেন। তবুও যাবার আগে মাকে সময় মতো খাওয়া দাওয়া সেরে নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে যেতেন। কিন্তু সে সব কথায় কান দেওয়ার বিন্দুমাত্র সময় তখন মায়ের হাতে নেই। বাবাকে খেতে দিয়েই সাবান ভিজিয়ে এক এক ঘরে হাত দিয়ে নারকোল কাঠির ঝাঁটার দ্বারা বীর দর্পে দেওয়ালের বালি যা ঝরার ঘষে ঝরিয়ে দিতে চাইছেন! বাবা যদি বোঝানোর চেষ্টা করতে যেতেন, যে যতই ঘষবে ততই বালি ঝরবে, এটা অর্থ হীন হয়ে যাচ্ছে, তবে বাবাকেই তার অক্ষমতার জন্য বকা শুনতে হবে। তবুও একবার সে মন্তব্য না করে বাবা পারতেন না। মন্তব্যটা করেই দ্রুত বেরিয়ে যেতেন। কাজের লোকটি ঘরের ঝুল ঝাড়ার চেষ্টা চালিয়ে যেত তখন। সে কাজও মায়ের খুব মনোঃপুত হতো না। ঝুলঝাড়ুটা তার হাত থেকে নিয়ে মা-ই সেই কাজ সম্পূর্ণ করতে থাকতেন। একটা ঘরে কাজ চললে আমরা দুই বোন অন্য ঘরে বা বাইরে খেলতাম। মাকে সেই সময় একেবারেই রাগানো চলত না। তাই একটু দূরে দূরে থাকাটাই ছিল নিরাপদ।

মাকে দেখে উদ্দীপিত হয়ে পাশের ঘরের কাকিমাও শুরু করে দিতেন তার ঘর বাড়ি ঝাড়ার কাজ। মাঝে মাঝে চলত পরস্পরের কাজ দেখা ও পরস্পরকে সাহায্য করা। প্রতিবেশীরাও মধ্যে মধ্যে এসে মা ও পাশের ঘরের কাকিমাকে উৎসাহিত করে যেতেন। জোর কম্পিটিশন শুরু হয়ে যেত দু’জনের মধ্যে। সারা বাড়ি ধুলো বালি আর নোংরায় ভরে উঠত ক্রমশ! আমাদের বাইরেই থাকতে হতো শেষ পর্যন্ত। সে সময় শরতের আকাশ। কখনো রোদ, তো কখনো মেঘ, আবার কখনো মুশলধারে বৃষ্টিও নেমে যেত। তাই ঘর ঝাড়া অর্ধ সমাপ্ত রেখে জামাকাপড় কাচার কাজে হাত লাগাতে হতো মায়েদের । সামনেই পুকুর ঘাট। কোনো কাজই কাজের লোককে একা ছাড়া যায় না! সঙ্গে মাকে থাকতেই হবে। নাহলে কাজ সঠিক হবে না। কাচা মেলার পর টেনশন শুরু হয়ে যেত, সব শুকোবে কিভাবে? সেছাড়া এতো জিনিস মেলারও তো জায়গায় কুলোত না। কাকিমা মায়ের থেকে বয়েসে ইয়ং। তিনি নানা প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত দড়ি টাঙানোর ব্যবস্থা করে ফেলতেন। তারপর অসমাপ্ত ঘর ঝাড়ার কাজটা সমাপ্ত করতে করতে চলত মাঝে মাঝেই জামাকাপড় চাদর ইত্যাদি উল্টে পাল্টে দিয়ে দ্রুত শুকোনোর চেষ্টা। আকাশ তো সব সময় সহযোগিতা করত না। আকাশে মেঘ দেখলেই ঠাকুর দেবতাকে স্মরণ করা চলত কাজের মধ্যেই। এখানে আমাদের আনন্দের বিষয় ছিল একটাই। মশারী কাচার পর সেটিকে দড়ির খুঁট সহ বাইরে টাঙিয়ে দেওয়া হতো দ্রুত শুকোনোর জন্য। আর দিনের বেলা সেই মশারীর ঘরে ঢুকে বসে থাকার আনন্দই আলাদা! তখন মশারী হতো সুতির। ফলে রোদ আড়াল হতো কিছুটা। যদিও মধ্যে মধ্যে এসে আমাদের বকা ঝকা করা হতো মশারীর ভেতর খেলতে গিয়ে খুঁট ছিঁড়ে ফেলার জন্য, কিন্তু এমন লোভনীয় খেলা পরিত্যাগ করতে পারতাম না। মা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেই আবার শুরু হয়ে যেত। বিছানায় নয়, বাইরের রকে টাঙানো আছে ভিজে মশারী! এতো পুরোপুরি একটা ঘরের মতো মনে হতো! আর এগুলোই তো মনে করিয়ে দিত, যে পুজো এসে যাচ্ছে!

শরতের নীল আকাশে, পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ যখন উড়ে চলেছে মাথার উপর দিয়ে, তখন সেই ছোট্টবেলার জীবনের দৈনন্দিন রুটিনে আসত একটা পরিবর্তনের ঢেউ! ভোরবেলা দুই বোনে সাজি হাতে শিউলি ফুল সংগ্রহে বেরোতাম।শিশিরে ভেজা ঘাসে তখনো কাদা লেগে থাকত। আমি তো তেমন দক্ষ ছিলাম না তখনো সে কাজে। দিদিই বেশি ফুল জড়ো করত, আর আমাকে উৎসাহিত করতে থাকত। বলত, শিউলি ফুলের কমলা রঙের বোঁটা গুলো জমিয়ে রাখলে তা দিয়ে সরস্বতী পুজোর সময় সাদা টেপ জামাকে রাঙানো হবে। ফুল দিয়ে দিদি মালা গাঁথত, আর আমি ফুলের বোঁটা গুলো ছাড়িয়ে দিতাম। অবাক হয়ে দেখতাম, সূচ সুতো দিয়ে দিদি কেমন অবলীলায় মালা গেঁথে চলেছে! হাতে সূচ ফুটে যাচ্ছে না। দিনে দিনে সংগ্রহ করা শিউলি ফুলের বোঁটা পরিমাণে বাড়তে থাকত। সেগুলো মায়ের কাছে জমা করে দিতাম।

আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত জীবনে তখন মায়ের মতোই ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত। পুজো আসছে, মানে পুতুলদের নতুন জামা চাই। মায়ের কাছে শুনেছিলাম আমার দিদিমা পুজোর মাস খানেক আগে থেকেই খরচ সংক্ষেপ করে টাকা জমাতেন ছেলে মেয়েদের পুজোর জামাকাপড় কেনার জন্য। কিন্তু আমার বাবার এসব দিকে কোনো হুশ ছিল না। টাকা জমানো বাবার ধাতে সইত না। কিন্তু দিদিমার এই প্রথাটা ছোটবেলা থেকেই আমার খুব পছন্দের ছিল। তাই আমি নিজে একা একা খেলার সময় ঘোষণা করতাম, পুজো এসে যাচ্ছে। জিনিসের যা দাম, এখন সবাইকে খরচ কমাতে হবে। আমি ছোটবেলায় একা একাই বেশি খেলতাম। বড় জোর পাশের ঘরের কাকিমার ছেলে অভি আমার খেলার সঙ্গী হতো অনেক সময়। দিদি বিশুদ্ধ ভাষায় শেখাল, পুজোর আগে একমাস সঞ্চয় মাস পালন কর। একমাস কবে কতদিনে হচ্ছে তার কি আর হিসাব ছিল? তবে আমরা এখন খুব কম খরচে সংসার চালাচ্ছি, সেটা খেলার মধ্যে ঘোষণা হতো মাঝে মাঝেই।

তার উপর গুরু দায়িত্ব হলো পুতুলদের নতুন জামা তৈরির কাজ। পুতুল বলতে স্বাভাবিক ভাবে আপনারা যা ভাবছেন, সেই পুতুল আমাদের ছিল না। আমাদের গ্রামে ও পাশের গ্রাম জনাইয়ে কোনো খেলনার দোকান ছিল না। বছরে দু’বার মেলা থেকে পুতুল কেনা হতো। দোলের মেলা আর রথের মেলায়। সেই পুতুলকে যদি প্রতিদিন তেল সাবান মাখিয়ে স্নান করানো , নানা প্রকার খাবার রান্না করে খাওয়ানো, অসুখ করলে ইনজেকশন দেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো, তারপর বখে গেলে মারধর! এসব চলে, তবে সে পুতুল আর কতদিন টেকে? তার চেয়ে অভির পছন্দ ছিল সালিমার নারকোল তেলের খালি টিন, রেডিওর পুরনো ব্যাটারি, কঞ্চির টুকরো অথবা পাটকাঠি কেটে নিয়ে ওগুলোকেই পুতুল করে খেলা। সত্যিই বেশ সুবিধা জনক ছিল সেটা। একটা নষ্ট হলে আর একটা জোগাড় করতে বেশিক্ষণ লাগত না। আর পুজোর জামা বানানো বলতে এদেরই জামা বানানো হতো। শুনে বেশ অবাক লাগছে তো? অবাক সকলেই হতেন। হাসাহাসিও করতেন। কিন্তু আমাদের তাতে কিছু এসে বয়ে যেত না। আমাদের কাছে ওই তুচ্ছ বস্তুগুলোরই তখন যথেষ্ট মূল্য ছিল।

কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এগুলোকে জামাকাপড় পরানো হতো কী প্রকারে? সারা বছর পাউরুটির প্যাকেটের রঙিন কাগজ কাঁচি দিয়ে সাইজ মতো করে কেটে এদের জন্য জামা বানিয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে পরিয়ে রাখতাম। কিন্তু পুজোর জামা তো একটু ভালো হতেই হবে ঘরে পরা জামার থেকে। তাই তখন বড় সাদা খাতার কাগজ কেটে, তাতে রঙ পেনসিল দিয়ে কারুকাজ করে জামা বানাতে বসে যেতে হতো। সমস্ত দিন ধরে চলত অক্লান্ত পরিশ্রম! পুজোয় আমাদের একটা জামা হলে কি হবে, পুতুলরা প্রতিদিন এক একটা করে জামা বদল করবে পুজোয়। আর পুতুল খেলা বলতে শুধু নিজের ছেলে মেয়ে নিয়ে খেলা নয়, সেই পুতুলদেরও একটা সমাজ ছিল। পুরো একটা পাড়া। কারুর বাড়ি খাটের নিচে, কারুর টেবিলের নিচে, কারুর চেয়ারের নিচে, জলচৌকির নিচে, ট্রাঙ্ক সুটকেস জলচৌকির উপর রাখার সময় তার পেছনে কিছুটা জায়গায় আর একজন দের বাড়ি। ফলে শুধু নিজের ছেলে মেয়েদের জামা বানালেই হবে না, এইসব প্রতিবেশী পুতুল সমাজের জন্যও পুজোর জামা বানাতে হবে কাগজের উপর রঙ বেরঙের নতুন নতুন ডিজাইনে। এভাবে এক মনে বসে নানা ডিজাইনের আঁকা দেখে বাবা বিস্ময় প্রকাশ করে বলতেন, সত্যিই নাকি কারা এভাবে জামাকাপড়ের ডিজাইন করে। আমার এইসব ডিজাইন দেখলে তারা অবাক হয়ে যাবে! আমি ওসব কিছু বুঝতাম না। নিজের মনে একের পর এক জামা বানিয়ে চলতাম নানা রঙে, নানা ডিজাইনের ফুল পাতা প্রজাপতি, ফুলগাছ, যা মনে আসত তাই এঁকে। পুজো যখন এসে যাচ্ছে, তখন নাওয়া খাওয়ারও ভালো করে সময় হতো না। মাকে বলতাম, দাঁড়াও, এটা শেষ করেই যাচ্ছি। আর জামা গুলো ব্যাটারি, তেলের কৌটো, কঞ্চির টুকরো, ওই সব পুতুলকে পারতাম সুতো দিয়ে বেঁধে।

নিজের ছেলে মেয়ে ছাড়াও অন্য সবার কিন্তু আলাদা আলাদা নাম ছিল, তাদের পৃথক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও ছিল। কেউ ভালো, তো কেউ দুষ্টু। এদের মধ্যে আবার অনেকে প্রেমও করত কিন্তু! এসব দিদি জানলেও, বাবা মা জানত না। পুরো সমাজ থেকে যা দেখতাম, তাই খেলার মধ্যে এসে ঢুকত। একবার এক উঠতি কবি আমার এই ছোটবেলার খেলা দেখে খুব অবাক হয়েছিলেন। বলেছিলেন, এতো সমাজেরই প্রতিচ্ছবি!
(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *