তুমি আসবে বলেই,,,, কলমে-নিতু চৌধুরী
তুমি আসবে বলেই,,,,
কলমে-নিতু চৌধুরী।
রাত্রি দুটো, বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে একমনে তাকিয়ে ছিলাম আকাশের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলাম ।হঠাৎই নাকে হাল্কা মিষ্টি গন্ধ লাগতেই সম্বিৎ ফিরলো।আচ্ছা কিসের যেন গন্ধ এটা?কিছুতেই মনে করতে পারছিনা। বারান্দার গ্রিল গেটটা খুলে একটু বাইরে বেরোতেই একটা ঠান্ডা শীতল হাওয়া ছুঁয়ে গেলো সঙ্গে কেমন যেন একটু ভিজে ভিজে ভাব। আমার গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে চাঁদের আলোতে দেখলাম শিশির পরেছে তাদের উপর। বুঝলাম শিশিরে ভেজা হাওয়ার পরশ আমাকেও ছুঁয়ে গেছে।হঠাৎই উল্টো দিকের বাড়িটার দিকে তাকাতেই ওদের পাঁচিল লাগোয়া শিউলি গাছটার দিকে চোখ পরতেই দেখলাম ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে, যার সৌন্দর্য্য রাতের অন্ধকার কেও হার মানিয়েছে।বুঝতে পারলাম আমার নাকে লাগা মিষ্টি গন্ধের উৎসস্থল।হঠাৎই অদ্ভুত ভালোলাগার আবেশে মন ভরে উঠলো। মনে পরলো,, ,
“এসেছে শরৎ, হিমের পরশ, লেগেছে হাওয়ার পরে”।
মা আসার সময় হয়ে গেলো যে, আকাশ-বাতাস-প্রকৃতির সব খানেই যে সেই বার্তা ই ধ্বনিত হচ্ছে। কদিন বাদেই মহালয়া, কতো যে স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওই দিন টিকে ঘিরেও।আমাদের ছোট বেলায় ,মহালয়ার আগের দিন রাত্রে ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রাখতেন বাবা কারণ মহালয়া না শুনতে পারলে যেন পূজোর আনন্দ টাই মাটি হয়ে যাবে। এই একটা ব্যাপারে বাবার সঙ্গে সবসময়ই আমি একমত। এখনও ফি বছর আমার বিরাশি বছরের বৃদ্ধ বাবা মহালয়া শুরুর আগে ফোন করতে ভোলেন না। এখন অবশ্য দেখি মহালয়ার পরেও কতো জায়গাতেই মহালয়ার রেকর্ড বাজে কিন্ত ওই বিশেষ সময় টাতে রেডিও তে মহালয়া শোনার যে আনন্দ সেটার তুলনা বোধ হয় চলেনা।
মনে পরে যাচ্ছে আরও কতো কথা, বাবা সরকারী চাকুরে ছিলেন বলে আমরা কোয়ার্টারে থাকতাম কিন্ত আমাদের সেই কোয়ার্টারে কাকু পিশি জেঠু জেঠিমা আমি ভাই এবং অন্যান্য জেঠতুতো ভাই বোন মিলে প্রায় সবসময়ই আঠারো কুড়ি জন মেম্বার থাকতাম। অন্য দিকে দেশের বাড়িতে ঠাম্মা দাদু এবং অনান্য কাকু কাকিমা কচি কাঁচা মিলে আরও জনা বারো ।বাবা যখন বোনাস বা এডভ্যানস পেতেন। সবার জন্য পূজোর জিনিস কিনতে কিনতেই প্রায় টাকা শেষ হয়ে যেতো। আমার ভাইয়ের বা মায়ের হয়তো অনেক কষ্টে কিছু একটু জুটেই যেতো মা দুর্গার দয়ায়।এভাবেই চলে ছিলো প্রায় আমার সিক্সে পড়া অবধি যেহেতু সব কাকুরা তখনও চাকরি করতেন না তাই বাবা হাসি মুখেই সব সামলাতেন।
এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎই আমার বাড়ির সামনের মাঠে চোখ গেলো। প্যান্ডেল তৈরির কাজ চলছে। দেখতে দেখতে আবারও হারিয়ে গেলাম স্মৃতির সরনী বেয়ে। ছোট্ট বেলায় কোয়ার্টারের মাঠেও এভাবেই প্যান্ডেল বাঁধার কাজ চলতো যখন খেলতে যাওয়ার নাম করে ছুট ছুট, এক্কেবারে মাঠে তার পর সেই বাঁশের উপর ওঠা আর মাটির মধ্যে লাফ। তার পর হয়তো কোন কাকু বা জেঠুর কানমলা খেয়ে মুখ ব্যাজার করে ঘরে ফেরা।
সে সময় এখন কার মতো থিম পূজোর হিড়িক ছিলো না। আমাদের সনাতনী মাতৃ মূর্তি শিল্পী গোষ্ঠ কুমার পাল পরবর্তীতে শিল্পী সনাতন রুদ্র পালের হাত ধরে তার ছানা পোনা দের নিয়ে যখন প্যান্ডেলে আসতেন,তখন আমাদের ও হাত ঘুরিয়ে দুলে দুলে নাচ শুরু হতো,,,,
“গনেশটা বড়ো হ্যাংলা ,একবার আসে মায়ের সাথে একবার আসে একলা।
লক্ষ্মী বড়ো হ্যাংলা একবার এলো মায়ের সাথে, আসবে আবার একলা।
সরস্বতী বিদ্যাবতী তবুও বাবা হ্যাংলা অতি “এই সমস্ত ছিলো আমাদের পূজোর গান।
জামা কাপড় নিয়ে মাথা ব্যথা ছিলোনা কখনোই পূজো বলে।পূজোর সময় পূজো সংখ্যা আনন্দ মেলা বা শুকতারা ,সন্দেশ এই সমস্ত পত্রিকার আব্দার মেটাতেন বাবা অবশ্যই ।আর ক্যাসেট চাইতাম বাবার কাছে পূজো সংখ্যার গানের। পূজোর চারদিন কোয়ার্টারের মাঠ টাই হতো বাড়িঘর। খেলা আর আলুকাবলি, ঘুগনি খাওয়া।নতুন জামা জুতো পরে কোয়ার্টারের মেন গেট অব্দি চলতো ফ্যাশন শো কারণ অনান্য সময় গেট অব্দি যাওয়া নিষিদ্ধ ছিলো ছোট বলে।
পূজোর চারদিন শেষ হলে দশমীর দিন এলে ঘর থেকে বেরোতেই ইচ্ছে করতো না কারণ বিসর্জনের জন্য মাকে যখন লরি তে তোলা হতো ওটা দেখতে ইচ্ছে হতোনা। তবে সেই সময় একটা জিনিস খুব খেয়াল করতাম। আচ্ছা ,মা দূর্গা বাপের বাড়ি থেকে শবশুর বাড়ি চলে যাচ্ছেন, সব মেয়েদের মতো তিনিও কি কাঁদছেন?না হলে ওই অতো সুন্দর টানা টানা চোখে জল টলমল করছে কেন?আসলে বুঝতে পারতাম না উনি কাঁদছেন নাকি আমার চোখে জল বলে আমি ওনার চোখটাও জলে ভরা দেখছি?সেই সময় বন্ধুরাও কিন্ত আমরা সবাই সবার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতাম “কাঁদছিস?আরে কাঁদিস না, আসছে বছর আবার হবে।”
হঠাৎই পাশের বাড়ির দেওয়াল ঘড়িতে পাঁচ টার ঘন্টা বেজে উঠলো। দেখলাম শরতের আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘেদের মধ্যেই সূর্যদেব তার অস্তিত্বের জানান দিতে তৎপর কিন্ত আমার চোখ আবছা লাগছে কেন?ছোট্ট বেলা চলে যাওয়ার জানান দিচ্ছে চোখের কোল ভিজিয়ে। এখনও যখন বরণ করতে যাই মাকে সেই প্রশ্ন আজও করি “কাঁদছো মা?পানের পাতা দিয়ে চোখ মুছিয়ে বলি “আসছে বছর আবার এসো মা,অপেক্ষায় থাকবো তোমার জন্য “।
পূজোর আসার খবর খুব সুখকর। অপেক্ষার প্রহর গোনা বড়ো আনন্দের কিন্ত তার পর উৎসব শেষে
মনে হয় রেশ টুকু নাহয় থাক আরও কিছুক্ষণ।।