যদিও দুপুর তবুও রাত্রি এখন ✒️✒️ ম ধু মি তা বে তা ল
যদিও দুপুর তবুও রাত্রি এখন
ম ধু মি তা বে তা ল
(৭)
“শ্রেণী-অসাম্য নারীমুক্তির অন্তরায়”
নারীবাদী অনেক সমস্যাই আমাদের সমাজে চর্মরোগের মতো বাহিরে ও ভেতরে বাসা বেঁধে আছে। এইসব অসুখ সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে তোলা খুব কঠিন হলেও, ভেদাভেদ দূর করে সর্বস্তরের মানুষ যদি এক চেতনার ধারক ও বাহক হতে পারে তবে তা অসম্ভব নয়।
আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে এক আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে হলে এই সামাজিক অসুখ অবশ্যই সারিয়ে তুলতে হবে। অথচ নারীদের প্রায় সব সমস্যাই জের টেনে টেনে এই শতাব্দীতেও সমানভাবে ক্রিয়াশীল। শিক্ষা-সংস্কৃতির, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চরম সীমায় দাঁড়িয়েও আমরা প্রতিনিয়ত সেই একই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি বা পরিস্থিতির শিকার হচ্ছি। কারণ হিসাবে বলা যায় বিভিন্ন শ্রেণীগত বিভাজন মেয়েদেরকে নিজেদের স্বার্থেই এক হতে দিচ্ছে না। তার ওপর নারীদের রাজনৈতিক বিভাজন অনেকটা গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে বিরাজ করছে। প্রচলিত ও পথচলতি সমস্যা, দাসত্ব ও দায় থেকে মুক্তি পেতে গেলে নারীদের সর্বপ্রথম সব বিভাজন ভুলে শুধু নারী সত্তার নিরীখে একত্রিত হতে হবে এবং নারীকেন্দ্রিক পুরুষভিত্তিক চিন্তা-চেতনার মূলসত্তাকে বদলে ফেলতে হবে। এ বিষয়ে নারীসত্তাকে যথেষ্ট পরিবর্তনযোগ্য ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে হবে। নারী জাগরণের ক্ষেত্রে নারীদেরই প্রতিবাদী ও প্রতিরোধী হয়ে উঠা খুব জরুরী। সামান্য প্রতিবাদ ও প্রতিরোধই হয়তো নারীমুক্তি ও বিপ্লবের নতুন পথ খুলে দিতে পারে।
“মেয়ে-দেখা আসলে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়”
আমাদের সমাজে বিবাহের পূর্বে মেয়ে দেখা বা পাত্রী নির্বাচন পর্ব একটি নারীসত্তা বিরোধী কার্যক্রম। পাত্রের বাড়ি থেকে আট থেকে দশজনের (বেশি বা কমও হতে পারে) একটি টিম আসে মেয়ের বাড়িতে পাত্রী পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সচল না অচল যাঁচাই করতে। পাত্রীর বাড়িতেও সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে পাত্রপক্ষকে সন্তুষ্ট করার সবরকম আয়োজন থাকে। রীতি অনুযায়ী মেয়েকে সাজিয়ে, গুছিয়ে, শিখিয়ে বসাতে হয় পাত্রপক্ষের মধ্যমণি হয়ে। তারপর চলে ভাবী ‘স্ত্রী’ নামক পরিচারিকার ইন্টারভিউ। চারিধার থেকে দৌড়ে আসে প্রশ্ন– রান্না? সেলাই? গান? পড়াশোনা? বয়স? হাতের লেখা ইত্যাদি ইত্যাদি…। যদিও কাজে লাগে শুধু রান্নাটাই। এই পর্বে যদিও বা উতরে যায় মেয়েটি, তারপর নানান জিজ্ঞাস্য ওঠে উচ্চতা, গায়ের রঙ, চুলের মাপ, নাক-চোখ-ঠোঁটের সৌন্দর্য, বক্ষ-সৌন্দর্য তথা দৈহিক গঠন, নারীঘটিত সুস্থতা প্রভৃতি নিয়ে। পক্ষান্তরে মেয়ের পাত্র-সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নই যেন থাকতে পারে না। কোনো কারণে পছন্দ না হলে বাড়ি গিয়ে জানাব বলার অজুহাতে আবার একটি নতুন মেয়ে-দেখা। বিবাহের জন্য দেখাশোনায় মেয়েটির উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামুলক। ক্ষেত্রবিশেষে এই পরীক্ষা চলতে থাকে দীর্ঘদিন। নিজেকে চূড়ান্ত পণ্য ভাবা, মেয়ে-দেখা-পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, বাবা-মা-পরিবারের চিন্তার কারণ হওয়া মেয়েটির হীনমন্যতার কথা, অপমানের ব্যাথা, মানসিক অসহায়তা কিন্তু কেউ বোঝে না বা বোঝার চেষ্টাও করে না। অনলাইনে বিবাহের যোগাযোগ সংক্রান্ত সাইট বা সংস্থাগুলো পাত্র-পাত্রীর বিভিন্ন তথ্য আগে থেকেই তুলে ধরায় নারী-অবমাননার সম্ভাবনা খানিকটা কম থাকে। এই প্রসঙ্গে আমাদের মেয়েদের সচেতন হওয়া দরকার যে, তারা কোনোভাবেই কোনো ঘটক, পাত্র বা পাত্রপক্ষ কারও সামনেই নিজেদের পণ্য হিসেবে উপস্থিত করবে না। সব মেয়েকেই যে প্রেমের মাধ্যমে নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচন করতে হবে তা নয়, সামাজিক বিয়ের প্রয়োজনে একটি মেয়ের আর একটি পুরুষের বা তার বন্ধু বা আত্মীয়দের সাথে বসার প্রয়োজন হতেই পারে। কিন্তু সেটা হবে আত্মমর্যাদার সঙ্গে। বসে সসম্মানে তথ্য বিনিময় বা আলাপ-পরিচয় চলতেই পারে, পরীক্ষকমণ্ডলীর সামনে বসে পরীক্ষা দেওয়া কখনোই নয়। স্বাভাবিক কারণেই মেয়েটি আলোচনার মাধ্যমে পাত্র এবং পাত্রপক্ষের কাছে থেকে দ্বিধাহীন উচ্চারণে, স্পষ্ট ভাষায় তার জানবার বিষয়গুলো জেনে নেবে। প্রয়োজনে হবু পাত্র ও পাত্রী আলাদাভাবে বসতেও পারে তাদের ব্যক্তিগত ভাবনার আদান-প্রদানের জন্য। তাই বলতে চাই আদর্শ চেতনার মানুষ দিয়ে আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে হলে শুধু পুরুষের নিম্নমুখী ক্রেতাভাবাপন্ন মনোভাব নয়, মহিলার আপোষকামী বিক্রেতা-চেতনাগ্রস্ত সমাজসত্তাকে নির্মূল করতে হবে।
“অকাল বৈধব্য– একটি সামাজিক অভিশাপ”
আরও একটি সামাজিক ব্যাধির মতো হলো অকাল-বৈধব্যজনিত কারণে নারীর স্লো পয়জনিং করা জীবন্ত বলী। একজন অকাল বিধবার জীবন হঠাৎ করে সামাজিক স্বাভাবিকতা ছেড়ে সম্পূর্ণ বিপরীত খাতে বয়ে দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। মেয়েটি তার জীবনের প্রধান অবলম্বন চিরতরে হারিয়ে সার্বিকভাবে নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে পড়ে। তখন তীব্র মানসিক যন্ত্রণার সান্ত্বনায় তার পাশে খুব কমজনই থাকে, উল্টে কী পারিবারে, কী আত্মীয়দের কাছে, কী কর্মস্থলে, কী সমাজে সর্বত্রই সে অপয়া, অমঙ্গলে, সর্বনাশী, স্বামীখাকি হিসেবে চিহ্নিত হয়। তাকে ঘিরে ধরে আর্থিক সঙ্কট, প্রতিরক্ষাহীনতা, প্রতিবেশীর তীর্যক চাহুনি ও নানান সামাজিক সমস্যা। ঘরে-বাইরে তাকে নানারকমভাবে শারীরিক ও মানসিক হেনস্থার মুখোমুখি হতে হয়। শুরু হয় সামাজিক মাঙ্গলিক কাজকর্ম থেকে বহিস্কার, খাদ্যে-পোশাকে-জীবনধারণে নানান নিষেধাজ্ঞা। এরই পাশাপাশি জীবন-যৌবন-যৌনতাকেন্দ্রিক প্ররোচনা ও প্রলোভনের ভিড় তাকে বিপর্যস্ত করে তোলার চেষ্টা করে। এইসব পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে শেষমেশ একাই বাঁচতে হয় তাকে। এতকিছুর পরেও সন্তানদের দায় নিতে কখনও অস্বীকার করে না মেয়েরা। অধিকাংশই সন্তান-পালনের দায়িত্বের কথা মাথায় রেখে দ্বিতীয় বিবাহের পথেও যায় না, যদিও বিধবা বিবাহ আইনসঙ্গত। পারিবারিক সহায়তা, স্বামীর কর্মস্থলে কাজ, সরকারি বিধবা ভাতা তার আর্থিক দুরবস্থা রোধে সহায়ক হতে পারে। তবে সরকারি ভাতা পাওয়া বেশ কঠিন বিষয়। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কমবয়সী বিধবার পুণর্বিবাহ ও পুণর্বাসন তখনই সম্ভব, যখনই তাদের জীবনগত অভিজ্ঞতার নিরীখে সমাধানের পথ ভাবা হবে।
“ডাইনি– নারী নির্যাতনের প্রাচীন ও গ্রামীণ ক্ষত”
এখনও আমাদের সমাজে ডাইনি-প্রথা বিরোধী কোনো উপযুক্ত আইন চালু হলো না। যেখানে ডাইনি নির্যাতন ও হত্যার ঘটনার মতো কুসংস্কারগত বেআইনি প্রথার কারণে অনেক মানুষকেই মর্মান্তিকভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে। এবং সেসব মৃত্যু প্রত্যন্ত গ্রামে ঘটে বলে ঠিকঠাক খবর পাওয়া যায় না এবং সেই কারণে নথিভুক্ত করাও হয় না। তবে এইসব মৃত্যুর সিংহভাগই মহিলা। ওঝা, গুণীন, তান্ত্রিক, জানগুরু তথা সমাজের তথাকথিত মাতব্বররা ঘৃণ্য যোগসাজশে মানুষের অন্ধ-কুসংস্কারকে কাজে লাগিয়ে, চিরাচরিত অন্ধবিশ্বাসকে পাথেয় করে, সুচিকিৎসা ও বিজ্ঞানমনস্কতার অভাবকে অস্ত্র করে, শিক্ষার অপ্রতুলতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ডাইন বা ডাইনি চিহ্নিত করে। আর এর মূল উদ্দেশ্য হলো জোর করে অর্থ-জমি-সম্পত্তি লাভ করা, রাজনৈতিক মতলব চরিতার্থ করা, ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটানো ইত্যাদি। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ডাইনি নামক কুসংস্কারাচ্ছন্ন অপবাদটি এসে পড়ে কোনো-না-কোনো মহিলার ওপরেই। যে কোনও বয়সের নারীই এই কুসংস্কারের শিকার হতে পারেন। কিছু সুবিধাবাদী চালাক লোক সমাজে প্রশ্ন-তোলা, কথা বলতে পারা নারীদের দমিয়ে রাখার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এই ডাইনি-প্রথা বহাল রাখে। পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষ তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অপছন্দের যেকোনো নারীকে ডাইনি অপবাদে হত্যা করে। আসলে নারী নির্যাতনের এ এক প্রাচীন ও গ্রামীণ কুঅভ্যাস। এই জঘণ্য প্রথা গ্রামীণ সমাজ তথা বৃহত্তর নারী-উন্নয়নের অন্যতম বাধা। স্কুলপাঠ্যে স্থান দেওয়া ছাড়াও এই ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক প্রচার দরকার। এই প্রথা রোধে কঠোর আইন প্রনয়ণ জরুরী। তবেই সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ প্রথার মতো এই কুপ্রথাও রোধ ও বিলুপ্ত করা সম্ভব হবে।