।। স্বাধীনতার প্রাক্বালে ।। কলমে : সাহানা
।। স্বাধীনতার প্রাক্বালে ।।
কলমে : সাহানা
আলগোছে একটা চপ তুলে কামড় লাগাল সুস্মি। সুস্মি ওরফে শুভমিতা। আজ একটু অন্যমনস্ক। সদ্য কেনা ম্যাগাজিনটা পাশেই পড়ে আছে। স্কুল থেকে ফিরে চেঞ্জ করে এক চিলতে বারান্দায় বসেছিল সে। সূর্যের শেষ বেলার আলোতে বেশ লাগছিল বিকেলটা। ব্যাগ থেকে বইটা টেনে নিয়ে রেখেছিল। কিন্তু ঐটুকুই। বিভা কখন এসে চায়ের কাপ আর খাবারের ট্রে রেখে গেছে। খেয়ালই করেনি।
চুপচাপ বসেছিল অনেকক্ষণ।
শ্রাবণের শেষ। সন্ধ্যের মুখে একটা দমকা হাওয়ার ঝাপটা। বইটার পাতাগুলো উড়ছে।
হঠাৎই একটা পাতায় বড় ছবি আর লেখা।
খুব চেনা লাগছে না! ঐ মুখ আর হাসি! খুব কাছের।
ঝপাঝপ্ ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেল অনেকটা। কালো সাদা ছবির মত মুহূর্ত- এক এক করে আসছে।
ফাইন্যাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ, চাকরি জীবন শুরু হওয়ার পথে। কফিশপে একটা কর্ণার টেবলে গালে হাত দিয়ে বসে আছে সে। একটা সুন্দর পোলকা ডটের টপ আর ব্লু জিন্স পরেছে। আই লাইনার আর হালকা কমপ্যাক্ট ছাড়া কোনো প্রসাধন নেই। লিপস্টিক ও নয়। সব কিছু অশ্বিন- এর পছন্দমাফিক। অশ্বিন, ওর একমাত্র প্রাণের বন্ধু। ইউনিভার্সিটির টপ স্কোরার, এককথায় জিনিয়াস। শুরু থেকেই সুস্মি ওর ফ্যান্। একসঙ্গে ঘোরাঘুরি ওদের। অশ্বিনের ওঠা-বসা, চলাফেরা সবকিছুই তার প্রিয়। একান্ত কাছের মানুষ হওয়ার হয়ে ওঠার চেষ্টা চালায় নিরন্তর। ছায়াসঙ্গীর মত ঘনিষ্ঠ হতে চায় সে।
অশ্বিনের কোনো কাজ তার খারাপ লাগে না। ভাবতেই পারে না যে সে খারাপ কিছু করতে পারে! তাই বন্ধুত্বের সীমানা পেরিয়ে উপচে পড়ে প্রেম। সে প্রেমে কোনো দ্বিধার অবকাশ নেই।
‘বন্ধুত্বে শারীরিক সম্পর্ক আসবে কি?’ –একসময় কলেজ-ডিবেটে ঝড় তোলা ছাত্রী শুভমিতার মেন পয়েন্ট ছিল প্লেটোনিক প্রেম। নির্ভেজাল, নিষ্কাম সুন্দর সম্পর্ক। কিন্তু নিজের জীবনে এই ভাবনার সযত্ল লালন-পালন করল কই! পারল করতে?
এক সন্ধ্যেয় অশ্বিনের পি. জি. থাকা ফ্ল্যাটে গিয়েছিল সে। বাইরে ঝড় বৃষ্টি। মুখোমুখি বসেও কথা আটকাচ্ছিল বারবার। কি যেন হয়েছিল! সব বাধা বিঘ্ন সেদিন যেন তুচ্ছ মনে হয়েছিল।
☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆
কফিশপে অপেক্ষা করছিল অশ্বিনের জন্য । ভেবেই এসেছিল একসঙ্গে থাকতে বলবে। ওকে ছেড়ে থাকতে পারছে না এক মুহূর্ত-ও। স্থায়ী সম্পর্ক আবার অশ্বিনের অপছন্দ! -লিভ-টুগেদার ইজ কমন ইন দিস জেনারেশন। ইচ্ছে করলে থাকতেও পারো আবার যেতেও পারো। কোনো বন্ধন নেই। বোঝাতে হবে ওকে।
ঘড়ির দিকে তাকাল সুস্মি। কতক্ষণ বসে আছে! সময় তো জানিয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপে।
নাহ্ আর নয়।
অধৈর্য হয়ে বেরিয়ে চলে এল অটো স্ট্যান্ডে। সোজা অশ্বিনের বাড়ি। ভাড়া মিটিয়ে ঢুকতে যাবে। হঠাৎই ফ্রেমে আটকানো ছবির মত স্থির হয়ে গেল সে। অশ্বিনের সঙ্গে ওর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসছে ট্রিংকা —ওদেরই বন্ধু। দুজনের হাতই একে অপরের কোমর জড়িয়ে আছে। ঘনিষ্ঠতাতেই বোঝা যাচ্ছে বন্ধ দরজার আড়ালে কি চলছিল। খুব তাড়াতাড়িই সরে আসে সুস্মি। রাস্তায় নেমে এলোমেলো হাঁটে।
একদল কুকুর মারামারি করছে। সঙ্গিনীকে কাছে পাবার জন্য। সুস্মির এই জীবনটা ঘৃণ্য মনে হল। কুকুর সমাজে যেমন যৌনতার বাছবিচার নেই, তাদের জেনারেশন ও সেইরকম। লাইফ পার্টনার দরকার নেই। লিভিং পার্টনার চাই। এত খিদে মানুষের! চোখের জলে সবকিছু ঝাপসা। মুচড়ে ওঠে শরীর অব্যক্ত যন্ত্রণায়।
সারা রাত খোলা জানালার পাশে বসে থাকে সে। মা দু’বার দেখে গেছে।
বাবাও।
-কি রে শুয়ে পড়লি না?
-হ্যাঁ এইবার পড়ব।
কিন্তু ঘুম আসেনি।
☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆
গত দশ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে শুভমিতার। স্কুলে চাকরি নিয়ে চলে এসেছিল উত্তরবঙ্গে, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার দু’মাসের মধ্যেই। বাবা-মা ছাড়া আর কোনো পিছুটান না রেখে।
আজ একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ফোটো ফিচারে অশ্বিনের হাসিমুখ দেখে কৌতুহল হয়। পরে পড়বে বলে ব্যাগে রাখে। কিন্তু এখন ইচ্ছে করছে না জানতে।
যে রাতে তার জীবন তুচ্ছ মনে হয়েছিল, সে রাত ছিল স্বাধীনতার আগের দিন। ভোরের আলো ফুটতেই সে মুক্ত হাওয়ার স্পর্শ পেয়েছিল। সে হাওয়া গ্লানি-মুক্ত জীবনের, স্বাবলম্বী হওয়ার আশ্বাস বয়ে এনেছিল। আজও এই বিশেষ দিনটি সে পালন করে, সযত্নে। প্রতি বছর স্বাধীনতার সূর্য তার কপালে রাঙা তিলক আঁকে — এ যেন নিজের কাছে নিজের অঙ্গীকার –শুদ্ধতার শপথ।
▪︎▪︎▪︎▪︎▪︎▪︎▪︎▪︎▪︎▪︎▪︎▪︎▪︎▪︎▪︎
বৃষ্টিটা ঝেঁপে এল। বারান্দা ভিজে যাচ্ছে। শাড়ির পাড়ে বৃষ্টির ছাঁট। নিজের ভাবনায় ডুবে বসেই থাকে। ভিজতে ভাল লাগছে আজ।