ফুরিয়ে যাওয়া, দেবযানী ঘোষাল

ফুরিয়ে যাওয়া

দেবযানী ঘোষাল

অকারন অপবাদ যখন কৈশোরকে জেদি করে তুলেছিল,
একান্নবর্তী পরিবারকে তুচ্ছ করে,
এমনকি বাবা মার প্রতি অভিমানে ঘর ছাড়া হয়েছিল সে কৈশোর।
জানতো আত্মসম্মানের চেয়ে বড় কিছুই নয়।
ভিটে মাটি ছেড়ে ও বাংলা ছেড়ে এ বাংলায় যখন এসেছিল ছেলেটি, জানতো না ভবিষ্যত।
তখন সে কেবল নবম শ্রেণীর ছাত্র।
একচিলতে সিঁড়ির ঘরে ঠাঁই পেয়েছিল থাকবার।
কাজ পেয়েছিল একটি প্রাইভেট কম্পানিতে।
চাকরি করতে করতেই পড়াশুনাটা চালিয়ে গেছিল।
শেষ করেছিল পি. উ. পাশ।
শেষ করেছিল বি.কম টাও।
কিভাবে যেন খবর পেয়েছিল ছেলেটির এক মায়ের পেটের ভাই বোনেরা।
একে একে আসতে লাগলো ও বাংলা থেকে এ বাংলার সেই এক চিলতে ভাড়া ঘরটাতে।
কখনো অনাদর করেনি পোড় খাওয়া মেজদা।
বড়দার দয়ায় একটি আবাসনের দুকামড়ার ঘর জুটেছিল।
একটু ভাল থাকার আশায় সবাইকে নিয়ে ঘর বাঁধলো সেখানে।
নির্ভর ঐ মেজদা পাঁচটি ভাইবোনের জন্য।
” এখন নিজেদের রাস্তা দেখো ”
বড়দার এই হুমকি ভীষণ আঘাত পেল নরম মনের মেজদার।
ঘর ভাড়া নিয়ে সবাইকে নিয়ে চলে গেল দুকামরা এক বারান্দা বারো ঘর এক উঠোনে।
খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে সাত পাক ঘুরেছিল শর্তাধিনে।
স্বামী স্ত্রী দুজনেই দুজনের পরিবারকে আগলে রাখবে।
আবাসনে থাকতেই একটি মেয়ের জন্ম দিয়েছিল মেজদা।
সেখানে অনাদরে অবহেলায় কাটিয়েছিল ফুটফুটে মেয়েটি মাত্র তিনমাস।
অনেক পিসি কাকুরা থাকলেও আদর পাবার যোগ্যি সে নয়।
তিনমাস পর ঐ ভাড়াবাড়িতে আসার পর ভালই কাটছিল সুখে দুখে।
সরকারী চাকরিরতা মায়ের সিফ্টিং ডিউটি, বাবার ওভারটাইমের মধ্যেই বছর চারেক বয়েস যখন তখন একটি বোন হল তার।
জামা কাপড় রাখার অসুবিধা।
কি আনন্দই না পেয়েছিল মেয়েটি যেদিন প্রথম স্টিলের আলমারিটা ওর বাবা মা অর্ডার দিয়ে আনলো।
মনে হচ্ছিল ওরা এখন অনেক বিত্তবান।
মেয়েটি যখন ক্লাশ টু, বাবার পাকস্থলিতে আলসার ধরা পরলো।
নার্সিংহোমে ভর্তি এক মাসেরও বেশী।
বাবা অন্ত প্রাণ মেয়েটি রোজ কাঁদে বাবার জন্য।
মাকে বলতো, মা মা বাবা কবে আসবে?
হসপিটাল মানেই ভয় পেত মেয়েটি।
ভাবতো আর বুঝি ফিরবে না বাবা।
যেদিন ফিরলো খুব আনন্দ।
কিন্তু বাবা হাঁটতে পারছে না ভাল করে।
কথা বলছে আস্তে আস্তে।
খুব দুর্বল।
আস্তে আস্তে ঠিক হল।
আবার অফিস।
শুনলাম কাছাকাছি কোথায় জমি কিনবে।
এত একটা ছোট ঘরে এতজন সত্যিই খুব অসুবিধা।
কাছাকাছি নতুন একটা আবাসনে ওরা চলে গেল।
সরকারি আবাসন।
তখন পিসিরা কাকুরা ঠাকুমা ঠাকুরদাদা যে যার আস্তানা ঠিক করে নিয়েছে।
আবাসনে আসার পর মেয়েটির মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এক মাস।
বাবাই তখন বাবা আর মা।
মা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর থেকেই নিজের মত করে একটা মাথার ছাদ করার জন্য মেয়েটির বাবা উঠে পড়ে লাগলো।
আর কতকাল ভাড়া গুনবে!
একদিন সত্যিই নিজের একটা মনের মত বাড়ি করলো মেয়েটির বাবা।
মেয়েদের বিয়ে দিল।
মা চলে গেল সব কর্তব্য করে দিয়ে।
যাবার সময় হয়নি, তবু চলে গেল।
মেয়েটির বাবা মনে প্রানে খুব ভেঙে পড়লো।
শরীর ভাঙতে ভাঙতে আজ স্ত্রী হারা বছর কুড়ি।
তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসার।
সবই যেন হাতছাড়া আজ।
সকলে তো পারে না এমন করে আস্তানা গড়তে।
এতগুলো পেটের একমাত্র সম্বল হয়ে!
একটু একটু করে জমানো পয়সায় তৈরী বাড়িখানা কে সবাই জানতো মেজদার বাড়ি।
বিপদে আপদে কত আত্মীয় অনাত্মীয়র পাশে ছিল মেজদা।
আর আজ শরীরটা অক্ষম। তাই মেয়েদের কাছে থাকতে মন মানছে না কিছুতেই।
বাড়ে বাড়ে মন কেঁদে ওঠে।
আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি।
আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি।

দেবযানী ঘোষাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *