#একটি মিষ্টি প্রেমের গল্প : গল্পের নাম : চেকমেট ___ মালা মুখোপাধ্যায়
#একটি মিষ্টি প্রেমের গল্প :
গল্পের নাম : চেকমেট
মালা মুখোপাধ্যায়
ঐযে ঐযে একটা ঢেউ আসছে। কী আনন্দ কী আনন্দ! বিস্তৃর্ণ জলরাশি, নীল নীল দীগন্ত, এসে গেল, এইযে আমাকে ঢেউটা তুলে দিল,আহা! কি হালকা লাগছে, লাফিয়ে লাফিয়ে ঢেউ পার করার আনন্দই আলাদা,মনে হয় চাঁদে আছি, ভারি শরীর কী সুন্দর হালকা ওজনহীন হয়ে যায় নিমেষেই,পালকের মতো,এই ঢেউটা আমাকে পার হয়ে একেবারে ধারে গিয়ে ভাঙলো, আবার ফিরে আসছে,সব জল পা থেকে ঘুরে আবার পিছিয়ে যায়, আবার আসছেএএএ,মাআআআআ,যেও না,সরে এসো। ডুবে যাবে,হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওখানে থাকো, ওরে বাপরে আর একটা আসছে , ওহ্ কি হলো? আমার লাফিয়ে ওঠার আগেই ঢেউ ভেঙে গেল, আমি তো জলের ভিতরে ডুবে গেলাম, আমি আর থা পাচ্ছি না তো, আমি সাঁতার কাটছি, কতক্ষণ আর থাকবো এই ভাবে? কয়েক সেকেন্ড তো কয়েক বছর মনে হয়, আমি কি মরে গেলাম? গোটা শরীরে বালি আর বালি,এহ,রে,কি চান হলো? আবার চান করতে হবে, এই , এই ,কে তুমি আমার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছো, আমার কোমর ধরে আমাকে উঠিয়ে দিলে ,সাহস তো কম নয়? অনেক লম্বা তুমি, শক্তিশালী,তা না হলে আমাকে জল থেকে তুলে ফেললে? মনে মনে ভাবে , তোমার হাত কিন্তু খুব ভদ্র, ঐরকম জলের স্রোতে শুধুই আমার কোমর জড়িয়ে ধরে তুলেছে, কোথাও হাত টেকেনি,ঠেকতেই পারতো, আমি ভাবতাম বাঁচাতে গিয়ে ঠেকে গেছে,ওওওও, তেমন কিছু না, মনে রাখার মতো নয়, কিন্তু না, ওখানেই তো তোমাকে আমি স্যালুট করেছি, কিছুক্ষণ পরে জল নেমে গেল, আমার জলও বেরিয়ে গেল,আর নয়,আর কোনোদিন সাগরের ঢেউ নিয়ে খেলা করবো না, খুব শিক্ষা হয়ে গেল, কিন্তু চোখ দুটো খুব চেনা চেনা লাগছে যেন।
–কি রে? পাগলী? পাগলটাকে চিনতে পারলি না ? কাল থেকেই তো তোকে সারাক্ষণ দেখে চলেছি, শুধু সঙ্গে কাকিমাকে নিয়ে এলি ? সামলাতে পারবি তো? ভাগ্যিস আমি এসেছি, তবে কবে এলি?
একটু বাঁচিয়েছে বলে কত কথা, তবুও হেসে বললাম,কালকে তো।
–আচ্ছা। আমিও কালকে এসেছি। তবে বেড়াতে নয়। চাকরির জায়গা।
—চাকরি ? এখানে ?
—কেন নয়?
–সেই রঘুনাথপুর থেকে পুরিতে?
–হা হা হা হা। তাহলে চিনতে পেরেছিস ? ন্যাকামো করছিলি?
—মোটেও নয়। কতবড় হয়ে গেছিস।গলার শব্দে বুঝতে পারলাম। ঐ যে পাগলী বললি। এতোদিন ধরে কোথায় ছিলিস? সেই যে বক্রেশ্বর চলে গেলি আর তো যোগাযোগ রাখলি না।
–বস্ ; লেখাপড়া করতে হয়। তা না হলে কোনো পাগলীকে ঘাড়ে টানবো কি করে?
— কোনো পাগলী? মানে টা কি? অনেক পাগলী আছে ?
–হা হা হা হা,চটছিস কেন ? যে আসবে সে পাগলী ,তবে জোটেনি রে এখনও!
—আমি তো সাঁওতাল ডি তে এইচ এস দিয়ে কলকাতায় চলে আসি।
—টেকনোতে, সফটওয়্যার।
–সব জানিস?
–সব। কাকু মারা গেলেন,তোর চাকরির খবর শোনার পর।
—একদম। বাবা আমার মাইনের টাকা দেখে যেতে পারলো না, খুব আফসোস হয়। বাবাকে একটা বড় প্যাকেটে সন্দেশ এনে হাতে দিয়ে বলতাম,খাও,খাও বাবা, তোমার মেয়ের টাকা। হলো না রে। শেষের দিকে গলাটা ধরে যায় রুমুর।
–স্বাভাবিক। বাবা খুব নাম করে তোদের।
—তাই ? কাকু কি বলেন?
—বলে, পাগলীটা খুব ভালো।
–বানাচ্ছিস কিন্তু।
–নারে, বিশ্বাস কর। তা বিয়ের নিমন্ত্রণ কবে পাবো?
–বিয়ে ? পাগল নাকি? বেশ আছি মা আর মেয়েতে।
–আমিও বেশ আছি। এক পাগলীকে নিয়ে।
–তাই? লিভটুগেদার? বিয়েতে নিমন্ত্রণ করবি কিন্তু।
—সিওর।
—লাল বেনারসি শাড়ি পরে আসবি কিন্তু।
–পাগল একটা। আমি কেন আসবো? আমি সাদা লেহেঙ্গা পরে আসবো, সাদা পাথরের।
—সাদা !!
–ওই, হাঁদু, আদ্যিকালের মতো এখন আর কেউ শাড়ি পরে বিয়ে বাড়ি আসে না। সরে আয়,আর একটা ঢেউ আসছে এদিকে।
—একি? রুমু? এতো মাথা পর্যন্ত ভিজলো কি করে? আমাকে ডাকিসনি কেন? ঘরে চল।
আর হ্যাঁ, সৌম্য তুমিও এসো আমাদের লজে সন্ধ্যায়।
—মাআআআ, তুমি চিনতে পেরেছো? সৌম্যকে, সেই পাগলটাকে।
—সেই সরস্বতী পুজোর দিন তোদের সঙ্গে সৌম্য দের কী ঝগড়া! দুই দলের ঠাকুর একসঙ্গে ফার্স্ট হয়েছিল,মনে থাকবে না?
একসঙ্গে সৌম্য আর রুমু হেসে ওঠে। ওদের চোখে চোখে কত কথা মনে পড়ে যায়।
সবে মাত্র নাইনে পড়ি,আর তুই স্কুলের সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেলের পিছনে একটা গোলাপ 🌹 এনে আমার লম্বা চুলে গুঁজে দিয়ে চোখ বুঁজতে বললি। আমার সব মনে আছে সৌম্য। সব। তারপর তোরা বদলী হয়ে চলে গেলি,আর যোগাযোগ রাখলি না। কত কত জন এলো, কিন্তু তোকে ভুলতে পারলাম কই ? কিন্তু তোকে আমি সেকথা কিছুতেই বলব না। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতাম অনেকক্ষণ ধরে,দেখতে পেতাম তোর হাত আমার চুলে,একটা গোলাপ,জানিস না তো, সেই গোলাপটা আজও আমার জীবনানন্দ দাশের কবিতার বই -এর ভিতর রাখা আছে। আর তোর দুটো হাত, নাহ্,থাক,আর ভেবে কি হবে?
—তুই সিফনের পাতলা নীল শাড়ি পরেছিলি।
ঐ বয়সে আমিই তোকে দেখে যেন কিশোর থেকে উত্তরণের দিকে গেলাম। খুব ভয়ে ভয়ে তোর চুলে গোলাপ দিলাম,তোর সম্মতি ছিল চোখের পাতায়,নরম গালে, পাতলা ঠোঁটে। চোখ বুঁজে আমার সামনে দাঁড়িয়ে তুই, তোর ঠোঁট দুটো বাঁশের পাতার মতো তির তির করে কাঁপছিলো। আমার দুটো হাত শুধু তোর গাল ছুঁয়ে ছিল। ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে পারিনি। এখনও, একলা হলে ঐ ছবিটাই দেখতে পাইরে, আমার চালিকা শক্তি, আমার প্রেরণা। তোকে তো ভুলেও বলা যাবে না, তাহলে আমার লেখাপড়া চাকরির ক্রেডিট সব তুই
নিবি,অতটা বোকা আমি নই।
আবার একটা ঢেউ এসে সৌম্য আর রুমু কে ভিজিয়ে দেয়।
–কি এতো ভাবছিস তোরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? অসুখ করবে তো। সৌম্য তোমার মা বাবাকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসো। একটা ‘দিন’ দেখতে হবে। আর দেরি করতে চাই না। এখন জোয়ারের সময়। সাবধান।
সমুদ্রের জল ফুলে ফেঁপে উঠছে, এগিয়ে আসছে,বড় বড় ঢেউ আসছে, কত কী যে বার্তা নিয়ে আসছে আনন্দে,কত কত কথা সেই তরঙ্গে ভেসে আসে, সেই ছোটতে সৌম্য আর রুমুর ঠাকুর একসঙ্গে ফার্স্ট করে দেয় দুই বাড়ির বাবা মা, সেই স্কুলের সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেলের পিছনে দুটি সদ্য ফোঁটা ফুলের মতো কিশোর কিশোরী, এতোদিন ধরে মনের মধ্যে রাখা সব গোপন চিঠির কথা,মাঝে না দেখা,বিরহে খুঁজে চলা, সব যেন মুক্তোর হারের মতো সাজানো।
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলেও রুমুর মায়ের কানে পৌঁছে যায়,
সৌম্য বলছে খুব ফিসফিস করে রুমুর কানের কাছে, পাগলী,হা হা হা হা , চেকমেট।
সকালের সদ্য ফোটা ফুলের মতো হাসি হাসি মুখ নিয়ে রুমু ভ্রু তুলে চোখের চাহনিতে খুশির জোয়ার ধরে রাখে। আর ভাবে, এই ভাবে হারতেও সুখ আছে রে পাগল।
মালা মুখোপাধ্যায়