বৌদি… ( দ্বিতীয় পর্ব ) ✍️ তাপস

বৌদি… ( দ্বিতীয় পর্ব )

✍️ তাপস

জানি অনেকে মনে করছেন ধান ভাঙতে শিবের গীত গাইছে, কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। কিন্তু মাটি না বুঝলে, চারাগাছটির পরিচয় বোঝা মুশকিল, তাই এই উপস্থাপনা। জ্ঞানদানন্দিনী প্রসঙ্গে ঢোকার আগে তাই এই শিবের গীত।
এবার আবার অন্দরমহলে ঢুকি ঠাকুরবাড়ির। প্রিন্স দ্বারকানাথ স্ত্রী দিগম্বরী দেবী, লোকে বলত সাক্ষাৎ জগদম্বা। তখনকার দিনে এঁনারা ছিলেন ঘোর বৈষ্ণব। পেঁয়াজ পর্যন্ত ঢুকতো না বাড়িতে। মাছ-মাংসের তো প্রশ্নই উঠে না। তরকারি কোটা শব্দটা পর্যন্ত ব্যবহার হত না, বলা হতো তরকারি বানানো। তরকারি কোটা শব্দটা খানিক হিংস্র কিনা!! বাড়িতে প্রতিষ্টিত লক্ষ্মী জনার্দনের নিত্য পূজা করতেন দ্বারকানাথ ঠাকুর স্বয়ং। প্রখ্যাত সুন্দরী দিগম্বরী দেবীর হাতে হাতে সাহায্য করতেন পুজোর উপকরণ জুগিয়ে। একেবারে রাজযোটক জুটি। কিন্তু বিধাতা বোধহয় অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। হঠাৎ ব্যবসায়িক সাফল্য পেতে শুরু করলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। সাহেব সুবোদের সাথে মেলামেশা শুরু হলো। বিধর্মীদের সংস্পর্শে আসলে দেহ অপবিত্র হয় – হিন্দু ধর্মের এই অনুশাসন মেনে নিত্য পূজা ছাড়লেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। আঠেরো জন শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণকে নিযুক্ত করা হলো নিত্যপূজার জন্য। দুটো ভিন্ন খাতে বইতে থাকলো দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং দিগম্বরী দেবীর জীবন। ব্যবসায়িক সাফল্যের সাথে সাথে বিলাসিতা আর বাবুয়ানির বেশবাস ধারণ করলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। প্রথম প্রথম হয়ত দ্বারকানাথ ঠাকুরের কিছু সংশয় ছিল এই ধরনের মেলামেশাতে। কিন্তু দ্রুতই সেই সংশয় কেটে বাবুয়ানায় সম্পূর্ণ গা ঢেলে দেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। আঠারোশো তেইশ সালে তৈরি হলো বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি, তখন দ্বারকানাথ গভর্মেন্টের দেওয়ান, বিস্তর ক্ষমতাবান পুরুষ। সেই বাড়ির মধ্যে কি ছিল না ?? ফোয়ারা, ঝাড়লন্ঠন, বিলিতি আসবাবে মোড়া এক অনবদ্য রুচিশীল বাগানবাড়ি, যে বাগানবাড়ির কথা লেখা হয়েছিল তৎকালীন কাগজে পর্যন্ত।
অপরদিকে দিগম্বরী দেবী ডুবে আছেন ধর্মে-কর্মে। ভোর চারটে থেকে পূজা পাঠ শুরু। সারাদিন শুধু পূজা পাঠ, ধর্ম গ্রন্থ শোনা। স্ব-পাক আহার, একাদশী তিথিতে শুধু ফলমূল। সদ্য বিয়ে হয়েছে বড় ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। যশোরের দক্ষিণডিহি থেকে এসেছেন বৌ সারদা, তখন সারদা দেবীর বয়স মাত্র ছয়।
মাঝে মাঝে খবর পান দ্বারকানাথ ঠাকুরের। অনেক ব্যাকাচোরা দুর্নাম, গায়ে মাখেন না দিগম্বরী দেবী। শেষে সবই শুনলেন দিগম্বরী দেবী।
বাগবাজারের রূপচাঁদ পক্ষী গান বেঁধেছেন ঠাকুরবাড়িকে নিয়ে

কি মজা আছে রে লাল জলে,
জানেন ঠাকুর কোম্পানি।
মদের গুনাগুন আমরা কি জানি,
জানেন ঠাকুর কোম্পানি।

প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেন নি, সংশয়ে ছিলেন। তবু নিঃসংশয় হওয়ার জন্য, স্থির করলেন যাবেন ওই ম্লেচ্ছ ভোজসভায়, সঙ্গিনী হলেন পুত্রবধূ সারদা। একেই বোধহয় আজকালকার দিনে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বলে।
কি দেখেছিলেন দিগম্বরী দেবী?? ইতিহাস সেখানে আশ্চর্য নীরব, তথাপি কল্পনা করতে পারি সেই অসামান্য মুহূর্তকে। রাত্রি তখন
মধ্যযামিনী। ফুর্তি তুঙ্গে, পানাহার চলছে। আলোকোজ্জ্বল সেই ঘরে হাতে শেরি গ্লাস নিয়ে দ্বারকানাথ ঠাকুর। মুসলিম বাবুর্চি পরিবেশন করছে মাংস। দ্বারকানাথ কে ঘিরে বসে আছে সাহেব-বিবির দল। দুঃখে আতঙ্কে বিস্ফোরিত হলো দিগম্বরী দেবীর চোখ মুখ।
সারারাস্তা কি কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছিলেন দিগম্বরী দেবী? ইতিহাস নিশ্চুপ, আমরা জানি না এই অসামান্য ব্যক্তিত্বময়ী নারী কি করেছিলেন সেই রাত্রে। তবে তারপরও চেষ্টা করেছিলেন স্বামীকে ফিরিয়ে আনার, কর্ণপাত করেননি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, ততদিনে তিনি প্রিন্স আখ্যা পেয়েছেন সমাজে। ক্ষমতা আর অর্থের লোভ বিচ্ছিন্ন করে দিল দিগম্বরী দেবী আর দ্বারকানাথ ঠাকুরকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ঘটনাটি মা অলকানন্দার মৃত্যুর পরে ঘটে। মা জীবিত থাকাকালীন দ্বারকানাথ ঠাকুর কোন বিজাতীয় খাবার স্পর্শ করেনি।
তৎকালীন বাবুয়ানি যুগে, যখন মেয়েদের স্বামী ছাড়া গতি নাই, স্বামীর অন্নে প্রতিপালিত নারী , সেখানে অন্য মেয়ে হলে শুধুই কেঁদেকেটে ভাসাতো। কিন্তু দিগম্বরী দেবী অন্য জাতের মানুষ। তিনি তৎকালীন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের ডেকে পাঠালেন। জিজ্ঞাসা করলেন স্বামীকে ত্যাগ করে কুলধর্ম বজায় রাখবেন নাকি স্বামীর সহধর্মী হয়ে কুলধর্ম ত্যাগ করবেন। দ্বারকানাথ অবশ্য ধর্মত্যাগী হন নি, কিন্তু ম্লেচ্ছদের সাথে যে বসে একসাথে খাবার খায়, তার ধর্ম ত্যাগের বাকি বা কি রইল?? কিন্তু মাথায় রাখতে হবে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর একজন অত্যন্ত ক্ষমতাবান মানুষ ছিলেন, তার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে কোনো রায় দেওয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের ক্ষেত্রেও অসুবিধাজনক ছিল। বিস্তর তর্ক বিতর্ক হল।
যে রায় তাঁরা দিলেন তা মোটামুটি ধরি মাছ না ছুঁই পানি। স্বামীকে ভক্তি সেবা করা কর্তব্য, কিন্তু তার সাথে একত্রে সহবাস কার্য অকর্তব্য। পণ্ডিতদের রায় মেনে নিলেন দিগম্বরী দেবী। স্বামীর সেবা বাদ দিয়ে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলেন দ্বারকানাথের সাথে। আশ্চর্যজনকভাবে নির্লিপ্ত রইলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। বাড়ির দক্ষিনে একটা বাবুর্চিখানা তৈরি হলো, দ্বারকানাথ থাকতে লাগলেন বৈঠকখানাতে। কোন প্রয়োজনে দরকার হলে দিগম্বরী যখন তার স্বামীর সাথে কথা বলতে যেতেন বা যেতে বাধ্য হতেন, তখনই সাতঘরা গঙ্গা জলে স্নান করে শুদ্ধ হতেন। সেই স্নানের দিন রাত্রির বিচার ছিল না। অচিরেই অসুস্থতা গ্রাস করল দিগম্বরী দেবীকে। মাত্র ছয় বছর বয়সে যে দিগম্বরী ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের প্রবেশ করেছিলেন লক্ষ্মী রূপে, তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল অবহেলায় অযত্নে। দ্বারকানাথও কি বুঝতে পারেননি যে কি ক্ষতি হয়ে গেল ?? হয়তো বুঝেছিলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই দিগম্বরী দেবীর মৃত্যুর সামান্য কিছুদিন পরে দ্বারকানাথের একটি একটি জাহাজ যখন সমুদ্রে ডুবে গেল, চরম হতাশায় দ্বারকানাথ ঠাকুর বলে উঠলেন – লক্ষ্মী চলিয়া গিয়াছে, অলক্ষ্মীকে এখন ঠেকাবে কে??….

(চলবে )

✍️ তাপস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *