স্ট্রেঞ্জার / প্রদীপ ঘোষ।:

স্ট্রেঞ্জার / প্রদীপ ঘোষ।:

দীর্ঘ তিরিশ বছর বাদে দেশে ফেরা। সত্তরের দশকের উত্তাল সময়, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রিধারী, বাড়ি থেকে ধরাধরি করে চাকরি গছিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন। পরিবারের লোকজন তো বটেই মায় আত্মীয় স্বজনেরাও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।

…….জানলার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো চোখে পড়ায় ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো, বেশ অস্বস্তিকর ছিল ব্যাপারটা। সমস্ত শরীর জুড়ে একটা ম্যাজ্ম্যাজে ভাব, জেটল্যাগ না কাটায় শুয়ে ছিলাম। এর মধ্যে সদর দরজায় টোকা পড়তে…. নীচের ঘরে আছি তাই না উঠে আর উপায় রইলনা। ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

” আজ্ঞে আজকের খবরের কাগজটা, আর যদি গত মাসের টাকাটা দিতেন আরকি ” কথাগুলো যে এগিয়ে দিল খবরের কাগজ আর বিলের সঙ্গে, সে ঘাড় ঈষৎ নিচু করে রাখায় মুখটা আমার ততটা দৃশ্যমান হল না।

কাউকে আর ডাকা ডাকি না করে ড্রয়ার থেকে পার্সটা বার করে দুটো একশ টাকার নোট দিতে সে আমায় ব্যলান্স ফেরত দিল, এই নিন। এতক্ষণে তার মুখাবয়ব আমার কাছে স্পষ্ট হল আর চোখাচোখিও, তক্ষুণি আমার শিরদাঁড়া দিয়ে বিদ্যুতের ঝলকানি ঘাড় থেকে কোমরের দিকে নিমেষে আমাকে অবশ করে নেবে গেল। “একি দেখলাম ” !

” আপনি মানে তুই কামু না !”

” হুমম্ চলিরে বিশু, মানে বিশ্বজিৎ বাবু। আপনি দেশে ফিরছেন এখবরটা আমি অবশ্য আগেই পেয়েছিলাম। চিনতে পেরেছেন, ভালো লাগলো। আমার একটু তাড়া আছে পনেরোটা বাড়ি সেরে এসেছি এখনও গোটা কুড়ি বাকি “।

উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সে এগিয়ে চলেছে, হাতে
খবরের কাগজের বান্ডিল। স্কুলবেলায় আমরা যেভাবে বই নিয়ে যেতাম। সামান্য ন্যুব্জ হলেও মাথা কিন্তু উঁচু, চলনে একই রকম দৃঢ়তা, ঋজুতা। পরনে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা, সদ্য যুবাবস্থা থেকেই এক ড্রেস। এস ওয়াজেদ আলীর সেই ট্র্যাডিশনের জীবন্ত প্রতিমূর্তি !

…….যতদূর দৃষ্টি যায় নির্নিমেষ দেখতে থাকলাম, রাস্তার বাঁক পর্যন্ত। জীবনের বাঁক নেয়া আরও এক মজে যাওয়া সরস্বতী নদীকে। কিছু কিছু ব্যাক্তি আছেন দেখলেই মনে হয় জ্ঞান ঋক্ষ। তাঁদের উপস্থিতিতে দৃশ্যত কেমন একটা জ্যোতির বিভা উপলব্ধ হয়। পরিভাষায় যাকে গ্লো বলে। দারিদ্র্যের নির্ঝরেও আজ সেটা কামুকে দেখে সম্যক উপলব্ধি।

কমলেশ বসু, বোস বাড়ীর মেজোছেলে আমাদের স্কুলের ব্রিলিয়ান্ট বয়, লেখাপড়ায় খেলাধুলায় ওর সমকক্ষ আমারা কেউ ছিলাম না । শুধু কি তাই! পাড়ার ক্লাব-ব্যাণ্ডের ওই ছিল সর্বেসর্বা, মধ্যমণি। বিগড্রাম বাজিয়ে লিড দিতো। দ্রিমিকি দ্রিম দ্রিম। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, প্রভাত ফেরিতে আমাদের সকলের ক্যাটেল ড্রাম বা স্নেয়ার সাইড ড্রামে অংশগ্রহণ, ওরই উদ্দীপনায়। দু’টো সরুসরু ড্রামস্টিকে তোলা গদ। ট্রটরা ট্রেটের টট্র টাই, ট্রটরা ট্রেটের টট্র টাই, টাই টাই। আমাদের তখন ধুম পড়ে গিয়েছিল। স্কুল পড়াশোনাটুকু বাদে আর অন্য কোনো খেলাধুলা নেই। সুযোগ পেলেই দু’টো কাঠি নিয়ে এমনকি পাড়ার রক দেয়ালে পর্যন্ত ওই ধুন ঝালিয়ে নেয়া। হা হা হা হা হা হা হা

ওর লেখার হাতটাও ভীষণই ভালো ছিল, সে সময়ে পার্টির উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। শহরের বিভিন্ন মঞ্চে বামপন্থার সপক্ষে, উপযোগিতা নিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ, ওফ্ সেসব কি দিন ছিলো, নামের সঙ্গে মিলিয়ে আমরা আদর করে কমলেশ কে ডাকাতাম কামু বলে। বন্ধুদের মধ্যে যেমন হয় আর কী।

ছোট বেলায় বাপ ঠাকুরদার মুখে কতবার যে শুনেছি
কথাটা, ” নিয়তি কে ন বাধ্যতে “। সত্যি-ই, হোয়াট ইজ টু হ্যাপেন উইল হ্যাপেন, তা নইলে আমার মতো মিডিওকর ছেলে যেখানে আজ একজন প্রতিষ্ঠিত ভদ্রলোক সেখানে কামুর মতো একটা ব্রিলিয়ান্ট ছেলের আজ সার্বিক নির্মম এই পরিণতি !

আমার জ্যাঠতুতো দিদিভাই বুবুদি এ তল্লাটে রীতিমতো ডাকসাইটে সুন্দরী। সে সময়ে একটা কথা ভীষণ চালু ছিল, যে মেয়ে যত বেশি সুন্দরী, মাথায় খাটো। আমি অবশ্য একথার সপক্ষে কোন যুক্তি খুঁজে পেতাম না। এই বুবুদি-ই তো কত মেধাবী ছিল।

সে যা হোক। বুবুদিও যে প্রথম থেকেই রাজনৈতিক ভাবে আমাদের মতোই খুব সচেতন ছিলো তেমনটা নয়। কিন্তু কামুর ব্যক্তিত্ব-ই যে ওকে অনুরক্ত করে তুলেছিল তা আমি বিলক্ষণ জানি। আমরা সকলেই দু’এক বছরের এদিক ওদিক। আমার নিজের দিদি, তাই আমি বুবুদি-ই বলতাম। কামু অবশ্য বুবু বলেই ডাকতো।

পার্টির বিভিন্ন কার্যকলাপে দুজনেই যুক্ত থাকাতে ওদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। অবশ্যম্ভাবী তা নেহাত তখন শুধুই পরস্পরের কমরেড অভিবাদন নয়, ভালোবাসায় পর্যবসিত। এই নিয়ে অবশ্য আমাদের বাড়িতে তুলকালাম কম হয়নি। ষড়যন্ত্র, ভার্চুয়ালি ভাগ্যের কারণে অবশ্য বছর খানেকের মধ্যেই সে ঝঞ্ঝাট চুকেবুকে গেছিলো।

কামুর নামে ওয়ারেন্ট তো আগে থেকেই ছিলো আন্ডারগ্রাউন্ড থাকার কারণে পুলিশের নাগালের বাইরে ছিলো এই যা। কিন্তু সে রাতে জাল ফেলে পুলিশ কামুকে গ্রেফতার করে। পরে অবশ্য জেনেছি এতে আমার জ্যাঠামশাইয়ের প্রত্যক্ষ হাত ছিলো। শুধু তাই নয় আমার চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাওয়া; দিল্লির সিআর পার্কের কোনো এক পাল্টি বর্ধিষ্ণু পরিবারে বুবুদির উচ্চপদস্থ আমলার সঙ্গে বিয়ের সম্পাদনা ইত্যাদি কি নিখুঁত ভাবেই না করেছিলেন।

…….তখন ক্লাস টেন, পতাকা উত্তোলনের দিন হেডস্যার সব্বাইকে লজেন্স দিতে দিতে কামুর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ” কামু তোমার নামে আরও একজন এই পৃথিবীতে ছিলেন, তুমি কি জানো ? ”

আমাদের জানা ছিল না কিন্তু কামু তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে বললো “হুমম্”, স্যার বললেন “কে বলো তো ?” কামু বলেছিল ফরাসি লেখক আলজিরিয়া জন্মে ছিলেন আলবেয়ার কামু ওর লেখা শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের নাম লেত্রঁজে, আউটসাইডার, দ্য ‘স্ট্রেন্জার’। স্যারের চোখ গোলগোল। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলেছিলেন খুব বড় হও।

বড় হতে না পারলেও আমার কাছে কামু-ই সেই স্ট্রেন্জার। চোখের জল কেন যে বাঁধ মানছে না….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *