জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া ©✍ সায়ন্তন ধর
জার্মানি: জাটিঙ্গার ফিনিক্স হয়ে ওড়া
©✍ সায়ন্তন ধর
(নবম পর্ব)
…পরদিন সকালে রওনা দিলাম লেক তিতিসির উদ্দেশ্যে। মায়াময় এই সুন্দর নামের লেকটি জার্মানীর দক্ষিণ পশ্চিমে ফ্রান্স সীমান্তে অবস্থিত ব্ল্যাক ফরেস্ট রেঞ্জের একটি ছোট্ট হ্রদ। যাত্রা পথটিও খুব সুন্দর। ৩৫০ কিলোমিটার, পুরোটাই পাহাড়ি পথ। বাঁদিকে খাড়া পাহাড়, ডান দিকে অতল খাদ। কোথাও পাহাড়গুলি ভীষণভাবে ন্যাড়া আবার কোথাও ঘন ফার ও স্প্রুস অরণ্য। কোথাও পাহাড় থেকে ঝর্ণা নেমে এসেছে রাস্তায়। পাহাড়ি রাস্তাও যে এতটা ওয়েলমেন্টেড হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন, আর এত মসৃণ, কোন ঝাঁকি নেই। শুধু বাঁক গুলোতে কাজ করছে কেন্দ্রাতিগ বল। বেশ কিছুক্ষণ এমন দৃশ্যই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চলতে লাগলো। আল্পসের কোলে এই যাত্রায় একটুও বিরক্তি ছিল না। এরপর বাঁদিকে হঠাৎ পটপরিবর্তন। পাহাড় দূরে সরে জায়গা করে দিয়েছে বোডেনসি-হুট্টেনসি-ওবেরসি হ্রদগুচ্ছকে। আইবেক্স ও ক্যামোইস পাহাড়ি ছাগলেরা জল পান করছে আর তাদের গলায় লাগানো ঘন্টা টুংটাং শব্দ তুলছে। পাহাড়ি হলেও তারা পোষও মানে। পান্না সবুজ জলে দূরের পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি। বাসের চাকা ছুঁতে চায় এপাড় ভাঙা ঢেউ। জলে ভেসে চলেছে কত নাম-না-জানা পরিযায়ীর দল। ওরা এসেছে কয়েকশো মাইল উড়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও আর্কটিক থেকে। বাসে হালকা আওয়াজে জার্মান ফোক সুর বাজছে। জার্মান ফোক অর্থাৎ লোকগীতিকে Volksmusik বলে। দক্ষিণ জার্মানির এই আল্পীয় অংশে এই ধরনের গান খুব জনপ্রিয়। প্রথম ১৫৪৫ সালে সুইজারল্যান্ডের অ্যাপেনজেল ক্যান্টনে “The call of a cowherd” নামে এই ধরনের গান রেকর্ড করা হয়েছে। এই গানগুলিতে খুব সরল সুর ও কথা ব্যবহার করা হয়। ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র যেমন – অ্যাল্পেনহর্ণ, হ্যাকব্রেট, জিটার, অ্যাক্যুস্টিক গিটার, ভায়োলা ও হার্মোনিকা ব্যবহার করা হয়। তবে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল ইয়োডলিং। অস্ট্রো-বাভারিয়ান (জার্মান) শব্দ Jodeln থেকে Yodeling কথাটি এসেছে। প্রখ্যাত গায়ক কিশোর কুমার তাঁর বিভিন্ন গানে এই ইয়োডলিং ব্যবহার করেছেন। শোনা যায় আল্পীয় গ্রাম গুলিতে সংকেত আদান-প্রদানের জন্য ইয়োডলিং ব্যবহার হত। পরবর্তীতে তা লোকগানের অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে যায়। এখনও বাসের গানে যে ইয়োডলিং হচ্ছে তা যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাহাড় থেকে পাহাড়ে। সে সুর শুনে মন যেন হারিয়ে যেতে চায় আল্পসের আনাচেকানাচে।
ওই পাহাড়চূড়োতে
আকাশ নেমেছে
কোন অচেনা দুঃখ আমার
হৃদয় ছুঁয়েছে
ঐ সবুজ ঘেরা বন
আর পাহাড়তলির গান
আমার প্রাণে সুর ঢেলেছে
মাউথ অর্গ্যান
বনের ধারে বন্ধ দুয়ার
ছোট্ট কুটিরটায়
আছে কোনো বন্দিনী মন
দেখি কল্পনায়
এই পাহাড়ি ঝোরা
স্বপ্ন ছায়াবন
পাহাড় ছুঁয়ে নামছে বাতাস
বইছে সারাক্ষণ …
দীর্ঘসময় পাশে থেকে দূরে সরে গেল প্রাকৃতিক আয়না তিনটি। এরপর আবার কিছুটা সময় পাহাড়ি পাকদন্ডী বেয়ে অবশেষে পৌঁছলাম ব্ল্যাকফরেস্টের প্রবেশদ্বার তিতিসি হ্রদের তীরে। ব্যাডেন-উর্টেম্বার্গ রাজ্যের এই অরণ্যাবৃত পার্বত্য অঞ্চলটি দানিয়ুব-নেকার-রাইন নদীবিধৌত। এর সর্বোচ্চ অংশের নাম ফেল্ডবার্গ শৃঙ্গ (১৪৯৩ মিটার)। স্যান্ডস্টোন ও নিস শিলায় গঠিত এই অঞ্চল খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। তিতিসি হ্রদের সৃষ্টি এই ফেল্ডবার্গ হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলেই। সাগর সমতল থেকে ৮৪০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই মিষ্টি জলের মিষ্টি হ্রদটিকে দেখেই কাটিয়ে দিলাম অর্ধেক দিন। ট্রট, পার্চ, ঈল, সানব্লেক, ল্যাম্প্রের মত মাছের ঝাঁক চোখে পড়লো। খাদ্যশৃঙ্খলের নিয়ম মেনে সিলভার বার্চের নুয়ে পড়া রূপোলি ডালে হলুদ পাতার আড়ালে গ্রে হেরণ অপেক্ষমান। হ্রদের তীরভূমি ঘেঁষে ও নামক বিরল ফার্ণের দেখা মিলল। এই হ্রদের জলে পুষ্ট হয়েছে গুটাচ নদী। হ্রদের উত্তর তীরে রয়েছে স্পা থেরাপি কেন্দ্র। স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে বিখ্যাত এটি। হচফার্স্টচেঞ্জ জার্মানির বৃহত্তম স্কিক্ষেত্র। মিউজিকে বেজে চলেছে চেনা সুর।
“আছে ড্যাসার আর ড্যান্সার আর প্র্যান্সার আর ভিক্সেন
কমেট আর কিউপিড আর ডনার আর ব্লিটজেন
মনে আছে কিনা বল
সবচেয়ে প্রিয় রেনডিয়ার ঝলমল।
রুডল্ফ নামের সেই রেনডিয়ার
উজ্জ্বল লাল যার নাক
দেখে যদি থাকো তাকে কখনো
জেনো নাকে তার যত হাঁকডাক।
আর যত আছে তার সঙ্গীরা
ডেকে তাকে করে উপহাস
খেলার সাথী ‘আয়’ বলেনি
রুডল্ফ একা বারো মাস।
হিম ঘেরা ক্রিসমাস সাঁঝের আগে
সান্টার আসে আবদার
রুডল্ফ তোমার ওই নাকের গুনে
আমার এ স্লেজ পথ নেবে চিনে।
আনন্দে উদ্বেল হরিণীরা
হেসে কেঁদে বলে চল চল
রুডল্ফ হরিণ ভাই তুমিই সেরা
তোমার নামই আজ জগৎজোড়া।”
ছোট্টবেলার সেই ছড়া শুনে এখানে স্কি করে বাকি সময়টাও কাটিয়ে দিলাম। পূর্বের শৃঙ্গগুলিকে আগুনরঙে রাঙিয়ে তিতিসির জলে ডুব দিল সূর্য্য। রাত বাড়লে নিস্তব্ধতা বাড়ে। অজানা পোকাদের অচেনা ডাক ও স্প্রুস গাছের মর্মর ধ্বনিতে রহস্যময় হয়ে ওঠে লেকচত্বর। পরদিন ভোর নাগাদ পদব্রজে বেরিয়ে পড়লাম ব্ল্যাক ফরেস্টকে ভালোভাবে চিনতে।
(ক্রমশঃ)
©✍ সায়ন্তন ধর
৩১/০৮/২০২১