বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ… ( দ্বিতীয় পর্ব ) ✍️ তাপস
বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ… ( দ্বিতীয় পর্ব )
✍️ তাপস
তস্মাৎ প্রণম্য প্রণিধায় কায়ং
প্রসাদয়ে ত্বামহমীশমীড্যম্ ।
পিতেব পুত্রস্য সখেব সখ্যুঃ
প্রিয়ঃ প্রিয়ায়ার্হসি দেব সোঢ়ুম ॥
গীতা ১১/৪৪
( হে পরম পূজ্য দেব, আপনাকে দণ্ডবৎ প্রণাম করে আপনার প্রসন্নতা প্রার্থনা করছি। পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখার, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ ক্ষমা করেন, আপনিও সেইরকম আমার অপরাধ ক্ষমা করুন। )
দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের প্রায় নিরক্ষর পাঁচ টাকা মাইনের পুরোহিত সারা পৃথিবী জুড়ে এক সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী ছড়িয়ে দিলেন, অতি সরল ভাবে বললেন –
” যত মত তত পথ “। আরো ভাবনার বিষয় হচ্ছে এই বামুন ঠাকুরের চেলা কিন্তু কোনো ব্রাহ্মণ সন্তান নয়, কায়েত শ্রীনরেন্দ্রনাথ দত্ত। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে যা এক বিস্ফোরক ঘটনা। ১৮ই ১৮৩৬ সালের মধ্যরাত্রে যখন যুগবতার শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব বরানগরের কাশীপুর উদ্যানবাটীতে মর্ত্যলীলা সাঙ্গ করলেন, তখন তার চেলা নরেনের বয়স মাত্র তেইশ। এরকম জনশ্রুতি প্রচলিত যে রামকৃষ্ণদেব উকিলদের পছন্দ করেন না, কিন্তু প্রধান শিষ্য হিসেবে রেখে গেলেন নরেন্দ্রনাথ দত্তকে, যিনি গর্বভরে বলতেন – আমরা সাত পুরুষের উকিল বংশ। মামলা মোকদ্দমা নিয়ে সারা জীবন বিব্রত থেকেছেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত অর্থাৎ স্বামীজি।
স্বামীজি যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই শিমুলিয়ার দত্তবাড়ির অবস্থান কলকাতার ছয়ের পল্লীতে, তৎকালীন যুগে ওটাকে বাংলার এথেন্স বলা হত। স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় কারণটা কি?? কারণ এই ছয়ের পল্লীতেই জন্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রভৃতিদের।
১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের পরে ওই গোবিন্দপুর অঞ্চলে কেল্লা তৈরির সময়ে ইংরেজরা ওখানকার অধিবাসীদের অন্যত্র জমি দেয়। পুনর্বাসনের সেই জমি পেয়ে উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলে উঠে আসেন স্বামীজীর পূর্বপুরুষ রামসুন্দর দত্ত। রামসুন্দর দত্তর সন্তান রামমোহন দত্ত তিন নম্বর গৌরমোহন স্ট্রিটে অনেকখানি জমিসহ বিশাল বসতবাড়ি তৈরি করলেন, যেদিকে আমরা স্বামীজীর বাড়ি বলে জানি। এই রামমোহন দত্ত ছিলেন সুপ্রিমকোর্টের ইংরেজ অ্যাটর্নির ম্যানেজিং ক্লার্ক এবং পরে ফার্সি আইনজীবী। আইন ব্যবসায়ে প্রভূত অর্থ থেকেই এই দত্তবাড়ির ভিটের পত্তন। অভিজাত জীবনযাপন করেও তিনি প্রভূত অর্থ ও সম্পত্তি অর্জন করেছিলেন সালকিয়ায় তার দুটো বাগানবাড়ি এবং খিদিরপুরে প্রচুর জমিজমা ছিল। অতি অল্পবয়সে (৩৬ বছর ) কলেরায় রামমোহনের মৃত্যু হয়। সে সময় গ্রীষ্মকালে কলেরা হতো এবং উত্তর কলকাতায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রায় প্রত্যেক পরিবার থেকে প্রত্যেক বছর এক-আধজন মারা যেতেন। এই রামমোহন দত্তের দুই পুত্র – দূর্গাপ্রসাদ ও কালিপ্রসাদ। এই দুর্গাপ্রসাদ ছিলেন স্বামীজীর পিতামহ। যৌথ পরিবারে তাঁর স্ত্রী অপমানিত হয়েছেন এই দুঃখে দুর্গাপ্রসাদ একবার বসতবাটি ত্যাগ করেছিলেন। পরে তিনি যে সন্ন্যাসী হয়ে যান তা অনেকেরই জানা। সন্ন্যাসী হয়ে যাবার পরও দুর্গাপ্রসাদ মাঝে মাঝে ঘোড়ায় চড়ে উত্তর ভারত থেকে কলকাতায় আসতেন এবং তাঁর এক ভিক্ষাপুত্রের সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে বাস করতেন। একবার তাকে আটকাবার জন্যে দরজায় তালা লাগানো হয়, তিনদিন পরে তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে দেখা যায়, তখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গৃহত্যাগী দুর্গাপ্রসাদ আর কখনও ফেরেননি। দুর্গাপ্রসাদ তরুণ অবস্থায় সন্ন্যাস গ্রহণ করলেও দত্ত বাড়ির ভিটেতে প্রথম মামলার প্রবেশ কিন্তু তাকে কেন্দ্র করেই, সেই সময় হিন্দু আইন অনুযায়ী হাইকোর্টে একটি মামলা রুজু হয় যার সারমর্ম হলো যে দুর্গাপ্রসাদ দত্ত নিরুদ্দেশ হয়েছেন 12 বছর, সুতরাং তাকে মৃত ঘোষণা করা হোক। দুর্গাপ্রসাদ এর পুত্র অর্থাৎ স্বামীজীর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত তাঁর কাকা কালিপ্রসাদের অনুগ্রহে নিজের পড়াশোনা সম্পূর্ণ করার পর কিছুদিন ব্যবসার চেষ্টা করেন , তাতে অসফল হয়ে ১৯৫৯ সালে আইন পাড়ায় অ্যাটর্নি অফিসে আর্টিকেল ক্লার্ক হন ও পরে ২৯ জানুয়ারি ১৮৬১ তে হেনরি জর্জ টেম্পলের অ্যাটর্নি অফিসে যোগ দেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাবা ভুবন মোহন দাস ওই অফিসে বিশ্বনাথ দত্তের সহকর্মী ছিলেন। ১৪ মার্চ ১৮৬৫ প্রধান বিচারপতি স্যার বার্নের্স পিকক-এর এজলাসে ‘এটর্নি’ ও ‘প্রক্টর’ রূপে নাম লেখাবার জন্য বিশ্বনাথ দরখাস্ত করেন। ৭ জানুয়ারি ১৮৬৬, এই আবেদনে সম্মতি দেন জাস্টিস ওয়ালটার মরগ্যান। আইনপাড়ায় বিশ্বনাথ দত্তর কোম্পানির নাম ছিল ধর অ্যান্ড দত্ত, তার পার্টনার ছিলেন আশুতোষ ধর। বিশ্বনাথ দত্ত আইনব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে নীলামে সম্পত্তি কিনে সময়মতো তা বেচে দিয়ে তিনি অর্থবান হতেন। এই কেনাবেচায় তিনি স্ত্রী ভুবনেশ্বরীর নাম ব্যবহার করতেন। বিশ্বনাথ দত্তর কাকা যিনি বিশ্বনাথ দত্তকে তাঁর পিতার অবর্তমানে পড়াশোনায় সাহায্য করেছিলেন সেই কালীপ্রসাদের দুই ছেলে–একজনের নাম কেদারনাথ এবং অপরজন তারকনাথ। তারকনাথ কলকাতা হাইকোর্টে নামী উকিল হয়েছিলেন, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারী সেরেস্তার অনেক মামলা-মোকদ্দমা তিনি করতেন এবং সেই সুবাদে রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তার বিশেষ পরিচয় ছিল। তারকনাথের ছয় কন্যা এবং তাদেরই কারও বিয়েতে ঠাকুরপরিবারের বিশিষ্ট সদস্যরা (রবীন্দ্রনাথ সহ) গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে নেমন্তন্ন খেতে এসেছিলেন। বিশিষ্ট অতিথিদের বসাবার জন্য আলাদা ব্যবস্থা হয়েছিল। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তখন কেউ চেনেন না। এই তারকনাথের বিধবা, অর্থাৎ ভুবনেশ্বরী-পুত্রদের খুড়িমাকে কেন্দ্র করেই মামলার সূত্রপাত হয় দত্ত বাড়ীতে । পরবর্তীকালে শরিকদের সঙ্গে মামলার সময় বিশ্বনাথ দত্তের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে নানা ইঙ্গিত ওঠে। কারও অভিযোগ তিনি বিশাল দেনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং পাওনাদারদের এড়াবার জন্যে কিছুদিনের জন্য কলকাতা ছেড়ে রায়পুরে প্র্যাকটিস করেন। প্রচুর উপার্জনের সঙ্গে প্রচুর বেহিসেবী ব্যয়ের ব্যাপারে অনেক উকিল এদেশে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গিয়েছে। বিশ্বনাথ দত্ত বেশি রোজগার না কম রোজগার করেছেন তা নিয়ে মাথাব্যথার কোনো কারণ থাকতো না যদি না তার মৃত্যুর পরে শরিকী মামলায় তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের বউ আদালতে অভিযোগ করতেন যে ভুবনেশ্বরীর ভূসম্পত্তি সবই তার স্বামী তারকনাথের উপার্জিত অর্থে বেনামে যৌথপরিবারের ভ্রাতৃবধূ ভুবনেশ্বরীর নামে কেনা হয়েছিল। এসব সম্পত্তি কেনার কোনো আর্থিক সঙ্গতিই নাকি ছিল না ভুবনেশ্বরীর স্বামীর। এমনকি বিশ্বনাথের অনুপস্থিতিতে কলকাতায় স্ত্রী-পুত্র কন্যাদের ভরণপোষণ হয়েছে খুডোর পয়সায়। অসংখ্য মামলায় জর্জরিত স্বামীজীর বিধবা জননী ভুবনেশ্বরী। মায়ের এই যন্ত্রনা স্বামীজীকেও কুরে কুরে খেয়েছে প্রতিনিয়ত। এমনকি এই মামলা চালানোর জন্য মঠের তহবিল থেকেও স্বামীজি পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে অবশ্য সেই দেনা তিনি শোধ করে দেন। মামলার খরচ জোগাতে গিয়ে খুড়িমা জ্ঞানদাসুন্দরী সর্বস্বহারা হয়ে শেষজীবনে বিবেকানন্দর সাহায্যপ্রার্থিনী হন। এমনই ভবিতব্যের রসিকতা, যাঁর খামখেয়ালিপনায় স্বামীজীর মা ভুবনেশ্বরীর সোনার সংসার ছারখার হলো , তিনিই আবার আশ্রয় চাইলেন ভুবনেশ্বরীরই সংসারত্যাগী সন্তানের কাছে। ১৯০২ সালের জুন মাসে স্বামীজীর মর্ত্যলীলার শেষ শনিবার তাঁর সাথে দেখা করতে এলেন শরিক হাবু দত্ত এবং সব মিটমাট করে দেয়ার প্রস্তাব দিলেন। স্বামীজি সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইলেন না। স্বামীজীর মহাপ্রয়াণের ঠিক দু’দিন আগে ২ রা জুলাই দীর্ঘদিনের সংঘাত শেষ হলো। মায়ের আইনি সমস্যার সমাধান করে ঠিক দু’দিন পরে দেহ রাখলেন প্রণম্য স্বামীজি।
সন্ন্যাস কি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন , “সন্ন্যাস অর্থ, সংক্ষেপে মৃত্যুকে ভালবাসা। আত্মহত্যা নয়–মরণ অবশ্যম্ভাবী জেনে নিজেকে সর্বতোভাবে তিলে তিলে অপরের মঙ্গলের জন্য উৎসর্গ করা।” এরই পাশাপাশি উত্তর কলকাতায় তারই প্রতিবেশী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ঘোষণা, বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়। অসংখ্য বন্ধন মাঝে মুক্তির স্বাদ গ্রহণের জন্য সত্যসন্ধানীর বার বার জীবনসমুদ্রে অবগাহন। আবার দুজনে মিলে যায় একই বৃন্তে। রবীন্দ্র কন্ঠে শুনতে পাই :-
” অন্নহারা গৃহহারা চায় ঊর্ধ্বপানে,
ডাকে ভগবানে।
যে দেশে সে ভগবান মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে,
সারাদিন বীর্যরূপে দুঃখে কষ্টে ভয়ে,
সে দেশের দৈন হবে ক্ষয়,
হবে তো জয়। ”
Romain Rolland স্বামীজী সমন্ধে লিখছেন – “His fascinating face, his noble stature and gorgeous apparel. His speech was like a tongue of flame.”
স্বামী বিবেকানন্দ শুধুই একজন সন্ন্যাসী নন, তাঁর বাণীতে প্রস্ফুটিত হয় ভারতবর্ষ।
( চলবে )
✍️ তাপস