আমার প্রিয় একটি লুপ্তপ্রায় বই। –মৈমনসিংহগীতিকা। কলমে — ছন্দা চট্টোপাধ্যায়
আমার প্রিয় একটি লুপ্তপ্রায় বই।
–মৈমনসিংহগীতিকা।
কলমে — ছন্দা চট্টোপাধ্যায়
আমার খুব প্রিয় একখানি বই হ’ল মৈমনসিংহগীতিকা।পল্লীকবিরা কখনো উচচ শিল্পকলার অনুশীলন করেননি,কিন্তু মনস্তত্বটা বুঝতেন।বিশেষ করে প্রেমবিহ্বল নরনারীর মনস্তত্ব।মৈমনসিংগীতিকায় তিনটি আখ্যান মহুয়া,মলুয়া ও চন্দ্রাবতী নিয়ে আলোচনা করছি।এ ছাড়া আরো সাতটি আখ্যান আছে।
বইটি মৈমনসিংহ অঞ্চলের প্রাচীন পালাগানের সংকলন।কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেনমৈমনসিংহের স্থানীয় সংগ্রাহকদের সহায়তায় পালাগানগুলি সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে 1923 সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন।পালাগুলির মূখ্য বিষয় নরনারীর লৌকিক প্রেম।যে প্রেম তথাকথিত সভ্য শিক্ষিত সমাজের এলিট সংযমের নিয়মে আবদ্ধ নয়।যে প্রেমে মাটি ও নদীর গন্ধ পাওয়া যায়,পাওয়া যায় বন্য আরণ্যক ভালোবাসার আদিম হাতছানি।প্রকৃতির উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে সঞ্চরমান নারীপুরূষের হৃদয়রহস্য পাঠকের মনকে রোমাঞ্চিত করে।যে প্রেম ভালবেসে মরতেও দ্বিধা করেনা।
পালাগুলিতে সামাজিক চিত্র চমৎকার ফুটেছে।মহুয়ায় বেদের মেয়ে মহুয়ার নদের চাঁদের সঙ্গে প্রেম প্রেম,পলায়ন ওসংসার করা অবশেষে বেদের দলের হাতে উভয়ের শোচনীয় মৃত্যু মনে করিয়ে দেয় -অনার কিলিং-এর কথা।মলুয়াতে চাঁদবিনোদের সঙ্গে মলুয়ার প্রেম বিবাহে পরিণত হয়।তবু স্বামীর ঘরে অবহেলিতা,নিগৃহীতা হয়ে আত্মহনন করে সে।এ যেন আজকের-ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স-এর গল্প।চন্দ্রাবতী ও জয়চাঁদের বিবাহে সামাজিক ও পারিবারিক কোন বাধা না থাকলেও দুষ্ট লোকের প্ররোচনায় চন্দ্রা জয়চাঁদকে ভুল বোঝে।জয়চাঁদ আত্মহত্যা করলে অনুতপ্ত চন্দ্রাবতীও সেই পথ বেছে নেয়।এই চন্দ্রাবতী কোন কাল্পনিক চরিত্র নয়।মৈমনসিংহ জেলার মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা।চন্দ্রাবতী রামায়ণ রচনা করেছিলেন।তবে সীতার বনবাস পর্যন্ত রচনার পরেই তাঁর ঐ মর্মান্তিক অকালমৃত্যু হয়।যে অজ্ঞাত কবি তাঁর জীবনী অবলম্বন করে এই পালা লিখেছেন ধন্য তাঁর প্রতিভা।
এই গীতিকায় স্থানীয় ভাষায় লিরিকের আবেদন অনস্বীকার্য।কাব্যগুলিতে প্রেম দেহাতীত অনুভূতি নয়,শরীরকে উপেক্ষা করে নয়।তাদের কাছে প্রেম যেন প্রথম বরিষণ।অকস্মাৎ বজ্রপাতের তীব্র আলোক-জ্যোতির উচ্ছ্বাসে চক্ষু যেন অন্ধ হয়ে যায়,প্রথম প্রেমের ধারাপ্রপাতে শরীরের রুদ্ধ রোমকূপ মুকুলিত হয়ে ওঠে,আকুল তৃষ্ণায় শুষে নেয় ভিজে আকাশকে খরাতপ্ত কৃষিজমিনের মতো।তাই মহুয়া মরে স্বামীর সাথেই আর মলুয়া ও চন্দ্রাবতী নিজেদের শেষ করে দেয় সেই নিষ্ঠায় যে নিষ্ঠা তাদের দ্বিতীয় কোন পুরূষে প্ররোচিত করতে পারে না।
আসলে পল্লীকবিদের অকপট প্রেমোপাখ্যান মানবিক রসে সিক্ত। কবি জসীমউদ্দীনও এই গ্রন্থটির মাধুর্য্যে মুগ্ধ হয়ে রচনা করেন “সোজন বাদিয়ার ঘাট”,নক্সীকাঁথার মাঠ”ইত্যাদি।তাই মানবিক রসসিক্ত এই বইটি আমার এতো প্রিয়।
আবার একটি ভালো লেখাকে জানার জন্য আমাকে ফিরতে হবে আমার পুরোনো কিছু বইয়ের কাছে।