কাকভোরে তেচন্ডীর মাঠে —- দুলাল কাটারী
কাকভোরে তেচন্ডীর মাঠে
দুলাল কাটারী
তেচন্ডীর মাঠ।এরকম নামকরণের কারণ হলো এই বিশাল মাঠের তিন দিকে তিনটি গ্রাম আর প্রতিটি গ্রামে একটি করে চন্ডী মন্ডপ আছে।তার মধ্যে গৌতমদের গ্রামের চন্ডী প্রতিমাটি বেশ বড়ো। তার রণচণ্ডী রূপটিও বড়োই বিভৎস, কারো দৃষ্টি হঠাৎ দেবীর মুর্তির দিকে গেলেই সে ভয়ে শিউরে উঠে।কথিত আছে এক অমাবস্যার রাতে চন্ডী দেবী নাকি গ্রামেরই এক যুবতীকে গিলে খেয়েছিলেন।সন্ধ্যে দিতে এসে সে আর ফেরেনি।অনেকে বলে যুবতীর কাপড়ের খুঁট টা নাকি দেবীর ঠোঁটে শেষ চিহ্ন স্বরূপ দেখেছে।আবার কেউ কেউ বলে মেয়েটি নাকি অশৌচ গায়ে এসেছিলো বলে দেবী তাকে খেয়ে ফেলেছেন।মেয়েটি খুবই ঈশ্বর চিন্তায় বিভোর ছিলো বলে তার একাগ্রতায় মুগ্ধ হয়ে চন্ডী দেবী তাকে নিজের কাছে আকর্ষণ করে মানব জন্মের সকল কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়েছেন-এমন রটনাও আছে।সে সব যাইহোক দেবী খুব জাগ্রত বলেই এলাকায় পরিচিত।তাই গ্রামের মানুষ দেবী রুষ্ট্র হন এমন কোনো কাজ করতে সাহস করে না।
মাঠটা এতটাই বিশাল যে পায়ে হেঁটে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে যেতে প্রায় ৩৫-৪০ মিনিট সময় লেগে যায়।মাঠের তিন দিকে তিনটি গ্রাম বাদ দিলে চতুর্থ দিকটায় বয়ে চলেছে সুনন্দন খালটি।খালের ওপারে আবারও বিস্তৃত মাঠ আর মাঠ।ইংরেজ আমলে এই বিশাল মাঠের মধ্যে দিয়ে চাষের জন্য জল সেচের খাল কাটা হয়েছিলো।
খালের ধার বরাবর গৌতমদের দুখন্ড জমি আছে। বছরে তিনটি ফসল ফলে।বর্ষার আমন ধান,শীতে আলু আর আলু তোলার পর তিল।
সেবার শীতে গৌতমের বাবা ফি বছরের মতোই আলু চাষ করেছে খাল ধারের জমিতে।আলুর জমিতে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই জল দিতে হয়।এতো বড়ো মাঠে মাত্র তিনটে জল তোলার মিনি আছে।নিয়ম মতো যারা ভোরে গিয়ে লাইন দেয় তারাই আগে জল পায়।
কলকাতায় পড়াশোনার ফাঁকে গৌতম বড়োদিনের ছুটিতে কটা দিনের জন্য বাড়ি এসেছে।শক্তসমর্থ চেহারার গৌতম এমএসসি প্রথমবর্ষের ছাত্র।পাড়ায় এক সময় দাপুটে ছেলেরদের সর্দার ছিলো সে। বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, তাই তাকেই ভোররাতে আলুর জমিতে জল দিতে যেতে হবে।তাড়াতাড়ি জমিতে জল ধারানোর ব্যবস্থা করে কাল’ই কলকাতা ফিরে যাবে।জমে থাকা এ্যাসাইনমেন্টের কাজ গুলো শেষ করতে না পারলে পরশু স্যারের কাছে সাবমিট করতে পারবে না। তাই খুব ভোরেই জমিতে যাবে ঠিক করলো।
রাতে খুব তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়লো।দায়িত্বপূর্ণ কাজের চিন্তা থাকলে ঘুমটা ঠিক মতো হয় না।ঘন্টা চারেকের মধ্যে ঘুমের চটকা ভেঙে গেলো।ঘড়ি বলছে পৌনে তিনটে।ষোলো কাঠা জমিতে জল ধরাতে হবে তাই রাতের অন্ধকার তোয়াক্কা না করেই বেরিয়ে যাবে বলে তৈরি হলো সে। কারণ জমিতে জল দেওয়ার যেন প্রতিযোগিতা হয় সেখানে। অনেক বড়ো বড়ো চাষিরাও থাকে তো।বিজ্ঞানের ছাত্র গৌতম, ছোটো বেলার মতো ভুতপ্রেতের ভয় নেই।আর চোর-ডাকাতরা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে কাজ সেরে বাড়ি চলে গেছে।
মুখে হাতে জল নিয়ে, কোমরে গামছা বেঁধে,হাতে কোদাল নিয়ে ভোরের হালকা জ্যোৎস্নার আলোআঁধারিতে মাঠের দিকে রওনা দিলো।
মেঠো আলপথে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে পড়ছে বাল্যকালের কত কিছু দুষ্টুমির কথা।আমিন চাচার জমি থেকে কড়াইশুঁটি চুরি করে খেয়েছে।নিমাই কাকার জমিতে শশা চুরি করতে গিয়ে সেবার তো ভ্যাবলা ধরা পড়ে সবার নাম বলে দিয়েছিলো।কিন্তু গৌতমকে ধরার সাধ্যি কারো হয় নি।তবে সেইবারই ওই কেবলা ভ্যাবলাটার জন্যেই বাবার কাছে নালিশ করে গিয়েছিলো নিমাই কাকা।
খালের ধারে যেতে একটা পুকুরের পাড় হয়ে আবারও আলপথই ধরতে হয়।সেইখান থেকে হোস্ পাইপের মুখ খুলে জল কেটে নিয়ে আসতে হবে জমিতে। পুকুরের পাড়ের কাছাকাছি এসেই বুড়ো বট গাছটার দিকে তার নজর গেল।বটের তলায় শ্মশান।সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে প্রকান্ড মূর্তির এক শ্মশান কালী।মা কালীর গায়ের রং অমাবস্যার অন্ধকারকেও যেন দূরে ঠেলে রাখে। বছর চারেক আগে একটি কিশোরীর কঙ্কাল মা কালীর সামনে শুইয়ে রাখা ছিলো।সেই পুকুরের সংস্কারের সময় পাওয়া গিয়েছিলো।অবশ্য গোটা অবস্থায় পাওয়া যায় নি।হাড়গুলো খুলে খুলে গিয়েছিলো।প্লাস্টিকের বস্তাতে মুখ বাঁধা অবস্থায় বডিটা বাঁধা ছিলো বলে সব হাড় গুলোই পাওয়া গিয়েছিলো।গ্রামের মাতব্বর গোছের মানুষরা পুলিশকে খবরও দিয়েছিলো।তবে পুলিশ কোনো কিনারা করতে পারেনি।গ্রামে কথিত আছে বছর দশেক আগে জমিদার বংশধদের বাড়িতে গোপাল খুড়োর মেয়ে কাজ করতো।মেয়েটার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি।তাই অনেকে ভাবলো এটা হয়তো তার’ই কঙ্কাল।কিন্তু এখন সেই জমিদার বংশও নেই আর গোপাল খুড়োও নেই।গোপাল খুড়ো মেয়ের শোক বুকে নিয়েও তেষট্টি বছর বয়সে মরলো আর জমিদার বাড়িতে নাকি কলেরার মহামারীতে সবাই শেষ হয়ে গেল।
অবশ্য তাদের জমিদার বলা যায় না।জমিদারি চলে গেছে কোন কালেই!তবে জমিদারি রাজরক্ত তখনও বইছিলো তাদের শরীরে।জুলুম অত্যাচারও ষোলো আনাই বাজায় ছিলো।বাড়ির ছোটো ছেলে বললো ‘গোপাল খুঁড়োর মেয়ে তো সন্ধ্যে বেলায় কাজ সেরে বাড়ি চলে গেছে।’
সত্যিই আবারও প্রমানিত হলো’বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে।’
মদ মাতাল ভিখিরি গোপাল খুঁড়োর হয়ে কেউ জরালো প্রতিবাদ করলো না। কোনো সাবুদ না থাকায় তারা কী নিয়েই বা লড়বে! জমিদার বাড়ির কুকীর্তির কথায় পুলিশ বাবুরা কর্ণপাতই করবে না।তবুও জমিদার বাড়ির বড়ো কর্তা গোপালকে কিছু চাল-আলু দিতে চেয়েছিলেন আর বলেছিলেন ‘দ্যাখো গে,তোমার মেয়ে হয়তো দুঃখকষ্টের যন্ত্রণা সহ্য না করতে পেরে কোনো ছোকরার সঙ্গে ভেগেছে।ফালতু তার জন্য চিন্তা ভাবনা বাদ দাও।সে যেখানেই যাক্ নিজের মতো করে ভালো থাকবে।’
গোপাল ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো ‘তাই যেন থাকে বাপু।তাই যেন থাকে।’
পুলিশ কোনো কিনারা না করতে পেরে এ ঘটনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে গ্রামের লোকেরাই এই হাড় গুলিকে যথাযথ কঙ্কালের আকারে সাজিয়ে মাকালীর সামনেই শুইয়ে রাখে।
গৌতম শ্মশানের কাছাকাছি এসে শুনলো যেন মানব হাড়ের খটাখট শব্দ হচ্ছে। হাড় জুড়ে জুড়ে যেন কঙ্কাল বানানো হচ্ছে। আর ভাবছে হাড়ের উপর মাংস গজিয়ে উঠছে নিমেষে।একটা ফুল আঁকা ফ্রক পড়া মেয়ে আবেদনময়ী উদ্দাম নৃত্যের ভঙ্গিতে তাকে ইঙ্গিতে কাছে ডাকছে।আর মা কালীও যেন সিঁদুর মাখা খাড়া উঁচিয়ে একহাত লাল জিভ বের করে বলছেন
আয় গৌতম, আয় দেখে যা! মানুষকে যে জগতের শ্রেষ্ঠ জীব করে পাঠিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা!সেই তারা এতটাই নিষ্ঠুর হলো যে এই ফুলের মতো পবিত্র কিশোরীর রক্ত দিয়ে তাদের পিপাসা মেটাতে হলো!
ছিঃ!শত শত ধিক্কার জানাই। আবার তার’ই নাকি বড়ো বড়ো সভা করে,মঞ্চ সাজিয়ে, ভদ্রলোক সেজে বুক ফুলিয়ে বলে বেড়ায় যে, মানুষ হলো পৃথিবীর সভ্য জীব!
গৌতম শিউরে উঠছে বারবার।আর কেউ যেন এইরকম অত্যাচারের শিকার না হয় সেই ভেবে মনে মনে বলছে ‘হে ঈশ্বর! সকল মায়ের সন্তান যেন ভর পেট খাবার টুকু পায়,কাউকে যেন এক মুঠো ভাতের জন্য এই ভাবে রাজ রক্তের পায়ে নিজেকে বিলিয়ে দিতে না হয়।’
পুকুরের পাড় পেরিয়ে মাঝ মাঠ দিয়ে আবারও আলপথ ধরেই হাঁটতে হাঁটতে গৌতম এগিয়ে চলেছে। হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যেও গৌতম বুঝতে পারছে তার শরীরে ঘামের অস্তিত্ব।খালের পাড়ে এসে হোস্ পাইপের মুখ খুলে জল বের করে দিলো। জমিতে জলটা পৌঁছাতে মিনিট দশেক সময় লাগবে।পাইপের মুখটা পুরো খোলা উচিৎ হবে না।অন্ধকারে পরিস্কার দেখাও যাচ্ছে না।অন্য লোকের জমিতে জল ঢুকে ফসল নষ্ট করলে ঝগড়াঝাঁটির সম্ভবনা আছে। জল যাতে খুব বেশি না বেরোয় সেজন্য পাইপের মুখে একটুকরো চট্ গুজে দিয়ে খালের পাড়ে উঠলো।শীতকালে খাল শুকিয়ে গেলে তাতে বাঁধ দিয়ে মিনি পাম্পের মালিক আলাদা করে জল ধরে রাখে।চাষীরা প্রয়োজন মতো সেখান থেকে জল ব্যবহার করে।ওখান থেকে হাত পনের দূরেই একটা টিন দিয়ে ঘেরা কুঁড়ে ঘর নজরে এলো গৌতমের। জল জমিতে পৌঁছাতে দেরি আছে তাই একটু বসবে বলেই ঘরের দিকে গেলো।আগে গৌতম এই ঘরটা দেখে নি।শহরে পড়াশোনা ও টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। খুব দরকার না হলে বাড়ি আসে না।অল্প চাষ তাই বাবা-ই সব সামলে নেয়।এই ঘরটা কি জন্য বা কখন হয়েছে সে জানে না।তাই ঘরে কি আছে সেটা দেখার আগ্রহও হলো।
ঘরটা কিছুটা গ্রামের গুমটী দোকানের মতো।মাটির উপরে মাচা করে সেটাকে টিন দিয়ে ঘেরা হয়েছে।ছাওনিও টিনেরই।সুতরাং সাপের ভয় নেই।তাই নির্দ্বিধায় এগিয়ে গিয়ে টিনের দরজা টেনে খুলে ঢুকলো, কোদালটা পাশে রেখে দরজার কাছেই বসলো। এই নির্জন এলাকায় মাঠে এরকম একটা ঘর অবশ্যই দরকার,বর্ষা ও শীতের হাত থেকে বাঁচতে।সে ভাবছে হয়তো চাষীদের সুবিধার জন্যই মিনি মালিক এটা বানিয়ে দিয়েছেন বা চাষীরা নিজেরাই চাঁদা তুলে ছোট্ট একটি আশ্রয় বানিয়েছে।
হঠাৎ সেই কুঁড়েটির ভেতর থেকে এক বৃদ্ধের কণ্ঠ ভেসে উঠলো,
‘তুমি যা ভাবছো তা কিন্তু নয়।এটা চাষিদের সুবিধার জন্য বানানো হয় নি।’
গৌতম হতচকিত।চমকে বলে উঠলো ‘কে আপনি? এতো রাতে এই অন্ধকারে এখানে কি করছেন?আমি তো ভাবলাম এখানে কেউই নেই!’
‘ওহ্! ভয় পেলে বুঝি!’
‘ভয় পাওয়ারই তো কথা!’
গৌতম হতবাক হয়ে ভাবছে তার মনের কথা এই বৃদ্ধ জানলো কি করে! আবার এটাও ভাবছে নিজের অজন্তে অস্ফুটে সে মনের ভাবনাটা বলে ফেলেছে কি! হয়তো-বা, একা থাকলে মনের ভাবনা অনেক সময় ঠোঁটে উচ্চারিত হয়েও যায়।কিন্তু এই অনাকাঙ্ক্ষিত কর্কশ কন্ঠস্বরে সে এতোটাই চমকে উঠেছে যে,তার মুখ থেকে অস্ফুটে কিছু বেরিয়ে এসেছে কি-না,সে কথা গৌতম মনে করতে পারছে না। তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো
‘আপনি,এই অন্ধকারে…’
বৃদ্ধ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো ‘মালিক জল ভর্তি করার পর আমার ছেলে সুবল এখানে ডিম পোনা ছেড়ে পালন করে চারা পোনাতে পরিনত করে,তিন-চার মাসের মধ্যে তুলে নেয় মিনি জলের সিজিন শেষ হওয়ার আগেই।চারাপোনা গুলোকে তুলে লিজ নেওয়া কয়েকটা পুকুরে চাষ করে সুবল। আর কিছু কিছু বিক্রিও করে দেয়।’
গৌতম বললো’হ্যাঁ বুঝেছি।’
‘জানো বাপু! লোকজনের উৎপাতে মাছ চাষটা তুলেই দেবে ভাবছিলো সুবল।দূরে বাড়ি, সবসময় নজরও রাখা যায় না।কেউ যদি লম্বা জাল টেনে মাছ তুলে নেয় তাহলে প্রচুর ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই পাহারা দেওয়ার জন্য সে-ই টিনের চালাটি বানিয়েছে।’
এর মধ্যেই গৌতম শুনতে পেলো অন্ধকারেই বৃদ্ধ দু’হাতে কি একটা ঘষছে।খস্ খস্ শব্দে বারবার গৌতমের চোখ ঐ শব্দের উৎসের দিকেই যাচ্ছে।
হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো
‘কি,বারবার তাকাচ্ছো যে, চলবে নাকি?’
বিস্মিত গৌতম ভাবল বুড়ো কি করে দেখলেন যে সে তার দিকে তাকাচ্ছে!অনেকক্ষণ অন্ধকারে আছেন বলেই হয়তো তাঁর দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।কিন্তু গৌতমও তো এখানে মিনিট ছয়-সাত হলো আছে এর মধ্যে তারও তো কিছু দৃষ্টিগোচর হওয়ায় কথা।বাইরে আলো থেকে ঘরের অন্ধকারে এলে দেখতে অসুবিধা হয়।কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তা চোখ-সওয়া হয়ে যায়।উঁহু, তেমন টাও তো নয়। সত্যিই ঘরের মধ্যটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, তাই কিছু দেখা যাচ্ছে না।কিন্তু বুড়ো দেখছেন কি করে!তবে কি সে দরজার কাছে বসে আছে বলে বাইরের হালকা আলোআঁধারিতে বুড়ো তাকে দেখতে পাচ্ছেন!হলেও হতে পারে।
যাইহোক,এবার গৌতমের জমির কাছে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এতক্ষণে জল জমিতে পৌঁছে যাবে। বুড়োর শেষ কথার উত্তরে গৌতম বললো ‘কি জিজ্ঞেস করলেন বুঝলাম না।’
ফিক্ ফিকিয়ে হেসে বুড়ো বললো
‘ভাজা দোক্তা। চুন দিয়ে বানাচ্ছি। চলবে নাকি?’
গৌতমের কোনো নেশা নেই। কেবল পান দু-এক খিলি মাঝে মধ্যে খেতো।কলকাতায় গিয়ে তাও ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।সেখানে এক খিলি জর্দা পান দশ টাকা আর মিঠাপাতি বারো টাকা।এতো দাম দিয়ে সে পান খাবে না কারণ গ্রামে এক খিলি পানের দাম আড়াই টাকা,কেউ কেউ তিন টাকাও নেয়। তাই গ্রামের বাড়িতে এলে শুকনো তামাক পাতা দিয়ে সঙ্গে মৌরি মিশিয়ে সেটা আগুনে একটু ভেজে নিয়ে মশলা তৈরি করে মুখে রাখতো।রাতে বা দিনে পড়তে বসলে একটু এনার্জি পেতো এর থেকে।সেটাই এখন বুড়ো বানাচ্ছে। তাই গৌতম লোভে পড়ে বলে বসলো
‘হ্যাঁ চলবে। চুনটা একটু কম দিন।গাল পুড়ে যাবে।আমি চুন ছাড়া’ই খাই।’
বুড়ো বললো’তবে এই নাও, নিজেই কৌটো থেকে নিয়ে বানিয়ে নাও।আমি একটু বেশিই চুন খাই।’
গৌতম নিজের কোলের কাছে ছুটে আসা কৌটোটা তুলে নিয়ে নিজের মতো একটু খানি মুখে নিয়ে আবারও বুড়োর দিকেই কৌটোটা ছুঁড়ে দিয়ে জমির পথে হাঁটা দিলো।
জমিতে জল দিয়ে যখন বাড়ি ফিরলো গৌতম তখন প্রায় ছয়টা বাজে।বাবা মুখ ধুতে ধুতে জিজ্ঞেস করলো ‘কিরে, জল দিয়ে ফিরলি?কত রাতে গিয়েছিলি রে?এমধ্যি চলে এলি? ভয় করে নি তো,একলা?’
গৌতম বললো ‘না, ভয় করবে কেন? ওখানে তো সুবল কাকুর বাবা মাছ পাহারা দিচ্ছিলো টিনের চালায় বসে।’
গৌতমের বাবা চমকে উঠে বিস্ফারিত চোখে বললো ‘কি বলছিস্ রে তুই,গৌতম?ওই হাড় কিপ্টে বুড়োটা তো বছর দেড়েকে আগেই মারা গেছে!’