শ্রীমতি অঘোরকামিনী রায় মৌসুমী চক্রবর্তী ষড়ঙ্গী
শ্রীমতি অঘোরকামিনী রায়
মৌসুমী চক্রবর্তী ষড়ঙ্গী
নারী জীবনের বঞ্চনাদীর্ণ অবয়বের ছিন্নবিচ্ছিন্ন ঘটনা নারীকে জীবনপথে না এগিয়ে বরং পিছিয়ে দিয়েছে আর তখন সমাজ যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছে। শিক্ষা, বুদ্ধি আর প্রচন্ড পরিশ্রম দিয়ে সমাজের আলগা অস্হিমজ্জায় আঘাত করার কৌশল শেখা প্রতিটি নারীর ক্ষেত্রে জরুরি , সেই মূল্যবোধের তাগিদে সে বুঝেছে , যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে । তেমন এক নারীর কথা বলছি যিনি নারী- অহমে ঋদ্ধ , যিনি পৃথিবীর বুকে হাজার হাজার নারীকে সাহস বা প্রেরণা জোগানোর শরিক হয়ে উঠতে পারেন। তাঁর জীবনকথা সমকালকে ছাপিয়ে ভাবীকালেরও পথ দিশারী হতে পারে। নিজ স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল এই নারী কেবল ব্যক্তিত্ব ময়ী বা বুদ্ধিমতী ছিলেন না , ছিলেন বড় মাপের সমাজসেবী।সেই সেবাময়ী মমতামূর্তির নাম শ্রীমতি অঘোরকামিনী রায়।
তেমন চিরন্তনী তিনি নন। তবুও অনেকেই তাঁর জীবন বৃত্তান্তে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিধানচন্দ্র রায়কে সবাই জানেন , ভারত সরকার যাকে ১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দে ৪ ঠা ফেব্রুয়ারিতে ” ভারতরত্ন ” উপাধিতে সম্মানিত করেন । যাঁর কথা এলেই ভেসে ওঠে দুর্গাপুর , কল্যাণী , বিধাননগর , হাবরা , অশোকনগর এমন পাঁচটি শহর যার রূপকার ছিলেন স্বয়ং বিধানচন্দ্র রায়। তিনি হলেন এক উপযুক্ত বঙ্গ সন্তান , এক বিখ্যাত চিকিৎসক এবং এক একনিষ্ঠ সমাজ সেবক ।
উপযুক্ত মা না হলে উপযুক্ত সন্তান হয় না । সেবা বা পরোপকারিতা তিনি তাঁর মা শ্রীমতি অঘোরকামিনী রায়ের কাছ থেকেই জন্মসূত্রে পেয়েছিলেন ।
শ্রীমতি অঘোরকামিনী দেবী ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ২৪ পরগনার ” শ্রীপুরে ” জন্মে ছিলেন। বাল্যবিবাহের ফলস্বরূপ মাত্র দশ বছর বয়সে শ্রী প্রকাশ চন্দ্র রায়ের সঙ্গে ত়াঁর বিবাহ হয় । তিনি ছিলেন ব্রাম্ভসমাজ ভূক্ত। ছোট্ট সহধর্মিণীকে ধীরে ধীরে যোগ্য সহকর্মিণী করে তুলেছিলেন শ্রী প্রকাশচন্দ্র রায়। এক যাত্রার পৃথক ফল করেননি তাই আত্মীয় স্বজনের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে একুশ বছর বয়সী স্ত্রীকে ব্রাম্ভধর্মে দীক্ষিত করেন।
অঘোরকামিনী দেবীর স্বামী শ্রী প্রকাশ চন্দ্র পেশায় ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর প্রতিপত্তি , খ্যাতি , ধন , যশ , ইত্যাদির কথা কারোর অজানা ছিল না । উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির স্ত্রী রা সেই সময়েও নিঃসন্দেহে ফ্যাশন দূরস্ত ছিলেন , অহংবোধ ও তাদের কম ছিল না কিন্তু অঘোরকামিনী দেবী ছিলেন স্বতন্ত্র। নিজের জন্য বরাদ্দ অর্থের পুরোটাই তিনি সেবার জন্য খরচ করতেন। তিনি পরতেন সাধারণ মিলের শাড়ি । ওনার এমন পোশাক দেখে আড়ালে আবডালে অনেক চর্চা হত কিন্তু তিনি তা অগ্রাহ্য করতেন। কারওর কোন কটূ কথা কখনও তাকে প্রভাবিত বিচলিত বা করতে পারে নি। নিতান্ত সাধারণ জীবনের অধিশ্বরী এই মহিলা নিজের সুখ বিলাসিতা ছেড়ে জনকল্যাণ ও জনহিতকর কাজের মধ্যে সর্বদা নিজেকে নিমজ্জিত রেখেছিলেন।
মতিহার তারপর পাটনার বাঁকিপুর ছিল তাঁর স্বামীর কর্মস্হল। এখানেই তিনি সমাজসেবা মূলক কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে আবিষ্কার করেন।
অঘোরকামিনী দেবী বুঝে ছিলেন ‘ শিক্ষা ‘ আর ‘ পরনির্ভরতা থেকে মুক্তি ‘ এই দুটি দিক মেয়েদের জীবনে উন্মুক্ত দিগন্তের দিশারী দেখাতে পারে তাই সবার আগে চাই উপযুক্ত শিক্ষা। এই বোধোদয় থেকেই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে পাঁচ সন্তানের জননী হয়ে নিজের সংসার এবং সন্তানদের বাঁকিপুর গ্রামে রেখে রওনা দিয়েছিলেন লক্ষ্ণৌ । শিক্ষিকা হিসাবে নয় গিয়েছিলেন ছাত্রী হিসাবে। ভর্তি হয়েছিলেন মিশনারি বিদ্যালয়ে । ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে শুরু করলেন বালিকা বিদ্যালয়ের কাজ অঘোরকামিনী দেবীর প্রবল ইচ্ছা শক্তিতে নতুন রূপে সেজে উঠলো বাঁকিপুর গ্রাম।
অঘোরকামিনী দেবী বহু নিরাশ্রয়কে আশ্রয়দান করেছিলেন যার মধ্যে পরবর্তীতে কেউ কেউ তার পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন। সেবার স্বার্থে নিজের গায়ের গয়না খুলে দিতে ও পিছপা হননি তিনি। তাঁর নারী শিক্ষার প্রয়াস ও পরোপকারিতার জ্বলন্ত শিখা মানুষকে আলোকিত করে তুলেছিল , ক্রমশ মুগ্ধ হয়ে উঠছিল নারী সমাজ। ক্রমে গড়ে উঠল স্ত্রীমন্ডলী , সেবক মন্ডলী , ব্রাম্ভ মন্দির আরও কতকি । তাঁর অটুট মনোবলে গড়ে উঠল আশ্রম।
সমাজ নিজে নিজে বদলায় না , ধীরে ধীরে সমাজকে বদলাতে হয় । সেই “চলো পাল্টাই ” এর এক নিরলস প্রয়াস ছিল তাঁর মধ্যে। বিভিন্ন জায়গা থেকে কুড়িটি দুঃস্হ মেয়েকে নিয়ে শুরু করেছিলেন মহিলা আশ্রম। মাতৃত্বের জ্ঞানে সেই কন্যাতুল্য মেয়েদের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন তাঁর স্নেহ বিগলিত বক্ষে। তিনি বুঝেছিলেন শিশুর জীবনে ‘মা’ হল প্রথম ও প্রধান শিক্ষা গুরু তাই প্রতিটি মা শিক্ষিত না হলে সমাজ শিক্ষিত হয় কি করে।
ধীরে ধীরে এই নারী হয়ে উঠেছিলেন অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারিনী। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র শ্রী বিধানচন্দ্র রায় মায়ের ইচ্ছা পূরণ করে চলেন। নিজ বাসভবন টিও তিনি মার নামে নার্সিংহোমের জন্য দান করে দেন। পরবর্তীতে অঘোরকামিনী দেবীর নামে বহু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শ্রীমতি অঘোরকামিনী রায় ছিলেন এক সেবা – মনোভাব বিকশিত আলোর দিশারী। ভ্রান্ত- পুরানো – জীর্ণ – ভাঙাচোরা চিন্তাধারাকে অভিনবরূপে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে নিয়োজিত প্রাণ। কখনও তিনি নিজের দিকে তাকাননি। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে চিৎকার করে সমাজ কাঁপিয়েছেন। ঔদাসীন্য কে ছাপিয়ে নারী জাগরণের ভবিষ্যৎ ভাবনার স্বপ্নকে বাস্তব করতে তাঁর অবদান তুচ্ছ নয়। তাঁকে চিরন্তনী করার প্রয়াসে তাঁর ভূমিকাকে আজ বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। শ্রীমতি অঘোরকামিনী রায়ের অদম্য মনোবল , সহনশীলতা , ত্যাগ ও সেবা পৃথিবীর মানুষের কাছে শ্রদ্ধায় চিরস্থায়ী হোক । কেবল নিঃশব্দ কান্নায় অবরুদ্ধ হয়ে নয় নারী জাগুক অগ্নিকন্যা হয়ে , দহনের মধ্য দিয়ে করুক আগামীর শুদ্ধ সৃজন ।