শিরোনাম-বাঙালির লোকসংস্কৃতিতে যাত্রা ও পাঁচালিগান। সৃষ্টিতে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
শিরোনাম-বাঙালির লোকসংস্কৃতিতে যাত্রা ও পাঁচালিগান।
সৃষ্টিতে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
প্রত্যেক ভাষার এমন কয়েকটি বহুগুণব্যঞ্জক শব্দ আছে এক কথায় যাদের সুস্পষ্ট অর্থ প্রকাশ করা বেশ কঠিন কাজ।”সংস্কৃতি”কথাটি এই জাতেরই একটা শব্দ।যার ইংরেজি অর্থ কালচার।ল্যাটিন “কালটুড”-শব্দটি যার উৎস।”কালটুড”বা “কালচার”এর মানে হ’ল কর্ষণ;জমি যত ভালভাবে কর্ষণ করা হবে,ফসল তত ভাল হবে।কর্ষণ থেকেই কৃষ্টি বা সভ্যতা অর্থাৎ সংস্কৃতি।এর ব্যাপক অর্থ হল,–জাতির প্রতিভা ও চিৎপ্রকর্ষের বহিঃপ্রকাশ,মানসচর্চা,ভাব ও কর্মসাধনার বাস্তব রূপ।সুতরাং সংস্কৃতি বলতে বুঝতে হবে কোন বিশেষ জাতির মানসপ্রকৃতি,ঐতিহ্য,সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান,ধর্মীয় রীতি,শিশ্প-সাহিত্য এমনকি রাজনীতি পর্যন্ত।বাঙালির অন্তরতর জীবনের সামগ্রিক পরিচয়টির ধারক ও বাহক তার সংস্কৃতি।
বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়।(1)প্রাচীন যুগ,-খৃষ্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত।(2)মধ্যযুগ,-দ্বাদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এবং (3)আধুনিক যুগ,-অষ্টাদশ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত।ক্রমবিকাশের ধারাপথে বাঙালির সংস্কৃতি ঐতিহাসিক কারণেই মুসলমান সংস্কৃতিরও ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছে।সুতরাং বাঙালির সংস্কৃতির ইতিহাস হিন্দু,মুসলমান ও য়ুরোপীয় সংস্কৃতির মিশ্রণ,সংঘাত ও সমন্বয়েরই ইতিকথা।
বাঙালির সংস্কৃতির সর্বোত্তম বিকাশ ঘটে মধ্যযুগেই। মানসিক,আধ্যাত্মিক ও কলাগত সংস্কৃতির পর্যায়ে পড়ে নানা কাহিনী ও উপাখ্যান।রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদ ছাড়াও বৈষ্ণব গীতিকবিতা,শাক্ত পদাবলী ইত্যাদি মধ্যযুগের আগেই আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছিল।
বাংলা গানের দেশ।কত বিচিত্র ভাবের গান বাংলায় উদ্ভূত হয়েছে।-কীর্তন,শ্যামাসংগীত,আগমনী প্রভৃতি ভক্তিরসের গান থেকে শুরু করে বাউল,ভাটিয়ালী,গাজির গান,সারিগান,টপ্পা টপ,ঝুমুর,খেমটা,খেউড়,আখড়াই,হাফ আখড়াই ইত্যাদি।তা ছাড়া আঞ্চলিক বিভিন্ন উৎসব–ছৌনাচ,টুসু ভাদু প্রভৃতি তো আজও তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।আমোদ প্রমোদের অঙ্গ ছিল তর্জা,কবিগান,যাত্রা পাঁচালি।
যাত্রা ও পাঁচালি সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক।যাত্রা শব্দের মূল অর্থ,দেবতার উদ্দেশ্যে বিশেষ প্রকারের জনসম্মেলন।এ থেকে ক্রমশ নাটগীত।প্রাচীন যাত্রায় গানের সমাহারে কৃষ্ণলীলাই ছিল যাত্রার প্রধান বিষয়।শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা-কৃষ্ণ-বড়াই,নারদ কে নিয়ে যাত্রার আদিরূপটি ফুটিয়ে তোলা হত।যাত্রার সংলাপ,ঘটনার বর্ণনা,মনের ভাব প্রকাশ সবই গানের মাধ্যমে প্রকাশ করা হত।ক্রমশ স্থানে স্থানে গদ্যে উক্তি প্রত্যুক্তির সন্নিবেশ ঘটতে থাকে। প্রাচীন পালাকারদের মধ্যে কৃষ্ণকমল গোস্বামীর স্বপ্নবিলাস,নিমাই সন্ন্যাস,রাই উন্মাদিনী খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।সেকালে যাত্রা গায়কদের মধ্যে গোবিন্দ অধিকারী,বদন অধিকারী,লোচন অধিকারী,পরমানন্দ অধিকারী প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাবধর্মী সংকেতপ্রধান নাটকে কোথাও কোথাও প্রাচীন যাত্রারীতি ব্যবহার করেছেন।
অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে বাংলাদেশে কবিগান,টপ্পা,আখড়াই এর মত আর এক জাতের গান প্রচলিত ছিল,নাম-“পাঁচালি।”এর উদ্ভব কী থেকে তা বলা কঠিন।ডক্টর সুশীলকুমার দে বলেছেন যে,”পদচালন”কথাটি থেকে হয়তো “পা-চালি”এবং তা থেকে শব্দের রূপ পরিবর্তনে পাঁচালি কথাটির উদ্ভব হয়েছে।তিনি আরও বলেন যে “নাচাড়ি”শব্দ থেকেও পাঁচালির উদ্ভব সম্ভব।পায়ে হেঁটে দেশে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াতেন পাঁচালি শিল্পীর দল।নৃত্য গীত ও আবৃত্তি নিয়েই পাঁচালি।দলে একজন মূল গায়ক পায়ে নুপূর পড়ে,হাতে চামর নিয়ে ছড়া কাটতেন ও গান করতেন।তাঁর অভিব্যক্তিতে কিছুটা অভিনয়ের ঢং এসে যেত।আদিতে পাঁচালির প্রিয় বস্তু ছিল পৌরাণিক কাহিনী,যাতে মূলত ছিল ভক্তিরসের প্রাধান্য।অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে আধুনিক কাহিনী অবলম্বনে পালা রচিত হতে লাগল।
জেনে রাখা দরকার আগে রামায়ণ,মহাভারত,মঙ্গলকাব্য সবই পাঁচালির ঢংএ আসরে গীত হত এবং এই সমস্ত পদ্য রচনার নামও ছিল পাঁচালি।শনির পাঁচালি,মনসার পাঁচালি,ষষ্ঠির পাঁচালি এমনকি পীরের পাঁচালির কথাও শোনা যায়।কিন্তু আমাদের আলোচ্য বিশেষ শ্রেণীর পাঁচালি এগুলো নয়।অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকেই বাংলা কাব্যে এই বিশেষ শ্রেণীর পাঁচালির আত্মপ্রকাশ।
পাঁচালি রচয়িতা হিসেবে সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন দাশরথী রায়।তিনি প্রথমে কবির দলে যোগ দিয়েছিলেন।পরে নিজেই পাঁচালি লেখায় হাত দেন।গানের অপূর্ব অনুপ্রাস ঝংকারে এবং সুরমাধুর্যে দাশরথী একদা বঙ্গদেশকে মাতিয়ে রেখেছিলেন।পল্লী অঞ্চলে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও দাশু রায়ের গান শোনা যেত।এখনো যায় কিনা জানিনা।পরবর্তীকালে রসিক রায়,নবীন চক্রবর্তী প্রভৃতি পাঁচালিকারেরা যথেষ্ঠ খ্যাতি অর্জন করেন।কবিগানের জনপ্রিয়তা কিছুটা কমে এলে পাঁচালি সর্বসাধারণের আকর্ষণের বস্তু হয়ে ওঠে।রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন বাল্যকালে দাশরথীর গান শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে যেতেন।-“রামায়ণ”আবৃত্তি হচ্ছে,এমন সময়ে তাঁর পিতার অনুচর কিশোরী চাটুয্যে কেমন করে গান শোনাতেন রবীন্দ্রনাথ ছড়ার ছন্দে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
-“কিশোরী চাটুয্যে রোজ জুটত সন্ধ্যা হলে,
বাঁ হাতে তার থেলো হুঁকো,চাদর কাঁধে ঝোলে।
দ্রুত লয়ে আউড়ে যেত লব-কুশের ছড়া,
থাকত আমার খাতা লেখা পড়ে থাকত পড়া।
মনেমনে ইচ্ছে হত যদিই কোনও ছলে,
ভর্তি হওয়া সহজ হত ঐ পাঁচালির দলে।
ভাবনা মাথায় থাকতো নাকো ক্লাসে ওঠার দায়ে,
গান শুনিয়ে চলে যেতেম নতুন নতুন গাঁয়ে।”–
-“কৃত্তিবাসের সরল পয়ারের মৃদুমন্দ কলধ্বনি কোথায় বিলুপ্ত হইল,অনুপ্রাসের ঝকমকি ও ঝংকারে আমরা একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম।”-
1825 সাল থেকে 1860 সালের মধ্যে পাঁচালি ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও প্রসার লাভ করেছিল।বাংলা লোকসংস্কৃতির একটি বিশেষ গৌরবের বিষয় এই পাঁচালিগান।
বাংলা সংস্কৃতির এই লুপ্তপ্রায় অধ্যায়টি এখনও কিন্তু সগর্বে বিরাজমান বাঙালির ঘরে ঘরে প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পাঁচালির মধ্যে।