সহেলীর সাথে সমূদ্র সৈকতে —- কোয়েলী ঘোষ

সহেলীর সাথে সমূদ্র সৈকতে

কোয়েলী ঘোষ

শান্ত নির্জন সমুদ্র সৈকত অপেক্ষায় ছিল একটা ঝড় আসবে — ” জাওলাদ ” । মাছ ধরা ছেড়ে ট্রলারগুলো ফিরে এসেছিল তীরে । টিভিতে চোখ রেখে বাড়ির লোকের একটা আশঙ্কা তো ছিলই । কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্রী সহেলীরা কেউ নয় , এ যেন “ঝড়কে আমি করব মিতে ডরব না তার ভ্রুকুটিতে ” …

তেরোজন সহেলী নিয়ে গাড়ি দমদম থেকে ছাড়ল সকাল ছটা নাগাদ আর বালিঘাট থেকে সবশেষে আমি উঠলাম ।
” আমাদের যাত্রা হল শুরু এবার ওগো কত ওই কর্ণধার তোমারে করি নমস্কার ”
কর্ণধার সুস্মিতার পুঁটলি থেকে উঁকি দিয়ে বললো – ” এই তো আমি তো সাথেই আছি । ” দেখি ছোট্ট গোপাল কোলে বসে আছে ।
শুরু হলো সকালের গান , ভজন, রজনীকান্ত .. । অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হলো । গাড়ি চলছে বৃষ্টি ভেজা পথ ধরে ।

পথে কোলাঘাটের আগে একটা হোটেলে নেমে আমাদের ব্রেকফাস্ট চা খাওয়া হলো । তপতীর ব্যবস্থাপনায় কেক ডিমসেদ্ধ , কলা , মিষ্টি সব বাড়ি থেকে এসেছিল । শুধু চায়ের অর্ডার দেওয়া হল ।

গাড়ি আবার ছাড়ল । কোলাঘাট , কাঁথি পেরিয়ে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা রাস্তা পেরিয়ে এসে আমরা পৌঁছে গেলাম বগুরাণ জলপাই । এখানে একটাই থাকার জায়গা , ” নিরালা রিসর্ট ” আগেই তপতী বুক করে রেখেছিল ।
ঝাউয়ের সারি , সাজানো ফুলের মেলা দেখেই মন ভরে গেল । হোটেলের ঘর , বাথরুম সবই বেশ ভালো ব্যবস্থা । রিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে । আমরা লুচি , তরকারি জলখাবার খেয়ে রওনা হলাম সমুদ্র সৈকতের দিকে ।

একটাই পথ চলে গেছে সমুদ্রের দিকে । দুপাশে কলা গাছের সারি , মোচা ঝুলছে । বেগুন ক্ষেতে বেগুল ফলেছে । নারকেল , নিম , আম , চালতা গাছ পেরিয়ে চলার পথে কয়েকটি টিনের চালের ঘর , ফুটে আছে হরগৌরী ফুল , গ্রাম বাংলার এই দৃশ্য দেখতে দেখতে দেখা গেল সারি সারি ঝাউ গাছ । ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি ঝরছে । দুরে সাগর দেখা যায় ।

সাগর ডাকে আয় –আয় —আয় —
কিন্তু সাগর কোথায় ? কত দূরে ? জোয়ার আর ভাটার টানে সাগর কাছে আসে আবার দূরে সরে যায় । মান অভিমান নিয়ে থাকে বোধহয় ।
সারি সারি লাল কাঁকড়া একবার উঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ে গর্তে।


ওদিকে ফটোসেশন শুরু করেছে মেয়েরা । নানা পোজ দিয়ে নায়িকার মত ছবি , ভিডিও তোলা হলো ।
সবচেয়ে ক্ষুদে সদস্য স্বাতীর ছোট ছেলে লিও বৃষ্টিতে ভিজে বালি নিয়ে খেলা শুরু করে দিয়েছে ।

কয়েকটি চায়ের দোকান একপাশে । সামনে রঞ্জিতের চায়ের দোকানে গরম চা খেয়ে সবাই রিসর্টে ফিরে এলাম ।
অর্ডার আগেই করা ছিল । এত খাওয়ার আয়োজন ! এত বড় বড় কাঁকড়া , পমফ্রেট , যার যেমন অর্ডার সেইমত খাবার এসে গেল ।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা নিজেদের ঘরেই গল্প গুজব , গান ইত্যাদি করে সময় কাটিয়ে দিলাম । বিকেলে চা , সন্ধ্যায় কফি , পেঁয়াজি , বেগুনি সহযোগে খেলা হলো । খেলা মানে ছোট ছোট চিরকুটে যা উঠে আসবে তাই নিয়ে কথা , গান , নাচ … অনাবিল এই আনন্দে মনের কথা , লুকানো কথারা বেরিয়ে পড়ল ।

পরদিন ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে । বাইরে বেরিয়ে দেখি ঝড় বৃষ্টি কিছুই নেই । হেলেদুলে রাজহাঁস চলেছে পথে ।
গরমজলে স্নান সেরে আবার সমুদ্রের টানে সেই পথে —
তখন পথে কাজের তাগিদে মানুষ জন বেরিয়ে পড়েছে । হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই দূরে যেখানে
সাগরের তীরে মানুষ জন ছোট ছোট বাগদা চিংড়ি ধরে হাঁড়িতে রাখছিল । এগুলো ওরা চাষ করে বড় করবে ।
ওদের জিজ্ঞাসা করে জানলাম , অনেক দূরে গেলে মাছ পাওয়া যায় , কাঁকড়া , ইলিশ , পমফ্রেট সবই মেলে । মাছ ধরা ওদের পেশা ।
ঝড় আসে । বিধ্বস্ত হয় সাগরের তীরের মানুষজন । জেনে নিই তাদের কথা । জলে সব ভেসে গেলে ওরা আশ্রয় নেয় তিনতলা আশ্রয়স্থলে ।

সমুদ্র তখন ছুটে আসছে । বাঁধা নৌকোগুলো তখন দুলছে । ছুটে গিয়ে জলে ভেসে আসা শুভ্র শঙ্খটি কুড়িয়ে নিলাম , সাগরের উপহার ।

ফিরে এসে জলখাবার খেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে আমরা গাড়িতে বসলাম ।


এবারের গন্তব্য বাকিপুট আর কপালকুণ্ডলা কালীমন্দির । পথ বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত । প্রায় তিরিশ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে আসার পর বাকিপুট সমুদ্র সৈকতের দেখা পাওয়া গেল ।
চারিদিকে বোল্ডার , দীঘার মত কালো পাথর ছড়ানো । সমুদ্র এখানে অনেকটা উচ্ছ্বল , বিস্তৃত । ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পাথরে । আবার কিছু ছবি তোলা হল তারপর গাড়িতে গিয়ে বসলাম ।

গাড়ি এগিয়ে চললো কপালকুণ্ডলা কালীমন্দিরের দিকে । কিছুক্ষণ পর দেখা গেল মন্দিরের চূড়া । স্থানীয় একজন জানালেন এখানেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন বিখ্যাত ” আনন্দ মঠ ” উপন্যাস । একটি কালীমন্দির , একটি শিবদুর্গা মন্দির । প্রণাম জানিয়ে বাইরে এসে দেখলাম সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবক্ষ মূর্তি ।
এবার ঘরে ফেরার পালা । ফেরার পথে আবার শুরু হলো গান ।
দুদিনের এই উজ্জ্বল আনন্দস্মৃতি , সহেলীদের আন্তরিক ভালোবাসা পথের সঞ্চয় হয়ে রইল । আর খোলা হাওয়ায় অনেকটা অক্সিজেন নিয়ে ঘরে ফিরলাম ।
অকৃত্রিম ভালোবাসা আর শুভেচ্ছা সহেলীদের জন্য যাদের ভালোবাসায় দুদিন আনন্দে কাটালাম । অসংখ্য ধন্যবাদ আর ভালবাসা নিরালা রিসর্ট এর সেই ছেলেদের যাদের সরলতায় সহযোগিতায় মুগ্ধ হয়েছি ।

ভালো থেকো সাগর , নিঃসীম নীল উদাস
মুক্তির ডানা মেলে উড়ে চলা পাখি ,
ঝাউবন আর প্রিয় মানুষ স্বজন ।

  1. পথের ঠিকানা – ট্রেনে কাঁথিতে নেমে অটো বা টোটো করে আসা যায় ।
    বাসে কন্ট।ইতে নেমে আসা যায় কিংবা গাড়িতে এলে কাঁথি এসে পথ জেনে নেবেন ।
    কাছাকাছি দীঘা , মন্দারমণি কিংবা তাজপুর থেকেও ঘুরে আসা যায় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *