গল্পঃ – স্বার্থক ভালোবাসা লেখক – আবু ওবাইদুল্লা আনসারী
গল্পঃ – স্বার্থক ভালোবাসা
লেখক – আবু ওবাইদুল্লা আনসারী
সময়সীমা:-২ ৮অক্টোবর,২০২১
“আমার ভিতর ও বাহিরে অন্তরে অন্তরে,
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে………..”
ইছামতী নদীর ধারে বসে রূপম এই ভাবেই এক মনে গেয়ে চলছে, এ গান তার অত্যন্ত প্রিয়, এটি তার নিত্য অভ্যাস,অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই এই ভাবে নদীর ধারে বসে একাকী বসে থাকে সে।
আজ হঠাৎ কেউ যেন পিছন থেকে এসে নরম হাতে তার চোখ ধরে বসল,এই হাত তার অজানা নয়,না এই অভ্যাস,এই স্মৃতি গুলিই বুকে নিয়েই সঙ্গে রূপম একাকী বসে থাকে,রূপম অতীতের সেই দিনগুলিতে নিজেকে ডুবিয়ে ফেলে,
কেমন আছো”,
শ্রদ্ধার সেই পরিচিত কণ্ঠস্বরে রূপমের ঘোর কাটে,নিজেকে সামলে বলে,
–এই তো চলে যাচ্ছে বুনো,
ভালোবেসে শ্রদ্ধাকে রূপম বুনোফুল নাম দিয়েছিল, আর সংক্ষেপে বুনো বলে ডাকত,
—তুমি এখনও এখানে আসো?
আসি ,এখানে আসি বলেই ভালো আছি,এখানে আসি বলেই তো বেচেঁ আছি।
— এখন ভালোবাসো আমায়,
— জানি না!
— আমি জানি তুমি এখনও ভালোবাসো, শুধু আমার জন্যই এখানে আসো, এখনও তোমার প্রতি কবিতায় আমি বিরহের ছাপ খুঁজে পাই, তোমার প্রতি আবেগে আমার শুন্যতা, চোখে আমি দেখতে পাচ্ছি আমার প্রতীক্ষা।
—তাই , এখনও তুমি আমার কবিতা পড়,সে যাই হোক হঠাৎ এখানে কী মনে করে?
—কেন আসতে পারি না?
জিজ্ঞাসা করবে না আমি কেমন আছি?
–জিজ্ঞাসা করার অধিকার আমি অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি,আর ভালো থাকবে বলেই তো আজ থেকে ২ বছর ৩ মাস ২৪ দিন আগে তুমি আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে,সেদিন তোমার চোখে দেখেছিলাম এক ভয়ঙ্কর ক্ষুধা, সারা পৃথিবীর সমস্ত সুখ ভোগ করতে চেয়েছিলে,চোখেমুখে ছিল
ভালোথাকার প্রতিজ্ঞা,আমার বেকারত্বের একঘেয়েমি জীবন ছেড়ে তুমি ধরেছিলে অন্যহাত,ভালোথাকার অঙ্গীকার নিয়ে,
–থাক না ওই সব কথা,
এই ভাবে একাকী কীভাবে থাকো,আগে তো থাকতেই পারতে না,আমি একটু দেরি করলে,এখন বোরিং ফিল হয় না।
—-একা…(হাসতে হাসতে),একা তো নয় প্রিয়,
আমি আজও একা থাকতে পারিনা,
আমার সাথে আছে হাজার হাজার স্মৃতি,তোমার সাথে কাটানো প্রতি মুহূর্ত,প্রতি উপেক্ষা,প্রতি অবজ্ঞা,আছে কত স্বপ্ন কীসের একা,মানুষ কখনওই একা থাকতে পারে না, কক্ষনও না! কালের বিবর্তন এই ভাবেই একাকী মানুষদের পাশে দাঁড়ায়,অথচ একটা সময় ছিল সবাই কাছে থেকেও আমি সেদিন একা ছিলাম।
আসলে জনতার মধ্যেই একাকীত্ব লুকিয়ে থাকে প্রিয়,সঙ্গতার মধ্যেই নিঃসঙ্গতা।
—-এত অভিমান করে নিজের জীবনটাকে শেষ করে দিচ্ছ কেন,নতুন ভাবে গুছাতে পারো না।
—-কীসের অভিমান,কীসের জীবন শেষ?
অভিমান করার জন্য একটা মানুষ দরকার,যে অভিমান ভাঙিয়ে দিবে,আমার কি কেউ আছে , কার ওপর অভিমান করব বলতে পারো?
—কেন আমার ওপর!একদিন আমারই ওপর তুমি অভিমান করতে,আজ থেকে আবার আমার ওপর অভিমান করো।
—সেটা সম্ভব নয়,
আসলে কি জানো!ভালোবাসার প্রিয় মানুষটি যখন আর নিজের কাছে থাকেনা,তখন থাকে না কোনো অধিকার,রাগ ,অভিমান করার সুযোগ।
—কেন সম্ভব নয়, আমাকে কি ক্ষমা করা যায়না?
— ক্ষমা,ক্ষমা তো আমি অনেক আগেই করে দিয়েছি।
–তবে কেন?
তবে আজ যদি আমার সেই ভালোবাসা তোমার কাছে অভিমানের আশা করে তবে কেন নয়।
— কোনটা ভালোবাসা প্রিয়,তুমি ভালোবাসা আর মোহের সীমাবদ্ধতায় আটকে গিয়েছ,
ভালোবাসা বড়ই কঠিন , যাঁর শেষ নাই, যাঁর ধ্বংস নাই,সৃষ্টি থেকে ধ্বংস পর্যন্ত চিরস্থায়ী থেকে যায়।
আমরা ভালোবাসা মানেই বুঝিনা, জানো ! আমাদের এগুলি সব অভিনয়,সব মোহ,কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা,সাথে থাকার আকাঙ্ক্ষা,ভালোবাসা কোনোদিন হারে না,অথচ আমাদের ভালোবাসা সবসময়ই হেরে যায় আমাদের চাহিদার কাছে,শেষ হয়ে যায় পরিস্থিতির চাপে।
—আজ কিন্তু আমি নিজেই তোমার কাছে এসেছি,তুমি কিন্তু নিজেই তোমার ভালোবাসাকে হারিয়ে দিচ্ছ, আমাকে হারিয়ে ফেলছ।
–হারানোর কী আছে বুনো?
কবে তুমি ছিলে আর কবে তুমি হারিয়ে গেছ সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও পায়নি,তাই নতুন করে তোমাকে হারার কোনো প্রশ্নই উঠেনা?
যেদিন তুমি আমার দুর্বলতাকে প্রশ্ন করে ছিলে,যেদিন তুমি আমার বেকারত্ব কে কাঠগোড়ায় দাঁড় করেছিলে,যেদিন তুমি অপমান করেছিল আমার দারিদ্রতাকে সেদিনই তুমি হারিয়ে গেছ।
আর একটা কথা সত্যিই করে বলতে পারবে,আজ যদি আমি চাকরী না পেতাম,এখনও আগের মতো বেকার থাকতাম,এখনও যদি আগের মতো একই জামা পরে তোমার সাথে যেতাম,অভুক্ত হয়ে কেটে যেতে আমাদের ডেটিং,যেখানে অন্য ছেলেরা নামি দামি ব্র্যান্ডের পোশাক পরে তোমার জন্য অপেক্ষা করত শহরের সেরা সেরা রেস্তোরাঁয়, তবে কি তুমি আমার কাছে আসতে?
—তবে আমাদের বিচ্ছেদের পর তুমিই তো অনেক কান্না করেছিলে, কতদিন আমার পথ আগলে আমাকে ফিরে আসতে বলেছিলে।
—সেদিন ভুল করেছিলাম,সেদিন ভেবেছিলাম হয়তো তোমাকে ছাড়া বাঁচব না,কিন্তু সময় আমাকে নতুন করে গুছিয়ে দিয়েছে,নতুন করে সব শিখিয়েছে,এখন আর তোমাকে কাছে পেতে চাইনা।
—-আমার ভুল হয়ে গেছে। নতুন ভাবে কি সব শুরু করে যায় না,আমাদের প্রথম ভালোবাসা কি এই ভাবেই অপূর্ণ থেকে যাবে।
আমাদের নয় আমার প্রথম ভালোবাসা।
সেটাই যদি আজ আমি তোমাকে পূর্ণতার স্বাদ দিই তবে,
(অট্টহাসিতে বলে উঠে)”the important things of first love is not winning but keeping that emotional alive until you die”
—ক্ষমা করে দাওনা আমায়,তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব,তোমার পায়ের কাছে একটু জায়গা হবে না,?
—যে মানুষ বুকের মধ্যে হাঁসফাঁস করে,সে পায়ের কাছে থাকবে কেমন করে বিশ্বাস করব,আর আমি তো চাইনি কোনোদিন তোমাকে আমার আজ্ঞার দাসী করে রাখতে। এখনও আমি তোমায় ভালোবাসি,আমার মনের মধ্যে এখনও তোমার অবাধ বিচরণ কিন্তু তুমি নয় আমি যেই তুমিকে ভালোবেসেছিলাম,
রাত অনেক হয়ে এল চলে তোমাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
—কেন তোমার কাছে থাকতে দিবে না?
—সবকিছু নিজের হাতে থাকে না বুনো, তোমার থাকা না থাকা সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার,কিন্তু আমার সাথে নয়,আমার জন্য আরও অনেকেই অপেক্ষা করছে, যাঁরা আমার সবসময়ই পাশে ছিল সেই নদীর স্রোত,মাটির গন্ধ,মৃদু হওয়া।
ওই আকাশের তারাগুলি দেখ মেঘের সাথে লুকোচুরি করছে তারা আমার জন্য অপেক্ষা করছে, ঝিঁ ঝিঁ পোকা গুলি হয়তো রাগ করেছে এখনও গান গাইছে না,তুমি চলে যাও তোমার গন্তব্য স্থলে ভালোথাকার ক্ষুধা নিয়ে,তুমি ভুল জায়গায় এসেছ ,এখনও তোমার চোখে ভালো থাকার প্রতীক্ষা দেখতে পাচ্ছি, আর হ্যাঁ কাল থেকে আর আসবে না।
—ঠিক আছে,ভালো থাকো,
এই ভাবেই শ্রদ্ধা চলে যায়,রূপম শ্রদ্ধার চলে যাওয়া দেখতে থাকে,বুকটা ধড়ফড় করে উঠে,
ভাঙা হৃদয় থেকে কে যেন বলে উঠে তুমি যেও না,
রূপম আবার নিজেকে সমস্ত অবসাদ কাটাতে প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেয়,
ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান ধরে,
“ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো……”
এইভাবেই রূপম তার প্রথম ভালোবাসাকে স্বার্থক করে তুলে,সফল তো অনেকেই করে থাকে কিন্তু চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণ না দিয়ে কজন ভালোবাসাকে স্বার্থক করে তুলে।
রূপম আবার বিড় বিড় করে বলতে থাকে,-
“Important things of first love is not winning but keeping that emotional alive until you die”
রূপমের চোখ দিয়ে দু এক ফোঁটা জল গড়িয়ে নদীর জলে নদীর স্রোতের সঙ্গে মিশে যায়,রুপম এক মনে সূর্যাস্ত দেখতে থাকে,শুধু সূর্যাস্ত নয় সূর্যাস্তের গর্ভে থাকা সূর্যোদয়ও ।