চলচ্চিত্রধর্মী বাংলা সাহিত্যের শিল্প আঙ্গিক (প্রথম পর্ব) —- নীলাঞ্জন ভৌমিক
চলচ্চিত্রধর্মী বাংলা সাহিত্যের শিল্প আঙ্গিক (প্রথম পর্ব)
নীলাঞ্জন ভৌমিক
চলচ্চিত্র আর কাহিনী চিত্র সমার্থক না হয়েও কোথায় যেন একটা আত্মিক যোগ আছে । চলচ্চিত্রের নিত্য নতুন আঙ্গিকের নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে সাহিত্যের ওপর কাহিনী চিত্রের চিত্রনাট্যের প্রাথমিক নির্ভরতা এখনো জরুরি। যেকোন সাহিত্য কর্মের চলচ্চিত্রগত বিশ্লেষণ করার সময়ে, চলচ্চিত্র তার প্রয়োজনে মূল সাহিত্যের অংশ বিশেষ, তার বৈশিষ্ট্য, প্রেক্ষিত, চরিত্র, প্রকৃ্তি ও প্রতিমাপুঞ্জকে কাজে লাগাবে, এটাই দস্তুর । কোন চিন্তাশীল পরিচালকের হাতে যখনই সাহিত্যের চিত্রণ হবে, ফারাক আসবে বিস্তর । সম্পূর্ণ অনুসরণ তো দূরের কথা, হয়তো অনেক সময় যথেষ্ট অনুসরণও হবে না । অথচ সম্পর্কের এই ধরণ দেখে এটা কিছুতেই ধরতে পারা যায় না, যে কোনো একক দৃশ্যের বা সমগ্র ছবিরই ভাববস্তু বা প্রতীতি সবচেয়ে মননশীল ভাবে পাওয়া যেতে পারে সাহিত্যেরই কাছ থেকে ।
সাহিত্যের মতো বিশ্লেষণ ক্ষমতা চলচ্চিত্রের নেই । তবু সে সাহিত্যের কাছ থেকে বর্ণনার চেয়ে অনেক বেশী কিছু গ্রহণ করেছে । কাল থেকে কালান্তরে গমন, চিত্রপ্রতিমার ধীর ধারাবাহিক বিন্যাস, গতি ও ধ্বনির প্রকাশ বিকাশ, প্রতীকের ব্যবহার, বিমূর্তের মূর্তায়ন আর এইসকল প্রয়োগ কৌশল নিরপেক্ষ এক অখন্ড চিত্রচেতনা আর সে বিষয়ে আমাদের ধারণা গুলি কিন্তুআদতে সাহিত্য থেকেই পাওয়া । তাই চলচ্চিত্রের জটিল যৌগিক শিল্পসত্তার মধ্যে যে শান্ত, সমৃদ্ধ, অন্তশীল রস প্রায়ই উঠে আসে তার সাথে সাহিত্যের যোগ অন্তহীন । চলচ্চিত্রের নিজ অঙ্গনে সাহিত্যের এই উদ্ভাস তাই যথাযথ ।
চলচ্চিত্র শিল্পে আঙ্গিকের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল বোধ । বোধ যদি স্বচ্ছ হয় কৌশল তবে তার আজ্ঞাধীন থাকে । চলচ্চিত্রবোধের ক্ষেত্রে কয়েকটি বৈপরীত্য ও সাদৃশ্যের কথা আসে । বাস্তব জীবনে ভাষা ভঙ্গি আচার আচরণে একজন ফোরম্যান ম্যানেজারের মতো হতে পারেন আবার একজন শ্রমিকের মতোও হতে পারেন । দ্বর্থবোধ চলচ্চিত্রের অন্যতম ভাব ব্যাঞ্জনা বৈপরীত্য বা কনট্রাস্টও যার অন্যতম স্বভাব-লক্ষণ । এই চূড়ান্ত ও বিমূর্ত চেতনা, অন্যদিকে কল্পনা – মনন – প্রবৃত্তি ও স্বজ্ঞা একই সঙ্গে চলচ্চিত্রের নিজস্ব স্থানকালবোধ, চিত্রপ্রতিমার শক্তি,স্থিতিস্থাপকতা ও ইন্দ্রিয়বেদিতার বিভিন্ন ধরণের সমবায়, সমন্বয় ও সংশ্লেষ এই ক্রিয়াশীল সম্যক বহুমাত্রিক বোধের জন্ম দেয় । সাহিত্যে যেমন ভাব থেকে ভাষা, ভাষা থেকে বোধ, এক অদ্ভুত ছায়াঘন বিমূর্ততা, চলচ্চিত্র যেন ঠিক তার বিপরীত স্রোতস্তর । ভাষার সেই বিমূর্ত বোধকে চিত্রভাষায় মূর্ত করা । অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের মতো চলচ্চিত্রেও স্রষ্টা আর উপভোক্তা এই বিপ্রতীপ সম্পর্কের সূত্রে আবদ্ধ ।
চলচ্চিত্রে সাহিত্যের মূল ভূমিকা তিনটি । সামান্যতায় অর্থব্যঞ্জনা, ঘটনা চরিত্রের প্রকৃ্তি আর বিমূর্তের মূর্তায়ন । কোন সাহিত্য কর্মের চলচ্চিত্র সম্ভাবনা ঠিক কি রকম, তা নির্ভর করে পরিচালকের নিজস্ব পছন্দ, বিবেচনা ও রুচির ওপর । সার্থক চলচ্চিত্রের কাজ হল জীবন, কাহিনী ও চিত্রভাষ সমন্বয়ে আমাদের তাৎক্ষণিক ও চিরন্তন ভাবনা, ধারণা ও অনুভূতি গুলোকে আরো সুন্দর বিন্যাসে প্রকাশ করতে পারা । সাহিত্যে যা আমাদের মানসচক্ষে প্রতিয়মান, চলচ্চিত্রে সেটাই বাস্তব । সেই অর্ধকল্পিত বাস্তবতা, সুনির্দিষ্ট ক্যামেরা ভাষা আর ভাবপটের চিত্রোপাদান এর সমন্বয়ে তাকে জলজ্যান্ত করে তোলা । সদা পরিবর্ত্নশীল জগৎকে ও মানুষের নিরন্তর জীবন সংগ্রামকে নতুন দৃষ্টিকোণ দ্বারা সমাজে প্রতিফলিত করার কাজে কাহিনী নির্বাচনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
এখানে মনে রাখা দরকার যে, শুরু থেকেই বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, এর প্রধান ভোক্তা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ।
বাংলার শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর একটি শ্রেণীরূপে উত্থান সাম্প্রতিক কালের ঘটনা । এমনকি আজকের দিনেও বাংলা চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষক প্রধানত মধ্যবিত্ত শ্রেণীই । আমাদের দেশের চলচ্চিত্র কিন্তু এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দর্শন এবং রুচিকে ধারণ করেই নির্মিত হচ্ছে । মনের কোন তন্ত্রী ধরে টান দিলে মধ্যবিত্তের হৃদয়ে ঘা লাগবে, নানান চলচ্চিত্রকার তার সেই চাবিকাঠি খোঁজার জন্য নানা ভাবে সাহিত্যের দরজায় মাথা খুঁড়ছেন অহরহ । হরিশচন্দ্র থেকে শুরু করে, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ … বিভুতিভূষণ আর শেষে সেই তামিল রিমেক । কখনো বাগাড়ম্বরপূর্ণ নৈতিক সংলাপ, কখনো সামাজিক সমস্যাবলীর স্থূল সমাধান, পারিবারিক গ্যাঞ্জাম, বিশেষত নারীর তীব্র ভোগান্তি, চরম দুঃখভোগ আর অবশেষে প্রবল পরাক্রমে জয়ী হওয়া এসবের কোনটাই সে অনুসন্ধান থেকে বাদ যায় না । আমরাও সেটাকে একটা স্বাভাবিক প্রয়াসের অঙ্গ বলেই ধরে নিয়েছি ।
আর আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতারা এসব বিষয় নিয়ে একের পর এক ছবি করেই চলেছেন ।
অথচ কোনো সাহিত্য নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলে সেই সাহিত্য যেমন যুগযুগ ধরে বেঁচে থাকে সেই সঙ্গে চলচ্চিত্রটির শিল্পমানও বজায় থাকে। যেমন অদ্বৈতমল্ল বর্মণের নদীমাতৃক অসাধারণ উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বহুকাল আগে লেখা । এইটি নিয়ে ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন বলে এখনো ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পাঠক ও দর্শকের কাছে দৃশ্যমান এবং হয়তো বেঁচে থাকবে আরো বহুকাল । এর শিল্পমান নিয়ে চলচ্চিত্র বোদ্ধাদেরও দ্বিমত নেই । কোনো সাহিত্য নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হলে সাহিত্যের দুই ধরনের লাভ হয় । প্রথমত আগের পাঠকের সঙ্গে যোগ হয় নতুন পাঠক আর দ্বিতীয়ত ছবিটির দর্শকরাও হয়ে যান সাহিত্যটির একনিষ্ঠ পাঠক । তাই সাহিত্য নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রথম শর্ত হচ্ছে ছবিকে অবশ্যই শিল্পমানসম্পন্ন ও সৃজনশীল হতে হবে । এ কথাও সত্য, সাহিত্য নিয়ে পৃথিবীর যে প্রান্তেই চলচ্চিত্র নির্মাণ হোক না কেন, ‘তরল আবেগসর্বস্ব মধ্যবিত্ত দর্শনই চলচ্চিত্রের বাজার ও মান নিয়ন্ত্রণকারী’ এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার সুচতুর প্রয়াস সেখানে থাকবে না । বাংলা সাহিত্যনির্ভর ছবির বেলায় একথা আরো বেশি সত্য ।