কান্না-হাসির-দোল-দোলানো / কলমে মহুয়া বৈদ্য
কান্না-হাসির-দোল-দোলানো /
কলমে মহুয়া বৈদ্য
পর্ব ২
জীবনের প্রথম পাঁচটি বছর একজন মানুষের খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। আজকের এই আমির সবকিছুই সেখানেই লুকিয়ে আছে। ছোটবেলার কতটুকু অংশে গান জুড়ে রয়েছে, সেটুকু তাই খুঁজে বের করতে চাইছি বার বার। কারণ, আমাদের পরিবারে গানের কোনো ঐতিহ্যগত পরম্পরা নেই। আমি এই পরিবারে গানের ক্ষেত্রে একেবারে ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে একেবারে নিম্ন মধ্যবিত্ত স্তর আমাদের। এখন যে এলিটিজম যে পরম্পরা ইত্যাদি ইত্যাদি গানের ক্ষেত্রে দেখি, তার কিচ্ছু নেই আমার। বিশেষত, রবীন্দ্রসংগীত বলতেই যে অভিজাত স্তর দেখতে পাই, ছোটবেলায় যদি সেসব বুঝতে পারতাম, আমার গান শেখা পালিয়ে যেতে পথ পেত না। ভাগ্যিস আমি রবীন্দ্রনাথকে ধুলোমাটিতে পেয়েছি… তিনি যে মানুষের কবি একথা বারবার বলতে শুনেছি বাবাকে। সহজপাঠের প্রতিটি শব্দে বাক্যে ভাগ্যিস তিনি আমাদের মতো অতি সাধারণের জীবন যাপন লিখে গেছেন! আমরা তো সত্যি সত্যিই মাটির দাওয়ায় বসে ভৌ ভৌ এর ডাক শুনতে শুনতে ক্ষীর খই না হোক, দুধ খই খেয়ে বড় হলাম। সেই জীবনে সরলতা ছাড়া আর বিশেষ কোনো রীতি ছিল না।
একেবারেই ছোটবেলায় প্রথম যে গানটি রবীন্দ্রসংগীত হিসেবে মায়ের গলায় গুনগুন করতে শুনতাম, সেটি ” আমার সকল দুখের প্রদীপ…”। আমাদের ছিল নিম্ন আয়ের সংসার। টাকার অভাব জীবন যাপনে নিত্য কিছু ব্যথা তৈরি করতে থাকে। সেসব ভেবে এ গান মা গাইতেন কিনা জানি না এবং তিনি গানটি ভুল কথায় গাইতেন। “আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিব জ্বেলে করব নিবেদন / আমার ব্যথার পূজা হয় নি সমাপন”… ভুল কথায় এই দুটি লাইন ই তাঁকে বার বার গাইতে শুনেছি আমি। খানিকটা বড় হওয়ার পর “কলকাতা ক” এ সকালবেলা গান শুনতে শুনতে প্রথম আমার কানে খটকা লাগে। আর, প্রায় একই সঙ্গে বাড়ির বই এর তাকে আমি একটি অতি জীর্ণ গীতবিতান ১ম খন্ড খুঁজে পাই। আমার ভ্রান্তি দূর হয়…” আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে, দিবস গেলে, করব নিবেদন…” তখন আমি ক্লাস সেভেন, আমি ধীরে ধীরে একা হচ্ছি…মায়ের সাথে এ নিয়ে আলোচনা আর হয় নি। সেসব কথায় পরে আসছি।
বুম্মিদের বাড়িতে একটি হারমোনিয়াম ছিল, বুম্মির ছোটমেয়ে ফতুদিদি তাতে কিছু গাইত মাঝেসাঝে, কী গাইত মনে পড়ে না। তবে ওদের বাড়িতে রিহার্সাল হত খুব, এটা মনে পড়ে। তখন বারুইপুরে প্রেক্ষণ ক্লাব নামে একটি ক্লাবের মেম্বার ছিল বুম্মির বড়ো ছেলে গোপালদাদা। এই ক্লাব টি তখন নিয়মিত মণিমালা ছাড়াও বেশ সুন্দর করে ২৩ শে জানুয়ারী, ২৬ শে জানুয়ারী, স্বাধীনতা দিবস এবং পুজোর ফাংশন পালন করত। এই সব অনুষ্ঠানের গানের রিহার্সাল হত বুম্মির বাড়িতে। ওরা হারমোনিয়াম, তবলা, খচখচি, মন্দিরা বাঁশি এসবকিছু নিয়ে বেশ জমাটি রিহার্সাল দিত। কে হারমোনিয়াম বাজাতেন মনে পড়ছে না, কিন্তু অত্যন্ত সুন্দর বাজাতেন তিনি। এত সুন্দর প্রিলিউড ইন্টারলিউট দিতেন… এতদিন পরে এখনো কানে বেজে উঠছে লিখতে বসে। খুব সম্ভবত কেঁদোদা বা এমন কিছু ডাকনাম ছিল তাঁর। রঞ্জনদা বাজাতেন বাঁশি। একখানা সুতির নরম কাপড়ের হাতে সেলাই করা সবুজ রঙের ব্যাগে তাঁর বাঁশি ভরা থাকত। মানাদিদি ফতুদিদি সন্ধ্যাদিদি নামে আর এক দিদি, আশিসদাদা, কেঁদোদাদা,গোপালদাদা সবাইমিলে দারুণ সুরেলা গলায় কোরাস গাইত। গানগুলির কথা আজ ভুলে গেছি, একটা দুটো মনে পড়ে…” আগে চল বাহিনী আগে চল বাহিনী মিছে ভয় পিছে পড়ে রয়/ঝঞ্ঝার মেঘ আজি উচ্ছ্বলিয়া উঠে দুরন্ত দুর্বার জয়” এমন কিছু ছিল গানের কথা। বিশেষত, ” দুরন্ত দুর্বার জয়” বলার পর হারমোনিয়াম তবলা খচখচি মন্দিরা মিলে একটা ঝমঝম হারমোনিকা হত সেটা খুব মনে পড়ে। আর একটি গান স্বাধীনতা দিবসের আগে গাওয়া হতই, ” উৎসর্গীকৃত দেশের তরে যাদের মহানাম/ বন্ধু আমরা গাইব আজি তাদের জয়গান” এরপর আ আ আ আ বলে বেশ সুন্দর একটা দোলা থাকত ষোলো মাত্রার, যেটা আমার খুব পছন্দের ছিল। এ গানের রিহার্সালে ” উৎসর্গীকৃত ” শব্দটি একসাথে বলার জন্য বারবার গাওয়া হত, খুব মনে পড়ে।
এ গানের একটি স্তবকে ক্ষুদিরামের কথা বলা ছিল, বাকী গান জুড়ে কাদের কথা বলা ছিল মনে পড়ছে না।
বুম্মিদের ঠিক পাশের বাড়িতে এক পূজারী ব্রাহ্মণ দাদু থাকতেন। আমি অসম্ভব ভালোবাসা পেয়েছি মানুষটির কাছ থেকে। হাতের কাছের ডালে দুটি আম ফললে তিনি একটি রেখে দিতেন আমার জন্য অপরটি তাঁর নাতনী ঝুমার জন্য। আমি দাদুর কাঁধে উঠে আম পাড়ছি একথা খুব মনে পড়ে। এইদাদু রোজ ভোরে অসাধারণ উদাত্ত কন্ঠে মন্ত্রপাঠ করে পূজা করতেন। ভোরে উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর সেই গমগমে সুরেলা উচ্চারণ আমি আবিষ্ট হয়ে শুনেছি। অনেকপরে সংগীতের ইতিহাসে সামগানের কথা পড়ে আমার তাঁর কথা খুব মনে পড়েছে। প্রণাম জানাই তাঁকে। জীবনে প্রথম মন্ত্রগান তাঁর কাছ থেকেই শোনা।
বুম্মির বাড়ি থেকে আমরা আমাদের দেশের বাড়ি রূপচাঁদনগরে, বাড়ি বানিয়ে চলে যাই। তখন আমি সবে শিশুশ্রেণী। বোনের বয়স ছয় মাস। বুম্মির বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার দিনটি আমি কোনোদিন ভুলবো না। বুম্মি, মানাদিদি, ফতুদিদি এরা এত ভালোবেসেছিলেন আমাদের যে বাড়িওয়ালা ভাড়াটের সম্পর্কের ব্যবধান ঘুচে গিয়েছিল। চলে আসার একসপ্তাহ আগে থেকেই মা আর বুম্মি কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেললেন। আমি তখন পাঁচ বছরের মেয়ে, মনে দুঃখবোধ আসে নি। মা বাবা সাথে থাকবে, সুতরাং ভয় নেই এমন একটা ভাব মনে, কেন বা এত কাঁদছে ওরা তা বুঝছি না। মানাদিদি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে, আমার খানিক অস্বস্তি হয়, হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে বলি, “আমি আসব তো, ঘুরতে আসব আবার”, বলে পালিয়ে যাই, ঝুমার সাথে মন্টুদাদার সাথে কিত্ কিত্ খেলতে চলে যাই। কিন্তু চলে আসার দিন সকালে কী আশ্চর্য এক ম্যাজিক ঘটে গেল। যথারীতি সকালবেলা, আমি ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছি। মা বোনকে সামলে গোছগাছ করছে, বাপি ভ্যানে তুলে জিনিসপত্র রওনা করিয়ে দিচ্ছে আর রেডিওর বিবিধভারতীতে শুরু হয়েছে গান। বুম্মির রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখি মানাদিদি আটা মাখছে আর চোখ মুছছে, বুম্মি আলু ভাজছে আর চোখ মুছছে। আমাকে দেখে বলল, “মুনি, এক্ষুনি রুটি নামাব, খেয়ে নেবে…” বুম্মির এই কথা বলতেও গলা কেঁপে যাচ্ছে। আমার কেমন অস্বস্তি হল, কী যে সেটা বুঝতে পারছি না। যাহোক করে মাথা নেড়ে চলে এলাম। মা দেখলাম বোনকে দুধ খাওয়াচ্ছে, আজ রান্নাবান্না এখানে হবে না, নতুন বাড়িতে গিয়ে হবে। আমাকে বলল বুম্মির কাছে খেয়ে নিতে। রেডিওতে তখনো কিছু একটা গান বাজছে আর আমার অস্বস্তি বাড়ছে। বুম্মি ডাক দিল, আমি গিয়ে মানাদিদির পাশে বসলাম,দেখি বুম্মির মুখ আঁচের আগুনের মতো লাল, আর ঠোঁটের পাশের বড় তিল, অই লাল মুখে যেন বড্ড বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মানাদিদি বাটিতে আলুভাজা দিল, আর বুম্মি আঁচ থেকে একটা ফোলা রুটি নামিয়ে দিল থালায়।
রুটির পেটে আঙুল দিয়ে ফুস করে খানিকটা গরম হাওয়া বের করে মানাদিদি একটু হাসতে চাইল। কেঁদে ফেলল। একটুকরো রুটি ছিঁড়ে আমি আলুভাজা দিয়ে মুখে দিলাম, আর রেডিওতে বেজে উঠল সেই গান…” চলো যাই চলে যাই দূর বহু দূর/ গায়ে মেখে জরি-বোনা সোনা রোদ্দুর”। আমার অসম্ভব কষ্ট হতে শুরু করল। এই প্রথম চলে যাওয়ার কষ্টে আমার দুচোখ ছাপিয়ে জল এল। রুটির দলা কষ্টের দলা হয়ে গলা যেন চেপে ধরল। আমি জীবনে প্রথমবার গানকে অনুভব করা শুরু করলাম। অথচ গানটিতে খুশির কথাই বলা ছিল… নতুন বাড়ি যাওয়ার খুশিই হয়তো হতে পারত। কিন্তু “চলো যাই চলে যাই ” যেন চাবুকের মতো আমাকে জানালো বহুদূর চলে যাওয়ার কথা, এমন চলে যাওয়া, যেখানে খুশিও দুঃখ নিয়ে আসে মাঝে মাঝে। জীবনে প্রথম কষ্টের অনুভবের সাথে এই গানটি এমনভাবে জড়িয়ে রয়েছে, যা পাঁচ বছরের মেয়েটি কোনোদিন ই ভুলতে পারবে না। গান আর দুঃখের অনুভব এইভাবে জড়াজড়ি করে আমার কাছে এল প্রথমবার। আমি যাহোক করে রুটি খেতে খেতে লুকিয়ে চোখের জল আড়াল করতে শিখলাম গানের সাথে।
(চলবে)