অবশেষে কবিতা আমার —- ছালিক আমীন
অবশেষে কবিতা আমার
ছালিক আমীন
ছাত্রী ক্যাম্পাস। বিশাল একর ভূমিতে কলেজটা বিস্তৃত। দুপাশে দুতলা বিশিষ্ট দু’টি বিল্ডিং। অন্যপাশে তিনতলা বিশিষ্ট একটি ছাত্রীবাস।
সাগর এই ছাত্রীবাসের একমাত্র প্রহরী। মাসখানিক হবে এই চাকরিটা নিয়েছে সে। লেখাপড়ায় বেশ এগুতে পারে নি, শুধু পেটের তাড়ায়।
মজার একটা বিষয় হচ্ছে, সাগর খুব ভাল কবিতা লেখে! প্রিন্সিপাল ব্যতীত কারো চোখে পড়ে নি তার এই প্রতিভার গল্প।
বেশকিছু ক্যাম্পাসের মধ্যে ‘মারজানা কলেজ’ একটি অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রায় হাজারের মত সুন্দরী মেয়েদের আনাগোনা এখানে।
প্রতি বছরই একটা সংখ্যা সফলতার সাক্ষর রেখে অন্যত্র চলে যায়। আবার বছরের শুরুতেই আগমন ঘটে বেশকিছু রমণীর।
এবছরও প্রায় দু’শো ছাত্রীসংখ্যার আগমন ঘটল। অসংখ্য ছাত্রীদের মধ্যে কবিতা সবার থেকে সেরা। রূপে, গুণে ও মেধায়। কবিতা বড় ঘরের মেয়ে। পিতার একমাত্র আদরের দুলালী। অহংকারের শেষ নেই তার।
মাঝে মাঝে অহংকারীরাও দুঃখি হয়। ইদানীং কবিতাও সেরকম কিছু একটা দুখের সাগরে ভাসছে।
“যার দুঃখ আছে সেই-তো কবিতায় দুঃখ বিলায়।” কবিতা ইদানীং দুখের কবিতা লিখেই চলছে…
সময়ের কোনো জ্ঞান নেই তার। দিনের অধিকাংশ সময়ই ‘কবিতা চর্চায়’ ব্যস্ত সময় কাটে তার। পড়ার টেবিল থেকে শুরু করে আজকাল সবুজ মাঠেও কবিতার হাতে দেখা যায় কবিতার বই। জানা যায় কবিতা বাংলাসাহিত্য থেকে শুরু করে বিশ্বসাহিত্য চর্চায়ও গোপনে গোপনে পাগল হয়ে উঠেছে।
কবিতার এরূপ পাগলামীতে পুরো কলেজ ক্যাম্পাস মুখোরিত। ইদানীং কবিতা পুরো কলেজ ক্যাম্পাসে একজন নবীন কবি হিসেবে পরিচিত। অল্প দিনের মাথায় সে তার প্রতিভার মূল্য পেতে শুরু করল। ইতিমধ্যে বেশকিছু পুরস্কারও তার হাতে এসে পৌঁছল।
প্রতিদিনের মতো সাগর প্রহরী হিসেবে রাত্রী পাহারা দিচ্ছে। হঠাৎ রাতের শেষভাগে ক্লান্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ল সে। রাত প্রায় ৪:৩০ মিনিট। কণ্ঠে মুয়াজ্জিনের আজান। অল্পতেই সূর্য তার আলোকোজ্জ্বল দিয়ে পৃথিবীটা রাঙিয়ে দেবে। আগমন হবে প্রভাত পাখির। দিনমজুরী পেটের তাড়ায় কাজের তল্লাসে বেরিয়ে যাবে।
আজানের সুরে মুমিন তার মসজিদের পানে রওয়ানা দিবে। ঠিক সাগরের মতো।
কিন্তু সাগর এখনো ঘুমিয়ে। আজ বোধহয় তার নামাজ হবে না পড়া।
একটু দূর থেকে লক্ষ করলে বুঝা যায়, ঘুমের মধ্যেই সাগর কি যেন একটা শব্দ করেই চলছে।
এদিকে কলেজ ক্যাম্পাসের বেশ কিছু রমণী ধর্মপরায়ণ। প্রতিদিনের মতো ওরা বেশ কয়েকজন নামাজের জন্যে তৈরি হল। তাদের দলে কবিতাও বটে। কিছু সময়ের ব্যবধানে তারা নামাজ শেষ করল।
এদিকে প্রতিক্ষিত রাত্রি ধীরে ধীরে অন্ধকার ঠেলে, পৃথিবীটা ভোরের আলোয় আলোকিত করে তুলল। কবিতা প্রভাতের সৌন্দর্য উপভোগের জন্যে বন্ধুদের সাথে করে নিচের ফ্লোরে নেমে আসল। তারপর তারা সোজা গেইটের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।
অতঃপর মহাকান্ড! সাগর এখনো ঘুমিয়ে। কে দেবে গেইটের তালাটা খোলে? তালাটা নাইবা দিলো খুলে, কিন্তু এই যে ঘুমের মধ্যে আজেবাজে উচ্চারণ করছে সাগর, এতেই কবিতার রাগ বিদুতের মত পুরো মাথা নিলো চড়ে। ক্রোধের হিংসাটা এতো তীব্র হলো? কবিতা আর নিজেকে সামলাতে পারল না। দ্রুত সে পাদুকা খুলে, সাগরের (ঘুমন্ত) উপর অত্যাচার চালায়।
অতঃপর সাগরের ঘুম ভাঙল। সাগর মুহুর্তেই কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। কাকতাড়ুয়ার মত দাঁড়িয়ে আছে সে। কেউ কিছু না বলে কবিতাসহ সকলেই সামনের দিকে ছুটল।
এদিকে সকাল দশটা হতে না হতে গোটা কলেজ ক্যাম্পাস মুখোরিত, কবিতা ও সাগরের অদ্ভুত কাহিনীতে।
পাঠক জানি বিরক্ত হচ্ছ? বিরক্ত হয়ে বলছ–কবিতা কেন সাগরকে জুতো দিয়ে আঘাত করল? কিংবা সাগরের অপরাধটা কোথায়?
এমন প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় সাগরও।
তাহলে শুনো–
সাগরের অপরাদটা ছিল স্বপ্ন দেখা! এই-যে ভোরের স্বপ্নতে সাগর একাধারে জপ করে যাচ্ছিল “আমি কবিতার পাগল, আমি কবিতার পাগল, আমি কবিতার পাগল”……..।
স্বপ্নতে এরূপ উচ্চারণ করাই ছিল সাগরের বিশাল অপরাদ।
আজ ভোরে, কবিতা যখন তার সঙিদের নিয়ে গেইটের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়, তখন ঘুমন্ত সাগরের কণ্ঠধ্বনি, কবিতাকে রাগিয়ে তুলে। তারপরে এই মহাকান্ড।
কবিতা ভীষণ জেদি। দুপুর ঘনাতে না ঘনাতে কবিতার ডাকে থানা, পুলিশ, দল, বল, নিজ পিতাসহ অনেকেই কলেজ ক্যাম্পাসে এসে হাজির।
মজার বিষয়। সবাই যখন এ বিষয়টা নিয়ে কলেজ প্রধানের কক্ষে উপস্থিত, তখন অধ্যক্ষ মহোদয় বিষয়টি শুনে হতভম্ব হয়ে উঠেন। অতঃপর মাতাল মানুষের মত একের পর এক মাথায় জল ঢালতে শুরু করেন তিনি। স্যারের এ কর্ম দেখে সবাই রীতিমতো বাকহীন।
খানিক সময়ের ব্যবধানে স্যার শান্ত হলে, উপস্থিত সকল, স্যারের কথায় মনোযোগী হয়ে উঠলেন। স্যার দীর্ঘক্ষণ একজন কবির ব্যথা ও প্রশংসার গল্প নিয়ে ঝরালো বক্তব্য রাখলেন।
উপস্থিত সবাই মূল বিষয়টি ভুলে তরুণ কবিকে জানতে ও চিনতে ভীষণ আগ্রহী।
বিদ্বান ব্যক্তি অধ্যক্ষ মহোদয় সাগরের পরিচয়টা সরাসরি না দিয়ে, একটা প্রশ্ন সবার কাছে ছুড়ে দিলেন।
প্রশ্নটা এমন। আচ্ছা বলতো–একজন মানুষ যদি আট বছর বয়স থেকে কবিতার সাধনায় মগ্ন থেকে আটাশ বসন্তে এসে পৌঁছায়, সে কি আর কবিতার পাগল না হয়ে তাকতে পারে??? পারে না। একজন কবিতা পাগল মানুষ স্বপ্নে কেন? বাস্তবেই সে কবিতার পাগল। স্বপ্নেতে একবার কেন সহস্রবার সে জপতে পারে–কবিতার পাগল, কবিতার পাগল, কবিতার পাগল………
রহস্য উক্তি! সবার বুঝে উঠতে আর কষ্ট হল না।
কবিতার (ছাত্রী) শুভাকাঙ্ক্ষী পিতাসহ দল, বল যারা কবিতার ডাকে কলেজ ক্যাম্পাসে এসে প্রতিবাদের সুর তুলেছিলেন, অবশেষে সকলেই বিষয়টি বুঝতে পেরে, চেঁচামেচি না করে তরুণ কবি সাগরকে স্বাগত জানালেন।
খানিক পরে পুরো কলেজ ক্যাম্পাসে প্রতিদিনের শূন্যতা নেমে আসলে–কবিতা অনুতপ্ত মনে দু’হাত করজোড়ে নির্বাক কবি সাগরের দোয়ারে এসে হাজির।
কবি-তো প্রেমিক মানুষ। সহজেই কঠিন কে সহজ-সরল ভাবনা দিয়ে সাজিয়ে নেন। সাগরও তাই করলেন। মুহুর্তেই সব ভুলে গিয়ে কবিতার সাথে নানা গল্পতে নিজেকে হারিয়ে নিলেন। শুরু হল দু’জনের মধ্যে নতুন এক বন্ধন।
আজ প্রায় ৩টি বছর পর। সাগর–কবিতাকে নিয়েই কলেজ ক্যাম্পাসে নেমে এলো আনন্দের এক কলোরব।
অনুষ্ঠানের ঠিক মধ্য ব্যানারে বড় অক্ষরে লিখা হলো সাগর-কবিতা’র বিয়েতে মারজানা কলেজের আনন্দ মিছিল।