প্রবাদপ্রতিম গায়িকা ও নর্তকী কমলা ঝরিয়ার স্মৃতিবিজড়িত ঝরিয়ার রাজবাড়ী —– পুরুষোত্তম চক্রবর্তী
প্রবাদপ্রতিম গায়িকা ও নর্তকী কমলা ঝরিয়ার স্মৃতিবিজড়িত ঝরিয়ার রাজবাড়ী
পুরুষোত্তম চক্রবর্তী
আমার বাল্যকাল ও স্কুলজীবন কেটেছে পশ্চিমবঙ্গ-সংলগ্ন ধানবাদ শহরে। আমার স্বর্গত পিতৃদেব ধানবাদে অবস্হিত ইস্টার্ন রেলওয়ের “ডিভিসনাল রেলওয়ে ম্যানেজার” এর অফিসে চাকুরী করতেন। সেই সুবাদে আমরা সপরিবারে ধানবাদের রেল কোয়ার্টারে থাকতাম। সেই সময় ধানবাদ বিহারের অন্তর্গত জেলা শহর ছিল, এখন এটি ঝাড়খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। বাঙালি অধ্যুষিত মাঝারি মাপের এই শহর টি আর্থিক ভাবে অত্যন্ত ধনী, কেননা সারা ভারতবর্ষের প্রায় ৯৫ শতাংশ কয়লাখনি ধানবাদ জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ছোটনাগপুর পার্বত্য অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ধানবাদ শহর টি ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়ে ঘেরা। শহরটি সমতলে অবস্হিত নয়, বরং বেশ উঁচু নিচু। গাড়িতে বসে শহরের মধ্য দিয়ে বিচরণ করলে অনুভব করা যায় শহরটির ডেমোগ্রাফি। শহরটির বুক চিরে এঁকে বেঁকে ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড’ চলে গিয়েছে যা মাইথন, বরাকর, আসানসোল, বর্ধমান ইত্যাদির সংযুক্তি ঘটিয়েছে। ব্রিটিশ দের তৈরি করা অসংখ্য রেল কোয়ার্টার, জলাশয়, রেলওয়ে ক্লাব, বিশ্ববিখ্যাত আই আই টি – ইন্ডিয়ান স্কুল অফ মাইনস, রামকৃষ্ণ মিশন সম্বলিত এই ধানবাদ শহরে একটানা অনেকদিন থাকার ফলে স্বভাবতই শহরটির প্রতি আমার এক অসম্ভব দুর্বলতা রয়ে গিয়েছে।
আমাদের কোয়ার্টার থেকে একটু দূরেই একটি টিলার উপর দিয়ে রেললাইন চলে গিয়েছে যা ধানবাদ থেকে একেবারে পাথরডিহি চলে যাওয়া যায়। মাঝখানে ঝরিয়া ষ্টেশন। ঝরিয়া একটি ছোট্ট শহর যা ধানবাদ শহরের একরকম গায়েই লাগানো বলা যেতে পারে। আমাদের কোয়ার্টার থেকে একটু দূরে হেঁটে গেলেই চোখে পড়তো সেই টিলার উপর দিয়ে কু-ঝিক ঝিক করতে বাস্পীয় ইঞ্জিন চালিত কয়েক কামরার একটি রেলগাড়ি ছুটে চলেছে। সেই দৃশ্যে আমার শিশুমনে এক অদ্ভূত শিহরণ জাগতো। খালি মনে হতো আমি যেন ঐ রেলগাড়ির মধ্যে বসে আছি ও ঝরিয়া তে পৌঁছে গিয়েছি! মায়ের কাছে খুব শুনতাম কমলা ঝরিয়ার নাম। মা বলতেন – কমলা ঝরিয়া খুব বিখ্যাত কীর্তন শিল্পী ও ঝরিয়ার রাজবাড়ীর গায়িকা ও নর্তকী।
আমি তখন খুব ছোট, বয়স আনুমানিক সাত কি আট হবে। যতদূর মনে পড়ছে, সালটা ১৯৫৭ বা ১৯৫৮ হবে। অক্টোবরে দুর্গাপুজো উৎসবের মেজাজে ধানবাদ শহরের আপামর বাঙালি আনন্দে উদ্বেলিত। আমি পাড়ার পুজোর প্যান্ডেলে ঘোরাঘুরি করছি আমারই বয়সী দু-একটি ছেলের সঙ্গে। হঠাৎ একজনকে বললাম “এই ঝরিয়া যাবি? চল না খুব মজা হবে। ওখানকার ঠাকুর দেখবো।” ওদেরকে বেশ উৎসাহী মনে হোল। আর কথা নেই। সোজা চলে গেলাম ধানবাদ ষ্টেশনে। “পাথরডিহি লোকাল” টি দাঁড়িয়ে ছিল। সবাই মিলে উঠে পড়লাম কোন একটি কম্পার্টমেন্টে। টিকিট ছাড়া যে ট্রেনে চড়া না, সেইসব চিন্তা মাথাতেও আসেনি। তাছাড়া, আমাদের সেরকম কোন জ্ঞানবুদ্ধি তখনও জন্মায় নি। যাই হোক, একটু পরেই ট্রেন ছাড়লো ও গতি প্রাপ্ত হোল। জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছি বাইরের দিকে আর মনের মধ্যে চলছে এক বিরাট উন্মাদনা!
পরবর্তী স্টেশন ঝরিয়া। নেমে পড়লাম সকলে মিলে। ভাগ্যিস টিকিট চেকার ওঠেনি, তাহলে কি যে হোত জানি না! স্টেশন থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম একেবারে রাজবাড়ীর দিকে। বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর দূরে দেখতে পেলাম সেই বিখ্যাত ঝরিয়ার রাজবাড়ী। অনেক বড় কিন্তু অসম্ভব প্রাচীন ছাপ রয়েছে গোটা রাজবাড়ীর আনাচে কানাচে। এত প্রাচীন যে বাইরের দেয়ালে কোথাও কোথাও বড় বড় ফাটল ধরেছে আর সেই ফাটলে অশ্বত্থ গাছ গজিয়ে উঠেছে।
রাজবাড়ীর বিশাল লোহার গেট উন্মুক্ত। ঢুকে পড়লাম একেবারে ভিতরে। ক্লান্তি তে শরীর আর নিচ্ছে না। বসে পড়লাম বারান্দার কোন একটি জায়গায়। ভাবলাম, একটু বিশ্রাম করে নিই, তারপর ভিতরে ঢুকবো এবং কমলা ঝরিয়ার স্মৃতিবিজড়িত ঘরগুলো পরিদর্শন কোরবো। বোধহয় কমলা ঝরিয়াকে দেখতে পাবো!মায়ের কাছ থেকে শুনে শুনে কমলা ঝরিয়ার সঙ্গীতের প্রতি আমার ও এক অসম্ভব দুর্বলতা জন্মে গিয়েছিল। কমলা ঝরিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, একেবারে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন প্রায় সন্ধ্যে। আমার সঙ্গে যারা ছিল, তারা আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। আমি একা। কাঁদতে শুরু করলাম। মনে হোল, কান্নার মাঝে কেউ একজন আমার পাশে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়ে আমাকে ভিতরে যেতে আহ্বান করছেন! আমি অসীম উৎসাহে আমাকে রাজবাড়ীর অন্দরমহলে প্রবেশ করলাম। সে এক দুর্লভ স্মৃতি!
এক একটি ঘরের দেওয়াল রাজার পূর্বপুরুষদের প্রকান্ড প্রকান্ড তৈলচিত্রে শোভিত। জিজ্ঞেস করলাম – আচ্ছা, কমলা ঝরিয়ার ঘর টি কোথায়? তিনি কি এখনও বেঁচে আছেন। উনি বললেন – বেঁচে আছেন, তবে অনেক বছর আগে তিনি ঝরিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছেন কলকাতায়। তিনি একটি বিশাল নাচঘরে নিয়ে গেলেন যেখানে কমলা ঝরিয়ার অসংখ্য তৈলচিত্র ও তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বাদ্যযন্ত্র সামগ্রী সুরক্ষিত রয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে ওঁর সাহায্যেই আমি ধানবাদে আমাদের বাড়ীতে ফিরে আসতে পেরেছিলাম। ততক্ষণে বাড়ীতে হুলুস্থুলু কান্ড, একেবারে থানা পুলিশ ঘটবার মত অবস্হা! লোকে লোকারণ্য আমাদের কোয়ার্টার-সংলগ্ন খোলা জায়গায়। তার মধ্যে মায়ের বুকফাটা কান্না ও বাবার আশ্চর্যজনক নৈঃশব্দ্য আমাকে ভয়ে, লজ্জায়, অপরাধ বোধে আর দু:খে একেবারে সঙ্কুচিত করে দিয়েছিল! আমার কাছ থেকে সব শুনবার পর মা সস্নেহে আমাকে বললেন – তুমি ভীষন অন্যায় করেছো। এইভাবে কেউ কি একা একা এতদূরে চলে যায়? তুমি তো হারিয়ে যেতে পারতে বা ছেলেধরার খপ্পরে পড়তে পারতে! ঠিক আছে, আমি রাত্রে কমলা ঝরিয়ার কথা যেটুকু জানি তোমাকে বলবো। মায়ের কাছ থেকে কিছুটা শোনা গল্প এবং বিভিন্ন তথ্যের উপর ভিত্তি করে যেটুকু জেনেছি, সংক্ষেপে লিখছি। সঙ্গের ছবি দুটিতে ঝরিয়ার রাজবাড়ী ও কমলা ঝরিয়া।
এক অসামান্য সঙ্গীতশিল্পীর নাম কমলা ঝরিয়া, যিনি তিরিশ থেকে পঞ্চাশ – এই তিনটি দশক অতীব দাপটের সঙ্গে বাংলা গানের জগতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। লক্ষ লক্ষ শ্রোতার মনে এক অপরিসীম সমীহ ও জনপ্রিয়তা এই শিল্পীকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল – কিন্নরকণ্ঠী কমলা বাংলা গানের জগতে হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তির নায়িকা। একসময়ে যিনি খ্যাতি-যশ-প্রতিষ্ঠায় লোকনন্দিত শিল্পী ছিলেন, গান ছাড়ার পর দ্রুতই তিনি অন্তরালের বাসিন্দা হয়ে ওঠেন – অনেকখানিই বিস্মৃতির ধূসর জগতে আশ্রয় হয় তাঁর।
কমলা ঝরিয়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঝরিয়ায়। তাঁর বংশপদবি ছিল ‘সিং’। পিতা ঠিকেদারি ব্যবসা করে বেশ পসার করেছিলেন। ঝরিয়ার রাজবাড়ির খুব কাছাকাছিই থাকতেন কমলার বাবা। ঝরিয়ার রাজারাও ‘সিং’ পদাধিকারী হওয়ায় তাঁদের সঙ্গে কমলাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়তাও থাকতে পারে। অবিশ্যি লোকমুখে অন্য কথাও শোনা যায়। ঝরিয়ার রাজা গানবাজনার অনুরাগী ছিলেন। তাঁর দরবারে গানের কদর ছিল। সেকালের নামী শিল্পী কে. মল্লিক আট-নয় বছর ঝরিয়ার রাজার সভা-গায়ক ছিলেন। এই কে. মল্লিকই কমলা ঝরিয়ার প্রথম গানের গুরু। একেবারে শিশু-বয়সেই গানের আসরে এসে বসতেন কমলা। গানের প্রতি তাঁর এই ঝোঁক দেখে রাজা তাঁকে কে. মল্লিকের কাছে গান শেখার সুযোগ করে দেন – তখন তাঁর বয়স নয়-দশের বেশি নয়। কে. মল্লিক কমলার গানের ঝোঁক আরো উসকে দেন – তাঁর হাতেই কমলার গানের ভিত রচিত হয়। এরপর তিনি ঝরিয়ার রাজদরবারের আরেক সংগীতগুণী শ্রীনাথ দাসনন্দীর কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত শিখতে শুরু করেন। গানের প্রতি কমলার একান্ত অনুরাগ ও তাঁর সংগীত-প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তা আরো বিকশিত করার লক্ষ্যে কে. মল্লিক তাঁকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বেতার ও গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। কমলার জীবনের মোড় ঘুরে যায় এই ঘটনায়।
তিনি প্রথম গান রেকর্ড করেন “হিজ মাস্টার্স ভয়েস” এ। প্রণব রায়ের লেখা ও তুলসী লাহিড়ীর সুরে ‘প্রিয় যেন প্রেম ভুল না’ ও ‘নিঠুর নয়ন-বাণ কেন হান’ – এই গান দুটি নিয়ে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয় সেপ্টেম্বর ১৯৩০-এ। কলের গানের ভুবনে তাঁর আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া পড়ে যায়। অবশ্য এই কাজ খুব সহজ ছিল না। কেননা তখন গানের জগতে ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা, কাননদেবী, আশ্চর্য্যময়ী, হরিমতীদের রাজত্ব। গহরজানের গানের রেশ তখনো সংগীতরসিক মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।
গ্রামোফোন রেকর্ডে তাঁর নামের পদবি নিয়ে ভারি মজার এক গল্প চালু আছে। শোনা যায় : প্রথম রেকর্ড প্রকাশের সময় কর্তৃপক্ষ তাঁর পদবী জানতেন না তাই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত কাজী নজরুল ইসলাম, তুলসী লাহিড়ী এবং ধীরেন দাসের সিদ্ধান্ত অনুসারে রেকর্ডের লেবেলে তাঁর নামের পাশে পদবীস্থলে বাসস্থান (ঝরিয়া)-এর নাম যুক্ত করে দেন, এবং সেই থেকেই তিনি – ‘কমলা ঝরিয়া’ নামে আমাদের অন্তরে বেঁচে আছেন।
কমলা ঝরিয়ার গানের জীবনে বেশ কয়েকজন সংগীতগুণীর বড় ভূমিকা আছে, এঁদের মধ্যে বিশেষ করে নাম করতে হয় কে. মল্লিক, ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খাঁ, কাজী নজরুল ইসলাম ও তুলসী লাহিড়ীর। ঝরিয়ার রাজদরবারের সভা-গায়ক শ্রীনাথ দাসনন্দীর কাছে কমলার উচ্চাঙ্গসংগীতে যে হাতেখড়ি, তা পূর্ণতা পায় ওস্তাদ উজির খাঁ ও ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খাঁর কল্যাণে। গ্রামোফোন কোম্পানির প্রশিক্ষক হিসেবে জমিরুদ্দীন খাঁর কাছে গান শিখে রেকর্ডও করেছেন কমলা।
নজরুলের সান্নিধ্য ও শিক্ষাও কমলাকে সমৃদ্ধ করেছে। নজরুলের কাছে কমলার সংগীত-ঋণ কম নয়। তুলসী লাহিড়ীর ভূমিকার কথা না বললে কমলা ঝরিয়ার জীবনের কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ঝরিয়া থেকে কলকাতায় আসার দু-এক বছরের মধ্যেই কমলার জীবন গেঁথে যায় তুলসী লাহিড়ীর সঙ্গে। তিনি হয়ে ওঠেন কমলার ‘কর্তা’ এবং সেই সুবাদে অভিভাবক ও নিয়ন্ত্রক। এর ফলাফল কমলার জন্যে মোটের ওপর ভালোই হয়েছিল। বেতার, গ্রামোফোন, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে তিনি যে যুক্ত হতে পেরেছিলেন তার মূলেও ছিলেন তুলসী লাহিড়ী। ঝরিয়া থেকে কলকাতায় গ্রামোফোনে গান দিতে এসে তুলসী লাহিড়ীর সঙ্গে কমলার পরিচয়। সেই পরিচয় ধীরে ধীরে অন্তরঙ্গতার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে তুলসী লাহিড়ী তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী শান্তিলতা এবং চার পুত্র ও দুই কন্যাকে ছেড়ে কমলার সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। এদিকে-ওদিকে ভাসতে ভাসতে শেষ পর্যন্ত লাহিড়ী-পরিবারের ঠাঁই হয় কলকাতার ৩৬ কৃষ্ণপুর রোডের এক বস্তির খোলার ঘরে – দুঃখ-দারিদ্র্য আর অবহেলায় তাঁদের জীবন কাটতে থাকে। অপরদিকে তুলসী লাহিড়ী কমলাকে নিয়ে নানা ভাড়াবাড়িতে থাকার পর শেষে তাঁকে কলকাতার ১৫৮/সি রাসবিহারী এভিনিউয়ের একেবারে সদর রাস্তার পাশে একটি বেশ বড়োসড়ো তিনতলা একটি বাড়ি কিনে দেন। ঝরিয়া থেকে কমলার এক ভাই এসে সপরিবার এই বাড়িতে ওঠেন। এখন এখানে বাস করেন কমলার ভাইঝি মীরা সিং ও তাঁর কন্যা দেবযানী কুণ্ডু।
তুলসী লাহিড়ী ও কমলা ঝরিয়া সমাজ-সম্পর্কের বাইরে এক কীর্তিময় শিল্পের সংসার গড়ে তুলেছিলেন। তিরিশের যুগের প্রায় গোড়া থেকেই যে সম্পর্কের সূচনা তা তুলসী লাহিড়ীর মৃত্যুকাল অর্থাৎ ১৯৫৯ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন ছিল। কমলার শিল্পী ও ব্যক্তিজীবনেও এই গুণী মানুষটি ছায়ার মতো ছিলেন। কমলারও তাঁর প্রতি ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও নির্ভরতা। সামাজিক নিন্দা-সমালোচনা, পারিবারিক অশান্তি-অস্বস্তি, দৈহিক লাঞ্ছনা ও মানসিক পীড়ন সত্ত্বেও তুলসী লাহিড়ীর কাছ থেকে কমলাকে কেউ দূরে সরিয়ে নিতে পারেনি।
১৯৫৯-এর ২২ জুন তুলসী লাহিড়ীর জীবনাবসান হয়। তুলসী লাহিড়ীর মৃত্যুর পর কমলা গানের জগৎ থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেন। অনেকটাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি, বাইরের যোগাযোগও কমে আসে।
সারা জীবন কমলা দেবী বিচিত্র ধরনের গান গেয়েছেন। বাংলা ঠুংরি গানে তাঁর কণ্ঠ ছিল সতেজ, সাবলীল। রাগাশ্রিত বাংলা গানেও তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তাছাড়া, আধুনিক, মীরার ভজন, গজল, পদাবলী কীর্তন, বাউল, ঝুমুর, ভাটিয়ালি, ভক্তিমূলক, রামপ্রসাদী, নজরুলগীতি – সবক্ষেত্রেই শ্রীমতী কমলার স্বর্ণকণ্ঠ ছিল অনায়াস-নৈপুণ্যে বিস্ময়বাহী।
বাংলা গানের বহু শাখায়িত বৈচিত্র্যে সহজ সঞ্চরণ করেও শেষ পর্যন্ত কমলা দেবী তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ গীতি-অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন করুণাঘন শ্রীকৃষ্ণের স্নিগ্ধ চরণতলে – সেইখানেই বোধহয় তাঁর সাধনার চরম পরিপূর্ণতা অনুভব করে তিনি কৃতার্থ হয়েছেন। পদাবলী কীর্তনের আসরেই তাঁর জনপ্রিয়তা সর্বাধিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণের ভাব-বৃন্দাবনের লীলামাধুরী অনুধাবন করেই তাঁর জীবনপথের তোরণ দ্বারের দিকে তিনি পরম শান্তচিত্তে এগিয়ে গিয়েছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
তুলসী লাহিড়ীর কাহিনি নিয়ে রচিত একটি ছবিতে বিশাখা চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই কমলা ঝরিয়ার চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ। এরপর তিনি বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে অন্তত বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন।
তুলসী লাহিড়ীই কমলার জীবন বীণার তারটি নিজের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর কমলা প্রায় বছর কুড়ি বেঁচে ছিলেন। অনেকটাই নিঃসঙ্গ ও সাথীহারা। বাইরের জগৎ তাঁর কাছে ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র হয়ে আসে; এক সময় প্রায় ছিন্ন হয়ে পড়ে সমস্ত সম্পর্ক। শেষ জীবন নানা রোগশোকে কাটে, শ্বাসকষ্টে মাঝে-মধ্যেই পীড়িত হতেন। তিনি নির্লিপ্ত নিষ্কামভাবে সংসারের বেদির ওপর জীবনের শেষ নৈবেদ্য টি অর্পণ করেছেন।
তথ্যসূত্র: শিল্প ও শিল্পী – আবুল আহসান চৌধুরী, আনন্দবাজার পত্রিকা, গুগল, উইকিপিডিয়া, ইত্যাদি।
পুরুষোত্তম চক্রবর্তী