রাখিবন্ধন — লেখিকা-বাবিয়া নন্দী
রাখিবন্ধন
লেখিকা-বাবিয়া নন্দী
প্রত্যেক টা সম্পর্কই একটা কোথায়ও গিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়।সেটা বন্ধুত্বের বন্ধন হোক।মায়ের সাথে সন্তানের বন্ধন হোক কিংবা ভাইয়ের সাথে বোনের বন্ধন।আজ যে গল্পটা নিয়ে হাজির হলাম সেটা হল,বড় দাদা অর্থাৎ বাড়ে ভাইয়ার সাথে তাঁর ছোট্ট বোন গুড়িয়া রানীর বন্ধন অর্থাৎ রাখীবন্ধন। আজ সকাল থেকে আকাশের মুখ ভীষণ রকমের উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।আকাশ বাতাস পাতাল জুড়ে শরতের রোদ যেন খেলা করে বেড়াচ্ছে।বাড়িতে বাড়িতে আজ বোন ও দিদিরা তাদের পরম আদরের ভাই ও দাদার হাতে নকশা করা রঙ্গীন পছন্দের রাখি বেঁধে দিচ্ছে। আর রইলো বাকি উপহার দেওয়া নেওয়ার পালা।কতো আনন্দ,হৈ চৈ,গান,হাসিমজা,খাওয়া দাওয়া নিয়ে মেতে রয়েছে হরিয়ানার পাড়ার প্রত্যেক টি ঘর।গুড়িয়া তার দাদার ফটোর সামনে দাদার কপালে আবিরের ফোঁটা দিয়েছে।ফটোর উপর মালা ঝুলছে।আর ঠিক ফটোটার নীচে একটা গোলাপের সাজে সাজানো রাখি দিয়েছে।পাশের ঘরে কারোর টেলিভিশন থেকে চিত্রহারের গান ভেসে আসছে,”ফুলোকা তারো কা সাব কা কাহেনা হ্যায়,এক হাজারও মেঁ মেরী বাহেনা হ্যায়,সারি উমার হামে সাঙ্গ রাহে না হ্যায়”।গুড়িয়ার মনে পড়ে গেল কত্তো প্রিয় ছিলো তার ভাইয়ার এই গানটা।যখনই রাখিবন্ধন, ভাইদূজ অর্থাৎ ভাতৃদ্বিতীয়া হোতো তখনই দাদা মজার ছলে এই গান টা গেয়ে তার ছোট্ট মোমের পুতুলের মতোন বোন টা কে আদর করতো।ভাইয়া রাখি তো পড়ে নিতো।কিন্তু গুড়িয়াকে উপহার দেওয়ার জন্য সারা বাড়ি,উঠোন,বাগান ছোটানো করাতো।তারপর ক্লান্ত হয়ে গুড়িয়া যখন বাগান বা উঠোনের এক পাশে মুখ ছোটো করে গাল ফুলিয়ে বসে পড়তো,তখন দেখতো তার মনের মতোন উপহার ঠিক তার পাশে রাখা আছে।আর খানিক দূরে ভাইয়া(দাদা) দাঁড়িয়ে মুচকে মুচকে হাসছে।গুড়িয়া যখন দাদা কে বলতো,”ভাইয়া তুম বহত বুরে হো,পাহেলে কিউ নাহি বোলি,মেরে লিয়ে গিফ্ট লাহে হো,পাহেলে কিউ নাহি দিয়ে?বহত সাতাতে মুঝে।মা বাওজি সাব আকার দেখো ভাইয়া মেরে লিয়ে ল্যাহেঙ্গা অওর চুড়িয়া লে আয়ি হ্যায়”।ভাইয়া বলতো,”মুঝে বহত আচ্ছা লাগতা হ্যায়, যাব হামারা ইস ছোটিসি বাহেনা গুস্সেমে আকার গাল ফুলাকে ব্যাইঠি রাহেতে হ্যায়।উস ওয়াক্ত তো উস্সে অওর ভি মাসুম লাগতি হ্যায়।আরে পাগলী তেরে লিয়ে ইয়ে ছোটাসা গিফট তো ক্যায়া,তেরে লিয়ে তো মেরা জান ভি হাজির হ্যায়।”গুড়িয়া হিন্দী ভাষায় বললো,” ও কথা বোলো না ভাইয়া,আমি তো বয়সে তোমার চেয়ে ছ’বছরের ছোটো,তাই তোমাকে আশীর্বাদ করতে পারবো না।কিন্তু কিষান জি র কাছে মাথা ঠেকিয়ে প্রার্থনা করি,যেন আমরা প্রতি বছর এই দিনটাতে আনন্দ করতে পারি।যখন বুড়ি হয়ে যাবো তখনও এইভাবে হাসিমজা করে আমার ভাইয়ার হাতে রাখি পড়াবো।ভাইয়াও কিছু মুহুর্তের জন্য উদাসীন হয়ে গেল,তার এই ছোটো বোন টা ছোটো বেলা থেকেই ভীষণ পরিমাণে তার ন্যাওটা।ছ বছর বয়স যখন ছিল প্রতাপ সিং এর তখন গুড়িয়া জন্মায়।একটা জ্যান্ত হাত পা নাড়ানো পুতুল।ছোট্ট তার মুখ টা।ক্ষিধে পেলে কাঁদে।ছোট্ট ছোট্ট হাত পা ওয়ালা একদম গোলাপী পরীর মতোন।প্রতাপ সবসময় আগলে রাখতো তার বুনি কে।মশা মাছি কিচ্ছু বসতে দিতো না।তারপর তো কোলে নিয়ে পাড়া বেড়াতো।এমন ভাই বোনের ভালোবাসা বড় একটা দ্যাখা যায় না।বোন কে প্রথম হাত ধরে সেই হাঁটিয়েছিলো।ডল পুতুলের মতোন লাগতো গুড়িয়া রাণী কে।পাড়ায় কেউ খেলতে গিয়ে বোন কে মারলে সে উল্টে গিয়ে মেরে আসতো তাদের।এসব ভাবতে ভাবতেই সে উদাসীন হয়ে গেল।গুড়িয়া তখন ধাক্কা মেরে বললো,কি হয়েছে ভাইয়া,তুমি চুপ করে গেলে কেন?ভাইয়া তখন কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললো,দ্যাখ বোন,আমি যে কাজ করি,সরকারী BSF এর ফৌওজী একজন।যে কোনো সময়ে আমার যে কোনো কিছু হয়ে যেতেই পারে।তখন জানবি, তোর ভাইয়া কিন্তু তোকে ছেড়ে যায় নি,শুধুমাত্র দেশমাতার রক্ষার্থে শহীদ হয়েছে।কাঁদবি না কিন্তু সেদিন তুই।সেদিন তুই তোর ভাইয়ার জন্য গর্ববোধ করবি।আরে ভাই বোনের সম্পর্কের বন্ধন কি এত্তোটাই ঠুনকো আর শিথিল যে স্বশরীরে উপস্থিত না থাকলেই তোর ভাইয়া আর তোর কাছে থাকবে না?গুড়িয়া তখন ভাইয়ার কথা শুনে খুব কেঁদেছিলো,কত্তোবার বলেছিলো ভাইয়া আমার কথা শোনো,তুমি আর ওই নকরি কোরো না।ওটা ছেড়ে দাও।যখনই কোথাও গোলা, বারুদ আর বোমা চলে,আমি মা বাওজি কিছু না খেয়ে ভয়ে ভয়ে টিভির সামনে খবর খুলে বসে থাকি।”তখন গুড়িয়ার ভাইয়া তার মাথায় হাত রেখে বললো,ওরে,শপথ নিয়েছিলাম রে বোন,নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও দেশমাতার রকষা করবো।আর তুই কিনা আমার বহেন হয়ে এক ফৌজীর বোন হয়ে বলছিস দেশ মাতাকে ছেড়ে চলে আসবো।”গুড়িয়া বললো অতো শত বুঝি না,আমার ভাইয়ার কিচ্ছু হোতে দেবো না।ভাইয়া আবারও বললো,তুই তো আমার জোর রে।কোথায় আমায় সাহস জোগাবি তা না ডর কে মারে ব্যাইঠে রাহো।”আর তোর ভাইয়ার প্রাণ না লোহে কা আছে।কিচ্ছু হবে না।এখনও আমি অনেক বছর বাঁচবো।আমার এই ছোট্ট বোন টা র স্বাধী দিতে হবে না?”গুড়িয়া তখন লাজুক মুখ করে লজ্জায় রক্তিম বর্ণ হয়ে বলে উঠলো,”ভাইয়া তোমায় ছেড়ে।মা বাওজি কে ছোড়কে হাম কাহি নাহি জায়েঙ্গে।”ভাইয়ার ফটোর সামনে বসে গুড়িয়ার স্মৃতি গুলো একে একে মনে পড়তে লাগলো।আজ দু বছর অতিবাহিত হয়েছে,২০১৯ সালের ১৪ ই ফেব্রুয়ারী পুলওয়ামার যুদ্ধে সে তার ভাইকে হারিয়েছে।তার ভাইয়া তাকে ছেড়ে শহীদ হয়ে পরলোক গমন করেছে।কিন্তু ভাইয়া ঠিকই বলেছিলো,ভাই বোনের বন্ধন এতো শিথিল নয়,সেটা রয়েই গেছে।তার ভাইয়া তাকে কাঁদতে বারণ করেছিলো।দাদার কথা একটা একটা করে মনে পড়ছে।এমনকি গুড়িয়ার যে বাগতত্ত্বা,তার সাথে গুড়িয়া ১৪ই ফেব্রুয়ারী ভালোবাসার দিন উদযাপন করে না।এই দিনেই তো তার দাদা তাকে ছেড়ে চিরকালের মতোন না ফেরার দেশে চলে গেছে।তাই ওই দিন টা তার কাছে Valentine Day নয়,Black Day হিসাবে পালন করে।গুরুদুয়ার যায়।ভাইয়ার আত্মার শান্তি কামনা করে।গুড়িয়ার বাগতত্ত্বাও এভাবেই গুড়িয়াকে মেনে নিয়েছে।সেও তার সঙ্গ দেয়।তাকে সমর্থন করে।এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ভাইয়ার ফটোর সামনে বসে কখন যে গুড়িয়ার দু-চোখ বেয়ে প্লাবন ধারা নেমেছে,সে নিজেও জানে না।হঠাৎ ই যেন গুড়িয়ার মনে হল-ফটোর মধ্যে থেকে কেউ যেন গেয়ে উঠলো-“দেখ শাকতা হু মেঁ,কুছভি হোতে হুয়ে,দেখ শাকতা হু মেঁ কুছ ভি হোতে হুয়ে,নাহি মেঁ নাহি দেখ শাকতা তুঝে রোতে হুয়ে,নাহি মেঁ নাহি দেখ শকতা তুঝে রোতে হুয়ে।”যখনই গুড়িয়ার মনে বা শরীরে আঘাত লাগতো,আর ও কাঁদতো তখনই তার দাদা(ভাইয়া) এই গান টা মজা করে গেয়ে ওকে ওর কষ্ট ভুলিয়ে দিতো।আজও মনে হয় তার ব্যতিক্রম হল না।
সমাপ্ত।(লেখাটি সম্পূর্ণ রূপে কাল্পনিক।বাস্তবের কোনো চরিত্রের সাথে যদি কাকতালীয় ভাবে মিলে যায়,তার জন্য লেখিকার দা নেই।আর যেহেতু গল্পের চরিত্ররা অবাঙ্গালী তাই কিছু হিন্দী ভাষা ঢোকাতে হয়েছে চরিত্র গুলোকে জীবন্ত করে তোলার স্বার্থে। সকলকে জানাই রাখিবন্ধন এর শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও শুভকামনা।