মনের বয়স বাড়ে না —- তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী
মনের বয়স বাড়ে না
তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী
‘কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না’, মনে মনে গুনগুন করতে করতে গীতালী দেবী ফেসবুক টা খুলে বসলেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ। software company তে চাকুরে ছেলে বৌমা ব্যস্ত তাদের দৈনন্দিন রুটিনে। নাতনিও ব্যস্ত অনলাইন নানা ক্লাসে। ভীষণ একলা লাগে মাঝে মাঝে যদিও অনেক কাজেই ব্যস্ত রেখেছেন নিজেকে। তাও কেমন যেন একাকীত্ব চেপে বসে মনে আর তাই বন্ধুর খোঁজে ফেসবুক। অ্যাকাউন্ট খোলার পর থেকেই নতুন নতুন বন্ধুরা তাদের বন্ধুতা স্বীকারের অনুরোধ পাঠাচ্ছেন। বেছে বেছে বেশ কিছু বান্ধবী এবং বন্ধুর বন্ধুত্ব স্বীকার করেছেন। এখন বেশ ভালো সময় কাটে নিজের কবিতা লেখা, রবি ঠাকুরের লেখা আবৃত্তি এসব শেয়ার করেন ফেসবুকে এবং ভার্চুয়াল বন্ধুদের উৎসাহ দানে আরও মনোযোগ দেন এসব ক্রিয়েটিভ কাজে।
বেশ চলছিল একঘেয়ে জীবন রঙিন হয়ে মেয়েবেলার নৌকা বেয়ে… সবার লেখা পড়ে মন্তব্য এবং নিজের লেখার প্রতিমন্তব্য নিয়ে। কিছু সমবয়সী বা একটু ছোট বান্ধবীদের সাথে টুকটাক আলাপচারিতাও হয়। দমবন্ধ পরিস্থিতিতে এটাই অক্সিজেন এখন। রাতে নেট অফ করে শোবার সময় পরদিনের শুভ সূচনার কথা ভেবে নেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপ, খবরের কাগজ আর ভার্চুয়াল বন্ধুদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় এখন অবিচ্ছেদ্য অংশ জীবনের।
সেদিনও সকালে ফেসবুক খুলে দ্যাখেন বেশ কয়েকজন নতুন বন্ধু অনুরোধ পাঠিয়েছেন বন্ধুতার। প্রোফাইল অল্প চেক করে দুজনের বন্ধুত্ব স্বীকার করেন।
একটু পরেই একজন সকাল শুভেচ্ছা পাঠালেন। প্রতি সৌজন্য দেখালেন গীতালী দেবী। এরপর প্রাথমিক আলাপচারিতাও। দীর্ঘ কর্মজীবন বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরেছেন বিদেশিনী স্ত্রী র মৃত্যু পর। দুই ছেলে ই প্রতিষ্ঠিত ওদেশেই। এদেশের প্রতি ওদের বসবাসের টান নেই। আসলে ভারত কে নিজের দেশ বলে ওরা ভাবে না। বেড়াতে ভালো লাগে কেবল।দুজনেরই বিদেশী বৌ।
স্ত্রী র মৃত্যুর পর কোথাও যেন একটা বিশাল ফাঁক বা ব্যবধান সৃষ্টি করেছিল যার ফলেই শিকড়ের টানে, মাটির ঘ্রাণ নিতে ফিরে আসা ভারত তথা কলকাতা। একদা খড়্গপুর আই আই টি র কৃতি ছাত্র অন্বয় মজুমদার।
নিউ টাউনে নামকরা হাউজিং এ ঝকঝকে ফ্ল্যাট কিনেছেন। এটা ঠিক হাউজিং নয়, আধুনিক সুযোগ সুবিধা সহ একটা নির্জন শহরতলী। নামে আবার ‘ভিলেজ’ আছে।
গীতালী দেবীও তার পরিচয় দেন। কম্পারেটিভ লিটারেচার নিয়ে মাস্টার্স করে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতেই শিক্ষকতা জীবন কাটিয়েছেন। হাসব্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার, নামকরা এম এন সি তে চাকরি করেছেন। বছর তিনেক আগে ম্যাসিভ অ্যাটাকে দেহ রেখেছেন। বর্তমানে একমাত্র ছেলে, বৌমা আর নাতনি নিয়ে সুখেই আছেন কিন্তু একাকীত্বটা রয়েছে আর সবার ব্যস্ততা সেটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। তাই এই ফেসবুকে আসা কিছু টা কোয়ালিটি সময় সমমানসিকতার ভার্চুয়াল বন্ধুদের কাটিয়ে বুক ভরে অক্সিজেন নেওয়া। লবণ হ্রদ এলাকায় স্বামী স্ত্রী মিলেই বাড়ি বানিয়েছিলেন সেও বছর তিরিশ আগে।
টুকটাক কথা, লেখা নিয়ে আলোচনা হতে হতে কখন যেন ওরা দুজনেই দুজনের খুব ভালো বন্ধু হয়ে যান। আর ফোন নম্বর বিনিময়ও হয়।
দুজনের বাস্তব দূরত্ব খুব সামান্য হলেও
কথায় দূরত্ব একটুও নেই যেন।
লিখে নয় এরপর ফোনেই কথা বলা শুরু। জীবনের নানা ওঠা পড়া, না জানা কত কি পাওয়া আবার জানা চেনা হারিয়ে যাওয়া…. হতে থাকে বিনিময়।
অন্বয় বাবু খুব ভালো গান করেন আর গীতালী দেবীর উদাত্ত পাঠ, ফোনেই হতে থাকে। অনুভব শিল্পী মন দুটো এভাবে আরও কাছাকাছি চলে আসে।
একলা থাকলেই আজকাল কবিতা নয় গুনগুন করেন গীতালী, ‘টুকরো করে কাছি আমি ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি তোমার খোলা হাওয়া, লাগিয়ে পালে’ ….. হেসে ফেলেন নিজেই। আবার কি ডুবলাম!! গান তো গাইনি এতদিন….. কেন?? ঈশ্বর কি বন্ধু হয়ে সুরের জাদুকাঠি ছুঁইয়ে দিলেন??
এক ঐশ্বরিক সুখে নিমগ্ন হয়ে যান…..
ওদিকে অন্বয় এখন রবি ঠাকুর পড়ে উচ্চকন্ঠে পাঠ করেন,….
‘কে আমারে যেন এনেছে ডাকিয়া, এসেছি ভুলে।
তবু একবার চাও মুখপানে নয়ন তুলে।
দেখি ও নয়নে নিমেষের তরে
সেদিনের ছায়া পড়ে কি না পড়ে,
সজল আবেগে আঁখিপাতা দুটি পড়ে কি ঢুলে।
ক্ষণেকের তরে ভুল ভাঙায়ো না, এসেছি ভুলে।।’
অবাক হয়ে ভাবেন, কেন এতদিন এভাবে পাঠ করা হয় নি?? কত কি বাকি রয়ে গেছে জীবনে…. ভাগ্যিস ফেসবুকে মনের মতো বান্ধবী পেলেন।
শুরুর আলাপন এখন সুরে, পাঠে মন ছুঁয়ে থাকা ভীষণ ভালোলাগা এক আবেশে।
হারার বা হারিয়ে যাবার ভয় নয় এক স্বর্গীয় অনুভবে ডুবে থাকা জীবনের বাকি দিন। অগ্নিসাক্ষী নয়, সাতপাক নয়, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না হয়েও…..