তীর্থের পথে পথে — অম্বিকা কালনা — কোয়েলী ঘোষ
তীর্থের পথে পথে
অম্বিকা কালনা
কোয়েলী ঘোষ
অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল পূর্ব বর্ধমানের অম্বিকা কালনা যাবার । পুরনো মন্দির ,তার ইতিহাস , টেরাকোটার কাজ ছবিতে মুগ্ধ করেছিল । কাছেপিঠে এমনই এক তীর্থ ,প্রাচীন মন্দির শহর কালনা । ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এই শহরটি অম্বিকা কালনা নামে জনপ্রিয়।
একদিন সকালে বেরিয়ে ফিরে আসা যায় সন্ধ্যায় ।
সকালে ব্যান্ডেল কাটোয়া লোক্যাল ট্রেন ধরলাম । আমরা দুজন আর জয়া দি । কোন্নগর থেকে উঠলেন বিনয়দা , অলকদা আর প্রদীপ বাবু , তাঁর স্ত্রী সুপর্ণা ।
ট্রেন ছুটেছে , একে একে স্টেশন পেরিয়ে যাই । চেনা অচেনা স্টেশন পেরিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা পর নামলাম অম্বিকা কালনা য় । স্টেশনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদের পথ প্রদর্শক আশীষবাবু ,তাঁর বাড়ি কালনাতেই । ভাই জয়ন্ত তাঁকে পাঠিয়েছিলেন যাতে পুরো শহর তিনি দেখিয়ে দিতে পারেন । দুটো টোটো তিনি আগেই বুক করে রেখেছিলেন । তাতেই শুরু হল যাত্রা ।
অনন্ত বসুদেবের মন্দির
প্রথমেই এলাম অনন্ত বসুদেবের মন্দিরে । শান্ত নির্জন এই মন্দিরের ভিতরে কৃষ্ণবর্ণের নারায়ণ মূর্তি , রাধাকৃষ্ণ , জগন্নাথ সিংহাসনে সামনে একটি আটচালা । ছবি তোলা মানা দেখে অনুমতি নিয়ে কয়েকটি ছবি তুললাম ।১৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দে বৃহৎ আটচালা মন্দিরটি পিতামহী ব্রজকিশোরী দেবীর অনুরোধে রাজা ত্রিলোকচাঁদ নির্মাণ করেন।কালো কষ্ঠি পাথরে খোদিত নারায়ণ-বাসুদেব মূর্তিটি অপরূপ । প্রণাম জানিয়ে এলাম মা সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির ।
সিদ্ধেশ্বরী কালিমন্দির
দুপাশে দোকান পাট , টোটো এসে দাঁড়াল সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের সামনে । পুজোর জন্য ডালা কিনে ভেতরে প্রবেশ করলাম ।
আনুমানিক ৬৮৮ সালে ঋষি অম্বুরিষ পোড়ামাটির কারুকার্যখচিত এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। জনশ্রুতি এই মন্দির ঋষি অম্বুরিষের আরাধ্য দেবী । কালী অর্থাৎ অম্বি তাই এই মন্দিরকে অম্বিকা কালনা মন্দিরও বলা হয়।
অম্বিকা কালনার জোড় বাংলা শৈলীর এই মন্দির ।
প্রাচীন কালে ঘন জঙ্গলে ভরা ছিল এই অঞ্চল । বর্ধমানের রাজা চিত্রসেন রায় একদিন ঘোড়ায় চড়ে সেই পথ দিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেলেন ঘণ্টা বাদ্যের আওয়াজ । সেই শুনে তিনি সেখানে গিয়ে দেখলেন এক প্রাচীন মন্দির । এই মন্দিরেই তিনি নতুন মন্দির নির্মাণ করেন ।
দেবী নিম কাঠের তৈরি । লাল শাড়ি আর অলংকারে সুসজ্জিতা ।
পুজো দিয়ে বাইরে চাতালে এসে দাঁড়াই । লাল পোড়ামাটির তৈরী মন্দিরে অঙ্কিত আছে নগর সংকীর্তনের ছবি , বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্মের মিলনের চিত্র । দেবী এখানে বামা কালী । মন্দিরের পাশে আছে চারটি শিব মন্দির , তিনটি এক চালার শৈলীর ।
গোপালজিউ মন্দির
গোপালজিউ মন্দিরটি পঁচিশ চুড়ার মন্দির । কালনা শহরে চারটি এরকম মন্দির দেখা যায় । মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ আজও বিস্মিত করে ।ভেতরে ঢুকে গোপালজিকে দর্শন করলাম । পাশে রাধাকৃষ্ণ মূর্তিও আছে ।
শ্রীশ্রী নামব্রম্ভ জিউ মন্দির
টোটো আবার চলতে শুরু করেছে । গোলক সমিতির পাশের এক গলিপথ পেরিয়ে যে আশ্রমে এলাম সেটি ভগবান দাস বাবাজির আশ্রম । এই আশ্রমে তাঁর সমাধি আর পাতালগঙ্গা দেখলাম । প্রতিদিন স্নানে যেতে কষ্ট হত বলে মা গঙ্গা এখানে উঠে আসেন ।এখানে শ্রীরামকৃষ্ণদেব দুবার এসেছিলেন ।
ঠাকুর , মা আর স্বামীজির মূর্তি আছে পাশেই মন্দিরে ।স্থানীয় মেয়েরা সেখানে হাতের কাজ করছিল । সেই পথ ধরে ফিরে আবার টোটোতে এসে বসলাম । এবার যাবো বিখ্যাত সেই ১০৮ শিব মন্দির ।
কালনা ১০৮ শিবমন্দির
বিশাল ক্ষেত্র জুড়ে আছে বিখ্যাত ১০৮ শিবমন্দির । যদি ওপর থেকে ছবি তোলা হয় দেখতে পদ্মফুলের মত । মোট ১১২ টি মন্দির আছে ।মহারাজা তেজ চন্দ্র বাহাদুর ১৮০৯ সালে এই ১০৮ শিবমন্দির তৈরি করেন। দু’টো সমকেন্দ্রিক বৃত্তের ওপর তৈরি হয়েছে এই ১০৮ টি শিবমন্দির। ভিতরের বৃত্তে আছে ৩৪ টি আর বাইরের বৃত্তে আছে ৭৪ টি মন্দির। সবক’টি মন্দিরই তৈরি হয়েছে আটচালা স্টাইলে এবং প্রতিটি মন্দিরে আছে একটি করে সাদা আর কালো শিবলিঙ্গ।ভেতরের শিবমন্দিরে সব শিবলিঙ্গ সাদা ।
বর্ধমানের মহারাজ তেজ বাহাদুর স্বপ্নাদেশ পান । একের মধ্যে বহু এই ভাবনায় তিনি দেবাদিদেব মহাদেবের এত মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । সবুজ গালিচা পাতা , ফুল গাছে সাজানো পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই বিশাল শিবক্ষেত্র দর্শন করা হল ।
শীতের শুরু হলেও এতক্ষণে বেশ রোদ উঠেছে । মন্দিরের চাতালে বসে ব্যাগ থেকে আনা খাবার , আর জল খেয়ে নিলাম । ততক্ষণে অলকদা আর প্রদীপবাবু শিবের স্তোত্র পাঠ করতে শুরু করেছেন —
চলবে