#মূলাজোড় কালীবাড়ির পৌষ_মেলা @দেবযানীসেন
#মূলাজোড় কালীবাড়ির পৌষ_মেলা
@দেবযানীসেন(কবিতাকবিতা)
কবিগুরু যথার্থই বলেছেন ‘উপলক্ষ্য যাই হোক না কেন বাঙালির সকল উৎসবের মধ্যে একটা সার্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী গরিবের সামাজিক বিভক্তি বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না বরং সকল শ্রেণীর মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়।’ কালের বিবর্তনের সাথে সাথে আনুষ্ঠানিকতা পরিবর্তিত হলেও বাংলার সামাজিক উৎসব, পার্বণ গুলো জনমানুষের ঐতিহ্য, কৃষ্টি গুলো আজও হারিয়ে যায় নি। মেলা মানে মেলবন্ধন, এককথায় মহামিলন।
আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঐতিহ্য মন্ডিত ইশা খাঁ এর শহর, ভারতের অন্যতম অস্ত্র তৈরির কারখানা, ব্যস্ততম জনপদের একটি ইছাপুরে। যদিও আমাদের আজকের বিষয় বস্তু মেলা। আর সেটি ইছাপুরের প্রতিবেশী জনপদ শ্যামনগরের অধুনা মূলাজোড় কালীবাড়ির পৌষ মেলা। পৌষের কনকনে শীত আর মেলার যোগসাযোগ বহু পুরোনো। তবে এই মেলার বিশেষত্ব একটু আলাদা ধরনের। শীতেকালের এক অন্যতম সব্জী মূলো, আর এই মূলো জোড়ায় মায়ের কাছে প্রসাদ বা প্রথম প্রদান হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে। একটি পোড়া মাটির সড়ায় একজোড়া মূলো, নলেন গুড়ের সন্দেশ, রক্ত জবার মালা , এই প্রসাদ মা ব্রহ্মময়ীর পরম প্রিয়। মা কালী এখানে গঙ্গার তীরে ব্রহ্মময়ী রূপে বিরাজ করেছেন।
আমার মায়ের বাড়ি অর্থাৎ মামাবাড়ি শ্যামনগর এ হওয়ার সুবাদে খুব ছোট থেকেই মেলায় অবাধ যাতায়াত ছিল। অবাধ বললাম কারণ এক মাস ব্যাপী মেলা, মা-বাবার সঙ্গে বহুবার যাওয়া হতো। একটু বড়ো হয়ে বন্ধুদের সঙ্গেও গেছি। একবার মনে আছে খুব সকালে স্নান সেড়ে আমার এক প্রিয় বান্ধবী মৌসুমির সাথে গিয়ে উপোস থেকে মায়ের পুজো দিয়েছিলাম। তখন হয়তো খুব সম্ভবত কলেজে পড়ি। এরপরও বহুবার গেছি কিন্তু পৌষ মেলার সময় যাওয়ার আনন্দ ও আবেগটাই আলাদা। একমাস ব্যাপী একটি কালী মন্দির কে কেন্দ্র করে এই মেলার অবস্থান। আশেপাশের বহু জায়গা থেকেই ভক্ত ও দর্শনার্থীদের ভিড় হয়। যেহেতু পৌষ কালীর পুজো বাংলায় চিরাচরিত।
আরেকটি কারণ আমার মতে এখানের মনোরম পরিবেশ। গঙ্গার তীর, মন্দিরের সৌন্দর্য ও সহজলভ্য যাতায়াত। রেল স্টেশন, বাস রাস্তা ও জল পরিবহন তিনটেই খুব কাছাকাছি থাকায় লোকজনের আসা যাওয়ার খুব সুবিধে হয়। শোনা যায় মা ব্রহ্মময়ীর এই মন্দিরের আদলেই দক্ষিনেশ্বর কালী মন্দিরের রূপ দান করা হয়েছিল। স্বয়ং সাধক শ্রী রাম প্রসাদ সেন ও গঙ্গা বক্ষে নৌকায় হালিশহর যাওয়ার সময় তাঁর আরাধ্য মা’কে গঙ্গার ঘাটে দেখতে পেয়েছিলেন। আরো বহু ঘটনা লোকমুখে প্রচলিত আছে। তবে মা ব্রহ্মময়ীর অপার মহিমা, কেউ খালি হাতে ফেরেন না মায়ের কাছ থেকে। সকল ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে মা।
পঞ্চদশ শতকে কবি বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসা ভাসান’ কাব্যে গঙ্গার দু’পারের বর্ণনায় কবি লিখেছিলেন ” মূলাজোড়া গাড়ুলিয়া বাহির সত্বর/পশ্চিমে পাইকপাড়া বাহে ভদ্রেশ্বর/ চাঁপদানি ডাইনে বামেতে ইছাপুর/ বাহ বাহ বলি রাজা ডাকিছে প্রচুর।” একপ্রান্তে মূলাজোড় কালীবাড়ি ও অন্যদিকে মাদরালে জয়চন্ডীর মন্দির একসময় জঙ্গলাকীর্ণ এই মন্দির ছিল ডাকাতদের সাধনক্ষেত্র। বর্গী আক্রমণের সময়েও স্থানীয় রাজাদের কাছে নিরাপদ ছিল জলা আর জঙ্গলে ঘেরা এই ছোট্ট জনপদটি।
কথিত আছে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল এই জনপদ, বর্গী হামলার সময় বর্ধমানের রানী কৃষ্ণ কুমারী দেবী রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে রামদেব নাই নামে এক কর্মচারীর নামে শ্যামনগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইজারা নিয়ে বর্তমান কাউগাছির নিকট একটি গড় তৈরি করেছিলেন। তখন এই অঞ্চলের নাম ছিল শামুক গড়। রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়ের উত্তরসূরী, গবেষক সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতে শামুক আকৃতির গড় ছিল বলে এই নামকরণ হয়েছিল। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তিত হয়ে শামনগর ও বর্তমানে শ্যামনগর হয়েছে। কিন্তু আজও পোস্ট অফিসের নাম শামনগর ই আছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কবি রায় গুনাকার ভারতচন্দ্র কে এখানে সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থান গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। কবি রায় গুনাকার ভারতচন্দ্র একটি টোল ও খুলেছিলেন তির নিদর্শন স্বরূপ মূলাজোড় ভারতচন্দ্র পাঠাগার আজও বর্তমান।
আরেকজন বিখ্যাত মানুষ ছিলেন কান্তিচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, যাঁর নামে এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো ও ঐতিহ্যশালী স্কুলটি আছে । কান্তি চন্দ্র ছিলেন জয়পুরের রাজার দেওয়ান। পন্ডিত এবং বিচক্ষণ এই মানুষটির নামে জয়পুরে একটি রাস্তাও আছে। তবে শ্যামনগরের ইতিহাস বা সাক্ষ্য যতটুকু ধরা আছে তা ব্যক্তিগত ছাড়া রয়েছে এই ভারতচন্দ্র পাঠাগারে।
( ক্রমশঃ…….)