সুবর্ণরেখার তীরে কোয়েলীর সাথে
সুবর্ণরেখার তীরে
কোয়েলীর সাথে
গালুডি ড্যাম
দূরে পাহাড় আর নিচে বয়ে চলা সুবর্ণরেখা নদী … গাড়ি এসে দাঁড়াল গালুডি ব্রিজের ওপর ।
ঘাটশিলার কাছে গালুডি একটি ছোট্ট শহর আর স্বাস্থ্যকর স্থান । স্টেশন থেকে দশ কিলোমিটার দূরে সুবর্ণরেখা নদীতে বাঁধ দিয়ে এই বিশাল জলাধার তৈরি করা হয়েছে। এখানে নেমে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই ।
গালুডির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সাতগুরুং নদী।এই নদীর সাতটি ধারা দলমা পাহাড়কে সাতটি ভাগে বিভক্ত করে বেঁধে রেখেছে । গালুডির চারপাশে আছে ছোট ছোট টিলা । ট্রেকিং করতে পারা যায় ।
কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম নিচে সুবর্ণরেখা নদী কে । তারপর আবার গাড়িতে চলা শুরু হল ।
ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলেছে । কিছুক্ষণ পর আমরা রংকিনী দেবীর মন্দিরে এসে পৌঁছলাম ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতুলনীয় একটি গল্প আছে ” রঙ্কিণী দেবীর খড়গ ”।
চারিদিকে বিস্তৃত শালবন , দলমা ফুলডুংরি পাহাড়ের কোলে এই মন্দির ঘিরে আছে এক রহস্য , এক রূপকথা ।
মন্দিরের গাত্রে ওপরে দেবী দুর্গার মূর্তি নজরে পড়ল । মা দুর্গারই আর এক রূপে তিনি পূজিত হন । তিনি ছিলেন মল্ল রাজপুতানার রাজপুতদের আরাধ্যা দেবী । রাজা জগত শেঠ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । প্রবাদ আছে এখানে নরবলি দেওয়া হত ।
রুপকথার এক প্রচলিত গল্প আছে –রাজকন্যা চিত্রলেখা আর রাজকুমার ইন্দ্রকুমারের প্রেমকাহিনী । দুজনের মধ্যে এই প্রেম রাজা মেনে নিতে পারেননি কারণ দুই পরিবারের বিরোধ ছিল ।তাই রাজবন্দি করে ইন্দ্রকুমারকে বলি দিতে নিয়ে যাওয়া হয় দেবীর কাছে । এদিকে চিত্রলেখা মায়ের কাছে পুজো করেন । তিনি আকুল হয়ে প্রার্থনা করেন তার ভালবাসাকে রক্ষার জন্য ।
এক অমাবস্যার রাত । হাঁড়ি কাঠে ইন্দ্রকুমারের মাথা গলিয়ে দেবার পর ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা ।দেবীর হাত থেকে ছিটকে খড়গ এসে ছিন্ন করে দেয় ঘাতকের মস্তক । সন্তানকে এভাবেই তিনি রক্ষা করেন ।
রাজা অবশেষে এই বিয়েতে সায় দেন আর তখন থেকেই বন্ধ হয়ে যায় নরবলি ।
মন্দিরের বাইরে আর ভেতরে অনেক ঘণ্টা বাঁধা ।সিঁদুরে চর্চিত এই মায়ের শিলা মূর্তি প্রণাম করে বাইরে এসে দেখলাম পাশের শিবমন্দিরে প্রদীপ জ্বলছে । প্রণাম ও দর্শন করে আমরা ফিরে যাচ্ছি ঘাটশিলা । তখন সন্ধ্যা নেমেছে । নির্জন পথ আর নিস্তব্ধ পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলেছে ।
রঙ্কিণী দেবীর দুটি মূর্তি আছে । গাড়ি থেকে নেমে আমরা পায়ে হেঁটে ঘাটশিলার দেবীকেও প্রণাম করে এলাম । দুদিকে বাজার । সেই মন্দিরে দেখা হল কলকাতা থেকে আসা এক মা আর মেয়ের সাথে । গতবার তাঁরা মানত করে গিয়েছিলেন । সেই মানত পূর্ণ হলে আবার পুজো দিতে এসেছেন ।
রাতে নিচের হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়লাম ।
পরের দিন আবার যাব টাটা -জামশেদপুর ।
টাটা – জামশেদপুর
বেশ সকালে তৈরি হয়ে নিচে নেমেছি সবাই । কালকের সেই একই গাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছে । । যাবার পথেই পড়ল ডিমনা লেক ।
ডিমনা লেক আর চান্ডিল ড্যাম
দলমা পাহাড়ের পাদদেশে এই লেকে গাড়ি দাঁড়াল । ৭০ ফুট গভীর , ৭ কিমি লম্বা আর দুই কিমি চওড়া এই লেক । বেশ কিছু সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠা গেল । সামনে রেলিং ধরে দাঁড়াতেই দুটি চোখ মুগ্ধ হয়ে গেল ।সবুজ দলমা পাহাড় ঘিরে রেখেছে নীল রঙের বিশাল জলরাশি । অপূর্ব দৃশ্য । শান্ত নির্জন জায়গা । দূরের সেই পাহাড় থেকে হাতির দল নেমে আসে ফসলের ক্ষেতে ।
এখানে বোটিং করা যায় কিন্তু আমরা টাটানগর যাব বলে আবার সেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম । নিচে নেমে দেখি স্থানীয় লোকজন ছোট ছোট দোকান করেছে । তখন গাছের তলায় বসে চা , ঝাল মুড়ি , তেলেভাজা খাওয়া হল ।
তারপর আবার যাত্রা শুরু হল । টাটা যাবার রাস্তা বেশ খারাপ । ধুলো উড়ছে ।
জুবিলি পার্ক
ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্যতম শিল্প নগর টাটা নগর ।
গাড়ি এসে দাঁড়াল জুবিলি পার্কের কাছে , বিশাল বড় বড় গাছের ছায়ায় । ২৪০ একর জায়গা জুড়ে আছে এই পার্ক । সামনে বেশ বড় লেক ।
নানা রঙের গোলাপ ফুটে আছে গোলাপ বাগানে ।
টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে ছোট ছোট সাদা রঙের গাড়ি ভাড়া করা হলো কারণ এত বড় পার্ক পায়ে হেঁটে দেখতে সময় লাগবে আর কেউ কেউ বয়স্ক মানুষও আছেন । গাড়ি এক একটি জায়গায় থামলে পায়ে হেঁটে দেখে আবার তাতে চেপে বসে গোটা পার্ক ঘুরে দেখা হল । নানারকম দুষ্প্রাপ্য পাখির দেখা পেলাম ।রোদ্দুরে রোদ পোহাচ্ছে সাদা কুমীর ।গাছের নিচে বসে আছে বাঘ ,সিংহ । বেশ বড় জায়গায় প্রাকৃতিক পরিবেশে ওরা ছাড়া আছে তাই বেশ নিজের ইচ্ছেমত বিচরণ করছে । এক পাল সাদা হরিণ দেখা গেল । এই সুন্দর সজ্জিত পার্কটির রক্ষণাবেক্ষণ করেন টাটা স্টিল ।
পাশেই আছে জয়ন্তী সরোবর , সাইবাবা আর কালী মন্দির ।
এবার ফেরার পালা । টাটানগর থেকে ফিরে বিকেলের ট্রেনে হাওড়া ফিরে এলাম ।
মাত্র তিনদিনে পাহাড় , নদী , ঝর্ণা , জঙ্গল , মন্দির সব মিলিয়ে রয়ে গেল এক অপূর্ব অমলিন স্মৃতি ।
মনপাখি কখনো হারিয়ে যেতে চায় সেই পথে , বাঁশিটি বাজে দূরে সেই পথের বাঁকে ,
সুবর্ণরেখার বুকে স্বপ্নিল ছবি আঁকে …
সমাপ্ত