সম্পাদকের কলমে কিছু কথা গীতশ্রী সিনহা সম্পাদক বিনোদন বিভাগীয় ।

সম্পাদকীয়

সুখের আমেজ মাখা শীতের হাওয়ায় মেলার গন্ধ ছড়ানো… মেলা সচল জীবন্ত ঐতিহ্য। মেলা মানেই মিলন, বন্ধন, উৎসব। বাংলায় ‘মেলা’ শব্দটি বহুত্ববাচক। বহু কিংবা অনেককে নির্দেশ করে এই শব্দটি। বিশেষ কোন উদ্দেশে অনেক মানুষের মিলনের, বিভিন্ন দ্রব্যের বিকিকিনির স্থানই সাধারণভাবে মেলা হিসেবে পরিচিত আমাদের কাছে। মানুষে মানুষে মিলনের, সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিতে মিথষ্ক্রিয়ার, শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিভেদ দূর করার অবারিত প্রান্তর হচ্ছে মেলা। ধর্মীয় কারণে, ঋতুভিত্তিক কিংবা কোন ব্যক্তি বা ঘটনার স্মরণ উপলক্ষ্যে নানা কারণে মেলার উদ্ভব ঘটেছে বলে নানা ধরণের মেলা দেখা যায়। তবে চরিত্রগত দিক থেকে সব মেলা প্রায় একই রকম। অনেক মানুষের মিলন, নানা ধরণের দ্রব্যের বিকিকিনি, এই সাধারণ রূপকল্পটি এক অর্থে মেলার একটি সার্বজনীন চরিত্র দাঁড় করিয়েছে। একটি জাতির বা গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র প্রকাশের, লালন পালনের বা চর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র এটি। কোন একটি জাতির বা গোষ্ঠীর বৈচিত্রপূর্ণ সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর বহিঃপ্রকাশ হয়ে থাকে মেলার মাধ্যমে। এর বিবিধ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বিপনন কেন্দ্র হিসেবে এটি স্থানীয় বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের বিলুপ্তি রোধ করে।
প্রতিটি ঋতুরই রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। শীত ঋতুও এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষের মনের উপর ঋতু এবং প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ গভীরভাবে ক্রিয়া করে বলেই হয়তো মেলার সাথে ঋতুর সংযোগ অত্যন্ত নিবিড় এবং জোড়ালো। ষড়ঋতুর এই দেশে অন্যান্য ঋতুর চেয়ে শীত খানিকটা এগিয়ে আছে মেলা আয়োজনের উৎকৃষ্ট সময় হিসেবে।
কৃষি সংস্কৃতিতে ফসল রোপন এবং ফসল উত্তোলন- এই ঘটনা দুটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সনাতনী সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় এই দুটি উপলক্ষ্যকে সামনে রেখে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ও সংস্কৃতি নির্ভর বাংলার মানুষ উৎসব করে, আনন্দে মাতে। অগ্রহায়ণ ফসল উত্তোলনের মাস। মূলত সারা অগ্রহায়ণ মাস তে থেকে ফসল তোলা হয় বলে এই সময় কৃষকের ব্যস্ততা থাকে বেশি। শীতের শুরুতে জমির ফসল ঘরে উঠলে কৃষকের অখণ্ড অবসর। সারা বছরের কান্তি ঝেড়ে একটু হাফ ছেড়ে, হাত-পা ছেড়ে নড়েচড়ে বসা যায় এ সময়। এই অবসর সময়ে গ্রামীণ জনপদগুলো জেগে ওঠে নিজস্ব সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ যেমন- গান, নাটক, খেলা ইত্যাদি চর্চার ভেতর দিয়ে। অর্থাৎ উৎসবের একটা স্বতস্ফূর্ত আয়োজন চোখে পরে এসময়। এগুলো আয়োজনের জন্য যে বিশাল খোলা মাঠ দরকার হয়, তাও এইসময় সহজলভ্য থাকে মাঠে ফসল না থাকার জন্য। ফলে ঘোড় দৌড়ের আয়োজন, পুতুল নাচ কিংবা যাত্রার আয়োজন করা সহজ হয়ে যায়; যেগুলো গ্রামীণ সমাজে উৎসবের অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষঙ্গ। বছরের অন্যান্য সময় মাঠ ভর্তি ফসল থাকে বলে এগুলো আয়োজন করা সম্ভব হয় না। এসময় কৃষকের হাতে ফসল বিক্রি করা কাঁচা টাকারও অভাব থাকে না। হাতে টাকা থাকে বলে মেলার আয়োজন হয় স্বাভাবিক স্বতস্ফূর্ততায়। বিশাল খোলা মাঠ, হাতে কাঁচা টাকা আর সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর অবসর ও সুকুমারবৃত্তির চর্চা- আবহমান কাল ধরে গ্রামগঞ্জে শীতকালে মেলা বসার এই সরল সমীকরণ ধারণা করা যায় বাংলার আদি ইতিহাসের সাধারণ তথ্যের ভিত্তিতে। তাছাড়া উৎসবে ব্যাঘাত ঘটানোর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ শীতকালে নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে তাও খুব ণস্থায়ী। শীতকাল মেলা আয়োজনের আদর্শ সময় বলে বিবেচিত হবার এটিও একটি বড় কারণ।
গ্রামীণ মেলাগুলো সাধারণত বারোয়ারি হয়ে থাকে। একটি গ্রাম কিংবা একাধিক গ্রামের মানুষের মিলিত অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সক্রিয় সহযোগিতায় আয়োজিত হয় মেলাগুলো। এটি গ্রামীণ জনপদে মেলা আয়োজনের সাধারণ চিত্র।
এবার আসা যাক আমাদের বর্তমান নগরকেন্দ্রিক মেলার কথায়। আমাদের শহরের অধিবাসীরা মনেপ্রাণে শতভাগ নাগরিক হয়ে উঠতে পারেনি বলে এখনো তাদের মনোরঞ্জনের জন্য প্রয়োজন হয় গ্রামীণ আবহ। মূলত মেলার গ্রামীণ ধরণকে তুলে আনা হয়েছে নগরে। যেহেতু এটি ইতিমধ্যে গ্রাম থেকে নগরে এসে পড়েছে তাই এতে যুক্ত হয়েছে কিছু নাগরিক উপাদান। দেশের বিভিন্ন শহরে পৌষ মেলা নাগরিক বিনোদনের একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। শহরগুলোতে শীতের মেলা হিসেবে সাধারণত পৌষমেলাই আয়োজন করা হয়। এছাড়া তেমন কোন মেলা চোখে পড়ে না। আজ থেকে এক দশক পূর্বেও মফস্বল শহরগুলোতে পৌষ মেলার আয়োজন করা হতো স্থানীয়ভাবে, চাঁদা তুলে। তবে বর্তমানে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের স্পন্সরশীপের কারণে এখন আর স্থানীয়ভাবে চাঁদা তুলে আয়োজন করতে হয় না বেশিরভাগ মেলা। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নানাভাবে এসব মেলাকে পৃষ্টপোষকতা করে আসছে। এই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় নগর কেন্দ্রিক মেলার চেহারা একটু ভিন্ন হয়ে গেছে। যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন নাগরিক অনুষঙ্গের পাশাপাশি হাইটেক অনুষঙ্গও। এই প্রক্রিয়াটি ভালো কি মন্দ সেটা বিচার করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বর্তমান অবস্থা এগুলোতে বৈচিত্র্য তেমন না থাকলেও ভিন্ন ধরণের একটা স্বাদ আছে। অনেক দর্শক-ক্রেতা আসে এসব মেলায়। ক্রয়বিক্রয় হয় বিভিন্ন দ্রব্যের।
আবহমান বাংলার জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী একটি সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ মেলা। ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে বিভিন্ন ধরণের বৈশিষ্ট্যের ছাপ পড়েছে এর উপর। এটি একদিকে যেমন জনমানুষের উৎসবের অন্যতম জনপ্রিয় অনুষঙ্গ অন্যদিকে লোকায়ত সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গকে বাঁচিয়ে রাখার কৃতিত্বও এর। ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁক ঘুরে বর্তমানে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে মেলাগুলোর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এইসব আয়োজনের কারণে শহরগুলোতে শীতের আনন্দের মাত্রা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এসো সবাই শীতদিনের শুভেচ্ছা শুভকামনা নিয়ে ভালো থাকি।
গীতশ্রী সিনহা সম্পাদক বিনোদন বিভাগীয় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *