‘হেরে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত, কুয়াশার কাছে… ‘ দুলাল কাটারী
‘হেরে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত, কুয়াশার কাছে… ‘
দুলাল কাটারী
স্ট্যান্ডে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে
বাসটা আবারও চলতে শুরু করতেই
ঝাঁকুনিতেই বোধহয়, এক্কেবারে পিছনের সিটের ঠিক মাঝখানে বসে থাকা ছেলেটির হাতে থাকা মানিব্যাগটা ধপ্ করে পড়ে যেতেই
আপনাআপনি চোখ গিয়ে পড়লো ছেলেটার মুখে।
মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভাড়া মিটিয়ে সামনে একবার তাকিয়ে আবারও চলতে শুরু করলো বাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
এদিকে আমি ততক্ষণে কিছুটা বেতাল হয়ে গিয়ে আবারও ছন্দে ফিরতে একপ্রকার বাধ্যই হলাম
কারণ
আমার নিজের মুখটা ফিরিয়ে নিতেই হলো তার থেকে।
তখনও আমার দিকে নজর পড়েনি তার।
হয়তো নজর দেওয়া প্রয়োজনও মনে করে নি।
আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় সাড়েচারবছর বা সোয়া পাঁচবছর হবে।
তখন থেকেই একটি বারের জন্যও আমার মুখটা দেখা প্রয়োজন বোধ করেনি,
তাহলে আজ যে তার ব্যাতিক্রম কিছু হবে সেটা আশাও করি নি।
তবে অসচেতনভাবেও তো একবার তাকাতেই পারতো…
না। সেরকম কিছুই ঘটলো না।
কিন্তু একটা সময় ছিলো
যখন প্রতি দিনে কতবার যে নানা ছলচাতুরীর খেলা খেলতে খেলতে
আমার মুখটা দেখতো,
তার সবই কালের ঠেলায় অতীত এখন।
বিকেলে অন্তত একবার কারণে বা অকারণে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে
হেঁটেই হোক আর ভাঙাচোরা সাইকেলটা নিয়েই হোক পেরিয়ে যেতেই হতো,
সে যত কাজই থাক আর যত ব্যস্ততাই থাক।
সিগনাল দেওয়ারও কত রকমের যে কায়দা ছিলো তার!
পাড়াতে প্রেম করায় যতটা ফায়দা তোলা যায় সবটাই তুলে নিতো বেহায়াটা…
মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর তো আর তাকানো যায় না।বা তাকালেই যদি…
তাই উসখুস করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
সেই মুখটা! যেটা দেখার জন্য ব্যকুল মন রাস্তার দিকে চোখ রাখতো পরন্ত বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে অব্দি…
মুখোমুখি হওয়ার ভয়েই তো এতোদিন সামনে আসেনি,
তাহলে আমিই বা কেন মুখের সামনে আসবো লাজলজ্জার মাথা খেয়ে?
তবু তো কয়েক বার পাড়ার পুজোতে আমি বাপের বাড়ি এসেছি, একটি বার অন্তত দেখার আশায়।
নারীর বুক তো!
পাহাড়ের মতো যতই শক্ত করতে চাই না কেন
তবুও ঝর্ণার ধারার হয়ে বারবার বয়ে নিয়ে যায় মোহনায়…
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে রইলো বাস
ডাইভারের কাছের কাচে, মানে কেবিনের কাচে
পিছনের সিটে বসে থাকা মুখটি ভেসে উঠছে বারবার।
একটানা নয়,
ভেসে আসছে। আবারও সরে যাচ্ছে। আবারও আসছে…
দোদুল্যমান বাস। রাস্তাটি খুবই এবড়োখেবড়ো। ঠিক যেন আমাদের রিলেশনশিপ এর রাস্তার মতোই মনে হচ্ছে। এবড়োখেবড়ো, তাল- মাত্রা হীন,ছন্দহীন একটা রিলেশন ছিলো আমাদের…
সেই রিলেশনে ছিলো শুধুই অনিশ্চয়তার ভয়।
আমি গরীব বাড়ির মেয়ে, আমাদের বাড়িতে পড়াশোনার চাষ খুব বেশি দূর এগোবে না এটা বুঝতেই পারতাম দুজনেই। বড়ো মেয়ে ছিলাম বলে আমারই সবচেয়ে প্রথমে বিয়ে হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা ছিলো,বাকিদেরকেও তো উদ্ধার করতে হবে, হলোও তাই…
এদিকে তখন সে সবে মাত্র উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে কলেজ পড়তে কলকাতায় গেছে।
কিছু কাজই করে না বললেও ভুল হবে,
প্রাইভেট পড়িয়ে নিজেরটা কোনো মতে চালায়।
এদিকে তার বাবাও গত হলেন ফার্স্ট ইয়ার শেষের আগেই।
সংসারের চাপটাও এসে পড়লো সম্পর্কের ঘারে।
মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে তর্কে বা ঝগড়ায় হেরে যেতো। ইচ্ছে করেই হয়তো হারতো।
আমিও ওর হার মানা দেখে খুশি হতাম।
কিন্তু এই ভাবে জীবনের কাছে ওর হেরে যাওয়ায়,সম্পর্কের কাছে ওর হেরে যাওয়ায় আমি খুশি হইনি মোটেও …
দুলতে থাকা মুখের উপরে দীর্ঘ দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাচ্ছে না।
তবে দেখতে তেমন অসুবিধাও হচ্ছে না,
চুল বেড়েছে আগের থেকে অনেকটা বেশি, কান ঢেকে রাশি রাশি চুলের ঢেউ ঘারের দিকে বয়ে গেছে,দাড়িও…
গোলগাল মুখটার অনেকটাই কালো রেশমের মতো দাড়িতে দখল করেছে।
মাঝে মাঝে ঝাপটা হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে রাশিরাশি চুল গুলো…
কিছুটা উদাস উদাস ভাব। সাদামাটা পোশাক।
শহরে পড়াশোনা করে বলে বোঝা যাচ্ছে না।
আগের মতোই সাদামাটা।
বরং আগে বেশ কিছুটা চাকচিক্য ছিলো।
চোখে আগুন ছিলো।
কালো সমুদ্রের মতো দুটো চোখ দিয়েই তো আমার মতো গ্রাম্য একটা মেয়েকে ঘায়েল করতে পারতো, অনায়াসেই…
আমার তো আর বেশি কিছু চাওয়া পাওয়া ছিলো না।
শুধুমাত্র ওই চোখ দুটো…
ওই চোখ দুটোর সামনেই আমি আমার সারাজীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।
আর না হয় আমাকে শরতের কয়েক খন্ড মেঘ দিতো,
দুফোঁটা চকচকে রোদ দিতো
আমি তার কুচি কুচি স্বপ্ন গুলো জুড়ে দিয়ে প্রবল গ্রীষ্মে একটুখানি শীতলতা তো দিতেই পারতাম, নাকি!
তার ভাঙা ঘরে জ্যোৎস্নার আলো হয়ে থাকতাম, এর বেশি আর কি-ই বা আছে চাওয়া-পাওয়ার…
তাকে যখন বলতাম ‘তুমি আমাকে ব্যবহার করছো না কেন?’
অথবা ‘তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি আত্মসাৎ করেছো না কেন?’
সে শুধু বলতো ‘আমি হেরে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত কুয়াশার কাছে।’
এখনও মনে হয় ওই চোখ দুটোর সামনে গিয়ে একবার দাঁড়াই।
মনে হচ্ছে এখনই ছেলের বাবার কোলে ছেলেটাকে ধরতে দিয়ে একবার শাড়িটা গুছিয়ে নেওয়ার ভান করে
অথবা তুলে রাখা ব্যাগটা থেকে জলের বোতলটা নেওয়ার ভান করে একবার উঠে দাঁড়াই সিট থেকে,
যদি একবার অন্তত ওই চোখ দুটোর থেকে ছুটে আসা নির্মম, নিষ্ঠুর বাণে বিদ্ধ হতে পারি, তাহলে…
তাহলে আমার জীবনটা ধন্য হতো আবারও একবার…