||| উঠোন …. কলমে : তপন ঘোষাল

||| উঠোন …. কলমে : তপন ঘোষাল।

মা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঝাঁট দিতেন আমাদের বাড়ির উঠোন টা ……
ঘুম ভেঙ্গে জেগে দেখতাম
সেটা কেমন চকচক করছে,
কখনো সখনো রঙ-বেরঙের অল্পনায়
সেজে উঠত তার বিভিন্ন কোণ |
উঠোনের ধারে ধারে বেল, জুঁই, রজনীগন্ধা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা,জবা, টগর ফুল ফুটে থাকত আর থাকত নটারে মণি …
তার প্রস্ফুটিত হওয়া দেখে স্নান করতে যেতাম স্কুল যাব বলে |
ঠিক যেন টাইম মেশিন একটা !..
ঠিক সাড়ে নটা’য় রেডি হয়ে
মাকে বলতাম, “খেতে দাও” ..
মা অমনি সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে দিতেন মোটা চালের ফ্যানভাত, একটু আলুভাতে, কপাল ভালো থাকলে মাঝে মাঝে জুটত গাওয়া ঘি …
আয়েশ করে তাই খেয়ে স্কুলের ব্যাগটা নিয়ে দিতাম এক ছুট !.. মা বকতেন “খেয়েদেয়ে কেউ এভাবে ছোটে ?” কিন্তু কে শোনে কার কথা !.. বন্ধুরা তখন কেউ গরু, কেউ ছাগল, কেউ মোরগের ডাক নকল করে আমায় ডাকছে যে !.. মা সেই দৃশ্য দেখে মুচকি হাসতেন ,, আমার অভ্যাস ছিল যত দূরেই যাই না কেন একবার অন্তত পেছন ফিরে মাকে দেখা —— মা সঙ্গে সঙ্গে হাত নেড়ে অভয় দিতেন | আমিও ওদের সঙ্গে একছুটে পার হয়ে যেতাম “গোল্লা ছুটের মাঠ” ! ..
উঠোনটা তখন যেন হয়ে যেত ম্রিয়মাণ …
আমার পড়াশোনা, আমার খেলাধুলা, সেই বয়সে আমার সব রকম দুষ্টুমির সাক্ষী ছিল সেই উঠোন |
সেই উঠোনেই বাবা একবার লাগালেন সেগুন গাছের চারা ..
আমার উদাস বাউল বাবা ! গানের গলাটি ছিল পরিস্কার ঝরঝরে …
নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিস্কার করা ছিল
তাঁর নিত্যকর্ম |
মা বলতেন, “ঐ গাছ বড়ো হতে হতে আমরা বুড়ো হয়ে যাব … হয়তো আমরা ওর বেড়ে ওঠা দেখার আগেই মরে যাব |”
বাবা বলতেন, “এগুলো কি আমাদের জন্য ?তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি কোনদিন !.. না ভালো পোশাক, না ভালো খাবার, কিন্তু এই গাছগুলো যদি মানুষ হয়, আমার ছেলেদের কিছু উপকার তো হবে!”
বলেই বিড়ি ধরিয়ে কোথায় যে এক নিমেষে মিলিয়ে যেতেন, তাঁর টিকিটি খুঁজে পাওয়া যেত না আর |
মা আঁচলের খুঁট দিয়ে অন্যদিকে ঘুরে চোখের জল মুছতেন, বুঝতে পারতাম | সঙ্গে সঙ্গে মাকে জড়িয়ে ধরতাম | মা আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলতেন, “মানুষের মতো মানুষ হতে হবে, অনেক বড়ো হতে হবে তোদের বাবা |”…
কেন জানিনা, সেই বয়সেই এ কথা শোনামাত্র আমার চোয়াল শক্ত হয়ে যেত |

আজ বাবা নেই কিন্তু সেই চারাগাছ আজ মহীরুহ !
মা’ও আজ ভিন গ্রহের বাসিন্দা —-

কিন্তু উঠোনটা আজও রয়েছে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে | সময়ের তালে তালে কিছু পরিবর্তন, কিছু পরিবর্ধন তো হয়ই …
সেসব ফুল কবেই বিদায় নিয়েছে |
তবে গোলাপ, জবা, আর টগর ফুলের গাছটা আজও আছে ….
আর আছে মা- বাবার কিছু স্মৃতি
সেই উঠোন জুড়ে —-
আজ ভাবি জীবনের কত উত্থান-পতন ঘটে,
কত’শত পরিবর্তনও তো হয়, কিন্তু মৃত্তিকা ?
আমরা কেন তার মতো
সহনশীল হতে পারি না ?
আমরা কথায় কথায় রেগে যাই,
স্বার্থে ঘা পড়লে মেজাজ হারিয়ে
হয়তো বা হাত পা’ও চালিয়ে দিই ….
মুখোশ খুলে গেলে আসল চরিত্র বেরিয়ে আসে, বেরিয়ে আসে কুৎসিত দাঁত নখও …
একটু সহ্য করার ক্ষমতা,
একটু ধৈর্য্যশীল হয়ে ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা আমরা আর কই করতে পারি ?
সহনশীলতা যেন আমাদের ভেতর থেকে প্রতিদিন উবে যাচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে অহেতুক ক্রোধ, লালসা, আরো —- আরো —- চাই
এর নিত্য নৈমিত্তিক বাহানা !

যদি হতে পারতাম ওই উঠোনটার মতো ?

যদি ? যদি ? যদি ? ………..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *