স্বপ্ন-সাম্পান ( ৩ ) —– ঋদ্ধি ঘোষ
স্বপ্ন-সাম্পান ( ৩ )
—————————–
—-// ঋদ্ধি ঘোষ
গাছের আড়ালে স্থির । হিসেব করিনি সময়ের সাথে, গেয়েও উঠিনি কোনও ব্যর্থতার গান—তবু করবী-রঙের বুক, চরায় থেমে ছিল একটা ভেসে আসা মান্দাস… !
স্বপ্ন বলেই কিনা জানিনা— তবে, বিষন্নতা ঢাকা একটা কাঠের স্তম্ভকে করাতকলে পাঠাবার আগেই, কবির বাড়ির সদর দরজার বাইরে একটা সুপুরি গাছে চোখ গ্যালো । এই তুমুল ঝড়েও এসেছে একটা কাঠঠোকরা…! না, সুপুরি গাছ নয় সেদিন ঠুকরে গিয়েছিল আমার একশো আট স্মৃতি ।
আমার বুক থেকে খসে পড়ছে বিশ্বাস আর শূন্যতার রহস্য । কবির উঠোনে গন্ধরাজ ফুলের গন্ধঘোরই কী বুঝিয়ে দিলো, ঝড় তো মাঝেমধ্যে সত্যের নৈবেদ্য সাজায় জীবনের কাছে । একটা সময় চাইতাম থেমে যাক । সেদিনে ঠিক কী চেয়েছিলাম জানিনা । দু’একটা শুকনো পাতা উড়ে আসতেই মনে পড়ল কবির লেখা…
“দূরের পথ দিয়ে ঋতুরা যায়, ডাকলে
দরজায় আসে না কেউ ।
অযথা বাঁশি শুনে বাইরে যাই,
বাতাসে হাসাহাসি বিদ্রুপের…”
চোখ নয়—মন দিয়ে দেখেছি সেদিন বুকের রহস্য আটকে, কেমন তিরতির করে আমার আঙুল বেয়ে উঠে আসছে, শৈশবের শিমুলগাছ…! সমস্ত ইঙ্গিত, ইশারা— ভুলে গিয়েছিল যে বিলিকাটা আঙুল, তা ঐ ভোরেই খই ছড়িয়েছিল অনন্তের পথে ।কবি, এমন ঝড়ের ভোরে তোমার কাছে না এলে জানা হত না যে, এমন মেঘকালো ঝড়েও কীভাবে চোখ থেকে একে একে তারা খসে…!
ঝড় খানিক চুপ । ভাবলাম কবি এলেই,আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে তার সন্তানকে । তাই চোখ রাখলাম, তার লেখা সেই কথোপকথনের পাতায়…
— প্লিজ ফোনটা ধরুন
— ব্যস্ত ?
— বলুন
— যে কাজ করছিলেন তা কী মিটল
— হ্যাঁ
— আপনাকে ফোন কী করতে পারি ?
— কী হবে ফোন ক’রে… ভালো থাকুন
— প্রাণ পাবো
— নিজের কাজের মধ্যেই পাবেন…আমাকে ফোন আর কোনওদিনই করবেন না…কখনও না…আপনি ভালো থাকুন আর নিজের কাজের মধ্যেই ডুবে থাকুন
— ঐ যে বললাম, আপনি মুখ ফিরিয়ে নিলেও বারবার ফিরে আসব…কখনও ভালোবেসে, কখনও-বা নিন্দুক হ’য়ে…আবার কখনও মৃত্যু-পথের সাথী হ’য়ে
— নিন্দাকে ভয় পাই না আমি…তা যতখুশি কেউ করুক
— ফোনটা তুলুন…নয়তো একবার ফোনটা করুন…আমি বাইরে গেছিলাম
— সরি, ঘুমান
— এক দাদা ফোন করেছিলেন… একটা স্ক্রিপ্টের ব্যাপারে কথা বলতে…একবার ফোন করুন…আর কেউ করবে না, আপনি করুন
— আপনি কী ব্যস্ত ?
— একটা কথা বলি আপনাকে…কিছু মনে করবেন না… আমি আপনাকে ব্লক করলাম… আপনি ভালো থাকবেন…আর হ্যাঁ, চোখের ডাক্তার দেখিয়ে
নেবেন… শুভরাত
ঝিরঝির বৃষ্টি…। এই কথোপকথনের পাতা থেকে চোখ সরে গ্যালো গাছের পাতায় ! ভিজে যাওয়া গাছের পাতারাও সেদিন বুঝেছিল, ছন্নছাড়া জীবনের ইতিবৃত্ত খুঁজতে নেই । উল্টে দিয়েও লাভ নেই ছেঁড়া উপন্যাসের পাতা । সে তো পলকা বাতাসেই গোটা একটা অরণ্য হ’য়ে যেতে পারে…
সেদিন আমি স্বপ্নের খেয়ার কবির খেয়াঘাটে না পৌঁছালে জানতেই পারতাম না, শিমুলের বীজেই কেমন সম্পর্কের গুপ্তপথ— এক ঝড়েতেই তুচ্ছ করে, উড়িয়ে দিতে পারে সব…!
আলুথালু পেরিয়ে আসা মুহূর্ত… উসকো-খুসকো চুলে এগিয়ে আসছে কবি…! খুব আস্তেই কবির দিকে গড়িয়ে দিলাম একটা বাক্য । সন্তান হারিয়েছ কবি—? ফিরিয়ে দেওয়া কতটা শান্তির জেনেও, কবির সৃষ্টিকে সেদিন ছুঁয়ে থাকার লোভ সত্যিই সামলাতে পারিনি । পাঠকের কতটা পিপাসা ও আচ্ছন্নতা , তা বুঝেছি সেই ভোরেই ।
কবিও জানতে পারেনি সেদিন, অভিশপ্ত একটা ইতিহাস তার বাড়ির উঠোনেই । কিন্তু কবির উঠোন তো ফুলের— যেখানে সেদিন, উপাসনার মতো ভেসে গেছি বারবার। জীবন-যুদ্ধে জমাট বাঁধা রক্ত ধুয়ে যাবার পর সম্পর্কেরা, তুলসী তলায় বৈশাখের মালসা-ঝারি হয়। ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়াই তার একমাত্র কাজ ।
আসলে, পুতুল নাচের খেলা শেষে– আমাদের ফেলে আসা উপত্যকাতেই ফিরে যেতে হয়…অথবা নির্ভার ভেসে যাওয়া…
কয়েক বছর আগে– ভোর নয়, এক সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা পাখির ডাক শুনেও, কে যেন বলেছিল, সংসারের মঙ্গল কামনায়– উপাসনার প্রদীপের মতো কোনও এক শরীর ভেসেছিল এই গঙ্গার বুকে…!
মুষলধারে বৃষ্টি এলো…! কবিও ভিজে যাচ্ছে…আমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে তার সন্তান এই ভেবে, আবার চোখ রাখলাম কথোপকথনের সেই উড়ে আসা পাতায়…
— আপনি আমাকে ব্লক কেন করলেন ? আমি কথা দিচ্ছি, আপনার ব্যক্তিগত জীবনের বিষয়বস্তু নিয়ে কোনও প্রশ্ন করব না, কথা দিলাম
— আমি আপনাকে ভালোবাসি আর এটাও জানি ভালোবাসব…
— কাল রাতে সত্যিই খুব চোখ ব্যথা করছিল … তাই ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম…আপনার ওপরে রাগ করে নয়
— দেখুন, দূরে সরিয়ে দিলেই ভালোবাসার মৃত্যু হয় না । এইটুকু জেনে রাখবেন, আমি আপনাকে আনব্লক করার কথা বলতে পারিনা, শুধু এটুকুই বলব, আমি আপনাকে ভালোবাসি… আর এটাই সত্যি
অঝোর বৃষ্টি এলো..। আমি গাছের নীচে থেকে সরে খোলা আকাশের নীচে, ভিজলাম… শুধু ভিজলাম…
কবির সদ্য জন্মানো শিশুকে বুকে নিয়ে অসীম এক সুখে ভেসে গেলাম জন্ম থেকে জন্মান্তরে…
জানিনা– পরের পাতার, বাকি কথোপকথনের শব্দরা, কীভাবে শুয়ে আছে শান্ত নীলনদের বুকে…!
( চলবে…)