বটেশ্বর কান্ড —- তনুজা চক্রবর্তী
বটেশ্বর কান্ড
তনুজা চক্রবর্তী
(১)
আজও আমাকে বেশ ভাবায় বটেশ্বর মহাপাত্র । শুধু ভাবায় না রীতিমত গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে নামটা মনে পড়লেই । যতদূর মনে পড়ে ওই নামটাই শুনেছিলাম, আমার কাকি-শাশুড়ির মুখে। তখন ওনারা বাংলাদেশেই থাকতেন। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তাই জলের সঙ্গে জীবনের একটা হার্দিক সম্পর্ক জন্মের পর থেকেই গড়ে ওঠে ওদেশের প্রতিটা মানুষের সঙ্গে।
বেশ হৃষ্টপুষ্ট আর হোমরাচোমরা স্বভাবের মানুষ এই বটেশ্বর মহাপাত্র । দোষের মধ্যে একটু আধটু দেশী সুরায় গলা ভেজানোই ছিল তার রোজকার অভ্যাস । বাংলাদেশের একটা প্রত্যন্ত গ্রামের জেলে পাড়ার একজন বিশিষ্ট মানুষ ছিলেন তিনি । অর্থনৈতিক দিক থেকে রইস বললেও কম বলা হবে । মাছের আড়তদার, অর্থাৎ ব্যবসার সাথে সাথে প্রকৃত পরিশ্রমী মানুষদের শোষণ করে যার লোভের তেষ্টা মেটে।উত্তাল সমুদ্রকে বশ করে যারা রোজ ঘন্টার পর ঘন্টা সমুদ্রের বুকে জাল ফেলে অমানুষিক পরিশ্রম করে মাছেদের জালবন্দি করে , সেই জালে ধরা পড়া মাছে তাদেরই অধিকার সবচেয়ে বেশি বলে আমি মনে করি , বটেশ্বররা তা মনে করে না। কারণ বটেশ্বরদের মতো চরম অর্থ এবং ক্ষমতালোভী লোক, যাদের নৌকা আর জাল নিয়ে জেলেদের এই মাছ ধরতে যাওয়া তাদের জীবনের কোনো মূল্যই এদের কাছে থাকে না ।জেলেদের জীবন শুধুমাত্র কষ্টের নয় , অতি নির্মম অত্যাচারেও ভরা। সময় আর উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যাদের জীবিকা নির্বাহ করা তাদের রোজকার জীবনে যে পরিমাণ অসহনীয় কষ্ট এই বটেশ্বরদের মতো মানুষেরা ডেকে আনত, আনত কেন বলছি এখনো আনে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমি নিজেও যখন কোনো সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গেছি,তখন দেখেছি এই জেলে পরিবারের মানুষদের জীবনযাত্রার নগ্ন চিত্র। ফুটে উঠেছে তাদের কথায়,তাদের বেশভূষায়। পরিবারের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা দিনরাত পড়ে থাকে সমুদ্রের ধারে। তারা কেউ বোতলের সঙ্গে দড়ি বেঁধে অদ্ভুত উপায়ে মাছ ধরছে, কেউবা জলে বারবার ডুব দিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টায় সারাক্ষণ ব্যস্ত। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বড়ো মাপের শিল্পী। তারা নদীর চরে বালি দিয়ে কি অসাধারণ ঘরবাড়ি, মূর্তি তৈরি করে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। যে উত্তাল সমুদ্রকে ছোঁয়ার আগে এখনো হাজার বাধানিষেধের কথা আমাদের মনের মধ্যে জেগে ওঠে, সেই সমুদ্র যেন ওদের বন্ধু। সত্যিই কি তাই? শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতির কাছে নিজেদের জীবনগুলোকে সঁপে দেয় এরা, মৃত্যু কে প্রতিনিয়ত দুই হাতে ঠেলতে ঠেলতে পিছিয়ে দেওয়ার মত দুঃসাহসিক কাজ এদের মত মানুষের পক্ষেই বোধহয় করা সম্ভব। এরা জীবনের কাছে প্রতিটা মুহূর্তে পরাজিত হয়েও অপরাজেয় হয়ে থাকার চেষ্টাটুকু করে যায় । অসময়ে ঝরে যায় কত তরতাজা প্রাণ,তবুও উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার ইচ্ছে থেকে নিজেদের বিরত করতে পারে না।
গল্পটা আমার সেই বটেশ্বরবাবুকে নিয়েই, যে এই অত্যাচারিত জীবনের অত্যাচারের বড়োসড়ো একটা মুখ।
যার প্রতিদিনের কাজ অসহায় জেলেদের জীবনকে আরও অসহায়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া। জেলেদের পরিশ্রম শুধু নয় তাদের একটু ভালো থাকার জন্য, এই বটেশ্বরদের কাছে তাদের নখ থেকে চুল অবধি বিকিয়ে দিতে হত। তাদের পরিবারও রেহাই পেতনা । সমুদ্রের কাছে জীবন সঁপে দেওয়ার মতো বটেশ্বরদের কাছে জীবন বলিদান দেওয়া তাদের গা সওয়া হয়ে গেছিল— হয়তো এই বটেশ্বরদের জন্যেও শাস্তির একটা ব্যবস্থা সবসময়ই করা থাকে যা সাধারণের অগোচরে ঘটে যায় ! এটা তেমনই একটা বিষয় যা সেই গ্রামের একজন সাধারণ মানুষের মুখে শুনে আমার বেশ আনন্দ হয়েছিল, স্বস্তি পেয়েছিলাম এইভেবে যে বাবারও বাবা থাকে!