গণশা কেতোর দ্বন্দ্বকথা © কাজরী বসু

গণশা কেতোর দ্বন্দ্বকথা

© কাজরী বসু

———————————–

সবেমাত্র হেঁশেল সামলে ঘরে এসে বসতে যাবেন জগজ্জননী, গণশা দৌড়ে গিয়ে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরল। “আজ তােমাকে একটা গল্প বলতেই হবে।” কেতােটাও কম যায়না। সে-ও গল্প শুনবে বলে মায়ের গলা ধরে ঝুলে পড়ল। “আচ্ছা, আচ্ছা একটু সবুর কর। হাঁফও ছাড়তে দিবিনে তােরা।” খাটের উপর গুছিয়ে বসলেন জননী। কপালের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম যেন হীরের কুচি। ‘কি গল্প শুনবি বল।” কেতোর রেশমের মতাে চুলগুলাে ঘেঁটে দিলেন। গণশারও শুঁড় ধরে একটু নেড়ে দিলেন। যতই বায়না করুক, সন্তান বলে কথা। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে! কোথায় যেন পড়েছিলেন! মনে পড়ছে না।

“পৌরাণিক গল্প বলাে না মা। ঠাকুরদেবতার গল্প শুনলে মন ভালাে থাকে”। গণশা তার মতামত জানিয়ে দিল। কেতো বলল,” ওরে আমার বােকচন্দর! নিজের গল্প নিজেই শুনবি! হাও ফানি!”

“কেন, আমরা ছাড়া পুরাণে আর কোন ক্যারেকটার নেই নাকি!”

“থাকুক গে, ওসব পুরাণ-টুরান বাদ। পুরাণ মানে হল গিয়ে তাের পুরানাে। ওসব আর চলেনা, বুঝলি !”

“বটে! তা নতুনটা কি শুনি!”

“হ্যারি পটার।”

“সেটা আবার কি! খায় না মাথায় দেয়!”
“কি নয়, কে। যাক গে, ওসব তুই বুঝবি না। সব কিছু সবার জন্য নয়। তার চেয়ে আমরা চল্ অন্য কিছু শুনি। আচ্ছা মা, তুমি ফ্যানটমের গল্প জানাে না? সেই যে, গাছ বাড়িতে থাকে, জঙ্গলের মধ্যে। বাংলায় যার নাম অরণ্যদেব।”

“জঙ্গলের মধ্যে তাে বাচ্চা ছেলে মােগলি থাকে, চাড্ডি পহেনকে ফুল খিলা হ্যায়।” বলল গণশা, “রুড়িয়ার্ড কিপলিং এর ‘জাঙ্গল বুক’ এ আছে।”

” সে বলতে গেলে তাে টারজানও জঙ্গলের বাসিন্দা।
কেমন পশুপাখির ভাষা বােঝে!” বিদ্যে জাহির করতে কেতোও কম ওস্তাদ নয়!

“ব্যস্ ব্যস্ অনেক হয়েছে। হ্যাঁ রে কেতাে, গণশা, তােরা গােপাল ভাঁড়ের গল্প শুনবি?” জগজ্জননী বললেন, “ভদ্রলােক খুব রসিক ছিলেন কিন্তু।”

” কি সব ভাঁড়-টাড় বলছ মা, আমি তাে কিছুই বুঝছিনা।” গণশার অকপট স্বীকারােক্তি।

“না না, তা বুঝবে কেন! তুমি তাে শুধু বােঝাে দইয়ের ভাঁড়। গাণ্ডেপিণ্ডে খালি গেলাে আর নাদা পেট নিয়ে বসে থাকো। এরপর ওবেসিটির সমস্যায় পড়লে আমি কিন্তু নেই বলে দিলাম। তখন চোখ বুজে ‘বাপি বাড়ি যা’ বলে বল মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেব।” কেতো গণশার থুতনি ধারে নেড়ে দিল।

“দ্যাখাে মা,সবসময় আমায় হ্যাটা করে। মােটা কি কেউ ইচ্ছে করে হয় ?” কাঁদো কাঁদো গলায় বলল গণশা।

” তা একটু ডায়েট কন্ট্রোল করলেই তাে পারাে”, ভেংচি কেটে বলে উঠল কেতাে। “সে সবের তাে বালাই নেই। তার উপর আবার কুঁড়েমিতেও নাম্বার ওয়ান। পৃথিবী ঘুরে আসার একটা সুযােগ ছিল, সেটাও মিস্ করলি। মায়ের চারপাশে পাক খেয়ে নিলি, আর হয়ে গেল। কি করে শর্ট কার্ট করা যায় সবসময় তার চিন্তা।”

“আমাদের মা-ই হল আসল পৃথিবী।” ধরা গলায় বলল গনশা।

“তােমার এই থিওরি শুনে সকলে ধন্যি ধন্যি করলেন আর তুমিও গ্যাস খেয়ে গেলে। আরে নিজের ভালাে তাে পাগলেও বােঝে। এভাবে কি ফ্যাট ঝরানাে যায় !” মায়ের উপস্থিতির তােয়াক্কা না করেই বলে উঠল কেতাে।

“কেতাে, আমাকে রাগাবি না বলছি। আমি কুঁড়ে বলে মাকে চক্কর কেটেছি? মায়ের মর্ম তুই কি বুঝবি! কথা হচ্ছিল গল্পের, আর উনি পড়লেন আমাকে নিয়ে। একদম আমার পিছনে লাগবিনা বলে দিলাম।” কেতাে আবার একটা কি যেন বলতে যাচ্ছিল, জগজ্জননী চোখ গরম করে বললেন, “ফের তােরা ঝগড়া শুরু করলি ? দুটিতে মিলেমিশে থাকা তােদের কুষ্টিতে লেখেনি, না?” “কিন্তু মা , আমি তাে ওর ভালাের জন্যই… “থাক। তােমায় আর সাফাই গাইতে হবে না।” কেতোকে দাবড়ানি দিলেন জগজ্জননী।

“আর ঝগড়া নয়। চল্, তােদের কমিক পড়ে শােনাই। এই যে দ্যাখ, বাটুল দি গ্রেট আর হাঁদা-ভোদার বই’। বালিশের তলায় বইগুলি রাখা ছিল, বের করতেই ছিনিয়ে নিল দুজনে মিলে।

“কই দেখি দেখি! হি-হি-হি-হি, আচ্ছা মা, তুমি কি সবসময় তােমার এই নাদাপেট ভ্যাবলা ছেলেটাকে খুঁজে বেড়াও? ঠিক বের করেছাে তাে! যেমনি বাঁটুল, তেমনি ভোঁদা! দুটোই অবিকল আমাদের গণশা। শুধু শুঁড়টাই যা নেই।” কেতোর হাসি থামছিলই না।

“ও আচ্ছা, তাই নাকি! আর এই হাঁদা আর লম্বকর্ণ যে তাের কার্বন কপি সে বেলা কি! দেখতে তাের মতাে নয় ঠিকই, কিন্তু একেবারে রংবাজ টাইপ। হুবহু তােরই মতাে।” গণশা চোখ পাকিয়ে বলল।

‘মুখ সামলে কথা বলবি।” কেতাে তেড়ে এল, “হতভাগা মারাঠীগুলােই তােকে আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলেছে। নাহলে কে তােকে পুছত। গণপতি বাপ্পা মোরিয়া। আগলে বরষ তু জলদি আ। কেন রে, এত তাড়াহুড়াে কিসের! যখন আসার তখন এলে ক্ষতি কি! বাড়াবাড়ির একটা লিমিট আছে।”

“খামােখা মারাঠীদের দোষ দিচ্ছিস কেন রে হিংসুটে নাম্বার ওয়ান? তােকে নিয়ে বাঙালীদের আদিখ্যেতা কিছু কম! কার্ত্তিকের মতাে সুন্দর জামাই হয়েছে! মরে যাই। কেন! সৌন্দর্যের দিক দিয়ে দেখলে আমাদের কেষ্টঠাকুর কম কিসে!”

“কি বললি! গিভ মি আ ব্রেক! কেষ্টঠাকুর! ছ্যাঃ। ওটা কোন চেহারা হল! দেখলে মনে হয় নীলবর্ণ শিয়াল। ও ব্যাটা দেবে এই শর্মার সঙ্গে পাল্লা ! তুই ভাবলি কি করে!”

“কেতাে, তাের লঘু গুরু জ্ঞান নেই! এরকম বিচ্ছিরি ভাবে কথা বলতে কে শিখিয়েছে তােকে? তুই জানিসনা ঠাকুর-দেবতাকে নিয়ে ইয়ার্কি করতে নেই ?”

“আমার জ্ঞান থাক বা না থাক, তাের জ্ঞান আমি শুনছিনা ইডিয়েট। হাও ডেয়ার ইউ?” দাঁত কিড়মিড় করে উঠল কেতাে। জগজ্জননী ওদের হাত থেকে বই কেড়ে নিলেন। চলে গেলেন দুমদুমিয়ে। এদের বাচালতা একেবারে সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। সারাক্ষণ দুজনে মিলে একে অপরের পিণ্ডি চটকানাে। এই বয়সেই যদি এরকম চলতে থাকে তাহলে বড়াে হলে তাে খুনােখুনি বেধে যাবে। তখন সামাল দেবে কে! বাপটাও হয়েছে তেমনি। ছেলেদুটোর দিকে একটু তাকানাে নেই, বইপত্র নিয়ে বসানাে নেই, দিনভর গাঁজায় দম দিয়ে পড়ে আছে। তামাম দুনিয়ার ভার যার কাঁধে তাঁরই সংসার উচ্ছন্নে যেতে বসেছে। জগতের বিনাশ ঠেকায় কার সাধ্য!

“এই গণশা, দ্যাখতাে তাের বাপটা কোথায় ?” হুঙ্কার ছাড়লেন জননী। “সংসারটা কি শুধু আমার! তার কি কোন দায় নেই?”

“বাইরে রকে বসে মিস্টার নন্দীর সঙ্গে গাঁজা টানছে।” উঁকি মেরে বাইরের দিকে তাকিয়ে গণশা মাকে জানাল।

“হিহি কি বােকা রে তুই! মিস্টার নন্দী কি রে! নন্দী তাে ওঁর নাম। নন্দীকাকু বল।”

কেতাে বলে উঠল।

“দূর। নন্দী কখনাে নাম হয়! ওটা তাে পদবী।”
‘পদবীও অনেক সময় নাম হয় রে বুদ্ধু”!

” বললেই হল। কোনদিন বলবি সাগরও অনেক সময় পাহাড় হয় রে বুদ্ধু।”

“হ্যাঁ রে, সেটাও হয়। বহু বহু যুগ আগে অনেক সাগর পাহাড় হয়ে গেছে। এই যে আমাদের হিমালয়, এটাও তাে প্রাচীনকালে সমুদ্র…..।”

কথা শেষ হলনা। বাইরে বিকট শব্দ। দৌড়ে গেছে দু ভাই। হা ঈশ্বর! শঙ্করবাবু মাটিতে পড়ে গােঙাচ্ছেন। গাঁজা টেনে টেনে এই হাল। ইনি মহেশ্বরের পােস্টটা কি করে পেলেন কে জানে, ভাবল কেতাে। দুজনে মিলে তুলছে বড়িটা। যথেষ্ট ওজন, হিমশিম খাছে দুভাই।

“সাবধান কেতাে। পড়ে টড়ে না যায়। মাজা ভাঙলে আর রক্ষে নেই।” সর্বশক্তি দিয়ে বাবাকে ভালাে করে ধরে রাখল গণশা।

“শােন, বাবাকে বিছানায় শুইয়ে দিই, বুঝলি ! তারপরে তুই ওদিকটায় গিয়ে মা জননীকে একটু সামলা বস্। দরকার হলে মায়ের চারপাশে আরাে বার কয়েক পাক খেয়ে নে। মােট কথা মাকে আটকা। এদিকটায় এক্ষুণি যেন না আসে। বলা যায়না, রাগের মাথায় হয়ত ঘরের বাইরে খেদিয়ে দিল। সেটা হলে খুব খারাপ হবে রে।”।

“ঠিক বলেছিস ভাই। শত হলেও আমাদের তাে বাবা। তাই না!”

“সে আর বলতে! সব কিছু কিনতে পাওয়া যায় রে, মা বাপ কখনাে কিনতে পারেনা কেউ। ভিখিরি হলেও ফেলে তাে আর দিতে পারবনা।”

“ছি! তাই কি কেউ পারে। বাপ মা কি ফেলে দেবার জিনিস!”

দূর থেকে দেখছিলেন জগজ্জননী। শুনছিলেনও। চোখদুটো ভিজে আসছে। মনটাও ভারি ভালাে হয়ে যাচ্ছে। যাক, চারপাশটা এখনাে বসবাসের অযােগ্য হয়ে যায়নি।
“এটুকুকে বাঁচিয়ে বৰ্তিয়ে রেখাে ঠাকুর।” কপালে দুহাত জড়াে করে কে জানে কার উদ্দেশে পেন্নাম ঠুকলেন জগজ্জননী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *