প্যানডেমিক আর দুর্গাপুজো ——- তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী

প্যানডেমিক আর দুর্গাপুজো
তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী

—————————————

ছোট থেকেই একটা প্রবাদ বা প্রবচন শুনে বড় হয়েছি…. ‘বিষে বিষে বিষক্ষয়’।আমার মতো সবাই শুনেছেন নিশ্চয়ই। দুহাজার কুড়ি সাল অর্থাৎ বিশ-বিশ, বিষের বোঝা কাঁধে নিয়ে এলো সারা বিশ্বের জন সাধারণের কাছে। এক অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো এক অনুজীব। খালি চোখে যাকে দেখাই যায় না, আশে পাশে তার উপস্থিতি বোঝাও যায় না সেই কাঁপুনি ধরাচ্ছে হাড়ে তবে মানুষের। কিছু বিশেষ লক্ষণ নিয়ে কেবল কেউ খুব অসুস্থ হলে বা মারা গেলে আমরা তার প্রবল শক্তি টের পাচ্ছি। বছরের শুরুতে হোয়াটস্ অ্যাপে ঘোরা হাসি ঠাট্টার মেসেজ গুলো উধাও। তখন সবাই বলতো ‘বাঙালি তো সবেতেই এটা করোনা ওটা করোনা করতে থাকে। তো এই করোনা নামক ভাইরাস বাঙালির সাথে পেরে উঠবে না।

সেসব কথা মিথ্যে প্রমাণ করে করোনা নামক অনুজীব সদলবলে আছড়ে পড়ে সারা পৃথিবী এবং ভারতে তো বটেই, অন্যান্যদের সাথে বহু বাঙালিরও প্রাণ কেড়েছে।

এই রোগের গুরুত্ব বুঝে সরকার সারা দেশে লকডাউন প্রক্রিয়া শুরু করেছে সেও আট মাস আগে। জনজীবন স্তব্ধ, জীবিকাহীন নিরন্ন বহু মানুষ তাও বন্ধ সব রাজ্য এবং দেশ। গরীব না খেতে পাওয়া কাজ হারানো পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। মানবিক মুখগুলো চকচকে উজ্জ্বল।

কিন্তু খারাপ তো ভালোর সাথে সাথেই লেপটে থাকে। প্রাণ বাঁচানোর সাথে তাই অকাল মৃত্যুও চলতে লাগলো।

সরকারের তরফে কোয়ারেনটাইন, পুলিশ পাঠিয়ে অসুস্থ কে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সবই চলতে লাগলো। আর বাড়তে লাগলো চিকিৎসক, চিকিৎসা কর্মী, পুলিশ এবং সাধারনের অসুস্থ হবার পরিসংখ্যা ও মৃত্যু। ছুঁৎ মার্গ দোষে দুষ্ট এই রোগে মৃত্যু হলে মৃতের সৎকার সরকারি তরফে আত্মীয় স্বজন ছাড়া ই। নিকট আত্মীয়ের শেষ যাত্রায় উপস্থিত হওয়া তো দূর, মুখটাও দেখতে পাবে না কেউ।

চলতে থাকা এই ভয়ানক পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদলের এবং সরকারের দেওয়া বিধি নিষেধ মেনেই ধীরে ধীরে শুরু হল আনলক প্রক্রিয়া। এক, দুই থেকে এখন সাত।

এই আনলক সাতেই দুর্গাপুজো। স্বজন হারানো মানুষের কথা না ভেবে, চাকরি হারানো মানুষের কথা না ভেবে চলছে আনন্দযজ্ঞে সামিল হবার আহ্বান।

যে রোগ বারবার তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বদলে উপসর্গ হীন মানুষের মধ্যে ঢুকে আরও বহু মানুষ কে মারার জন্য মরিয়া, তাকে সুযোগ না দিয়ে সবাই যদি এই বছর ঘরেই কাটাই আপনজনের সাথে… কয়েক হাজার চিকিৎসকের মৃত্যু কে সম্মান জানিয়ে, কয়েক লক্ষ স্বজনহারার দুঃখে দুখি হয়ে….

একটা বছর, একটা বছর আমরা বাঙালিরা কি পারি না শোকাবহে পুজো মানাতে?? মা দুর্গা তো বলেন নি, তাঁর আগমনে আনন্দ করে মৃত্যু মিছিল বাড়িয়ে দিতে… তবে কেন সবাই উপযুক্ত ব্যবস্থা ছাড়াই বাজারে, দোকানে, শপিং মলে গায়ে গায়ে ঘুরছে…. দূরত্ব বিধি না মেনে??? কি হবে এরপর যদি অসুখের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ে মৃত্যু মিছিল কে দীর্ঘায়ত করে?? ঘরে ঘরে পড়ে থাকবে লাশ। সৎকারও করার কেউ থাকবে না।

জানি না মায়ের কি ইচ্ছা!! তবে অবোধ মানুষ সংযত হোক অসুখ কে পরাস্ত করতে। টিভি আর কাগজের খবরে যেন শিউরে উঠতে না হয়… সবাই মিলে যেন চিন্ময়ী মায়ের আবাহন করতে পারি বছরের পর বছর, শিউলি পদ্মে শরৎ রোদে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *