A JOURNEY FROM POSITIVE TO NEGATIVE … ।। বিপাশা চট্টোপাধ্যায় ।।
A JOURNEY FROM POSITIVE TO NEGATIVE …
।। বিপাশা চট্টোপাধ্যায় ।।
সেই মার্চ মাস থেকে প্রায় হঠাৎ করেই বলতে গেলে একটা বেমক্কা হুজুগে ঝামেলা এসে আমাদের পুরো গয়ংগচ্ছ জীবনটা একেবারে লন্ডভন্ড, নয়ছয় করে দিয়েছে!! প্রায় মাস ছয়েক ধরেই আমাদের দিনগুলো কাটছে একটা চরম আতঙ্ক ,অনিশ্চয়তা আর অবিশ্বাসের গন্ধের মধ্যে । এই সুযোগে বেশ কিছু নতুন নতুন শব্দ দিব্যি জায়গা করে নিয়েছে আমাদের রোজনামচায় ! যাই হোক, একটু একটু করে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম এই ভয় ভয় পরিবেশটায়।অদৃশ্য শত্রুকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারার মতো যথেষ্ট সতর্কতা নিয়ে চলেছি ভেবে বেশ আত্মতুষ্টিতে ভুগছিলাম। কিন্তু সেই নজরুলের লিচুচোরের মতো ব্যাপারটা হয়ে গেলো !! পড়বি পড় আমার ঘাড়ে!! সে ছিলো চোখের আড়ে!!
ব্যাপারটা একটু খুলেই বলি। এই সময়টা, মানে জুলাই, আগস্ট মাসটা এমনিতেই গরমে, ঘামে একেবারে ল্যাজেগোবরে অবস্থা হয়ে থাকে। বিশেষ করে যাদের সারাদিন এসি তে অফিস করতে হয়, সেই সব ঘাম দরদরে মানুষদের জন্য এই সময়টা বড়ো বিপজ্জনক। আমার ঘরে যিনি রয়েছেন, তাঁর এই সময় উভয় সংকট, ডাক্তার বলছেন বাইক নয় হাঁটুন, হাঁটতে গেলেই ঘাম, আর সেই ঘাম বসে গেলেই সর্দি-কাশি-হাঁচি ইত্যাদি ইত্যাদি, এখন তো আবার একা রামে রক্ষে নেই লক্ষ্মণ দোসর, বাইরে বেরোলেই স্নান। যার ফলশ্রুতি হিসেবে জুলাই মাসের 24 তারিখ থেকে তিনি পড়লেন জ্বরে। এই কমছে, এই কমছে করে আশায় আশায় তিন দিন কাটলো ক্যালপলের ভরসায়। কিন্তু ভবি ভোলার নয় দেখে তখন শরণাপন্ন হতে হল ডাক্তারের। এমনিতেই বর্ধমান শহরে এখন ভালো ভরসা করার মতো ডাক্তারদের সহজে পাওয়া যাচ্ছে না, আর এখন ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়াটাও একটা চিন্তার বিষয়, পাছে খাল কেটে কুমীর আনা হয়ে যায়! অগত্যা দেওরের শরণাপন্ন হলাম । ওষুধ কোম্পানিতে দীর্ঘদিন চাকরীর সুবাদে বিভিন্ন ডাক্তারদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ থাকায় ফোনে ফোনেই ওষুধের প্রেসক্রিপশান এলো। জ্বর কমছে না দেখে যদিও সে দাদাকে সোয়াব টেস্টের কথা বলেছিল, কিন্তু দাদার ধারণা তার ওসব হতেই পারে না! তাই টেস্টের কথা মোটেই আমল দিলেন না। এদিকে antibiotic চলতে লাগলো, অথচ জ্বরবাবাজীবনের কোনো হেলদোল নেই, তিনি যথাপূর্বং তথাপরং!! উপরন্তু antibiotic এর প্রথম কোর্স কমপ্লিট হতে না হতেই জুটিয়ে আনলেন আরেক সঙ্গী খুকখুকে কাশিকে। দুজনে মিলে বেশ করে জাঁকিয়ে বসে শরীরের অক্সিজেন লেভেল আর প্রেসারের পারাটাকে চরচর করে টেনে নামাতে লাগলেন!! আর উল্টোদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল দুর্বলতা!! দিন রাতে তিনখানা ওষুধ খেয়ে যার রক্তচাপ 140/95 এর নীচে নামতে চায় না, হঠাৎ করেই দ্বিতীয় দফা antibiotic শুরু হতেই রাত্রি বেলা প্রচন্ড ঘাম, প্রচন্ড অস্থিরতা শুরু হওয়ায় তড়িঘড়ি প্রেসার মেপে দেখলাম সেটা নেমে গেছে 110/70 ! ভাবলাম বুঝি নতুন antibiotic সহ্য হচ্ছেনা ঐ জন্য এই কান্ড!! পরের দিনও একই ব্যাপার, এমনি জল, নুন-চিনি জল যতোই খাওয়াই প্রেসার আর বাড়ে না, এদিকে রোগী দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ছে!! অক্সিমিটারে সারাদিন দফায় দফায় রিডিং নেওয়া হচ্ছে, ভয়ে ভয়ে দেখছি 98,97, 96 …রক্ত পরীক্ষা হল, আশায় আশায় রইলাম, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, ডেঙ্গু কোনো একটা নিশ্চয়ই হবে !! মুখে রুচি না থাকলেও স্বাদ বুঝতে কিম্বা গন্ধ চিনতে কোনো অসুবিধা নেই, গলায় কোনো ব্যথা নেই, এতো সতর্কতা নিয়ে থাকা, নিরিবিলি পথে হেঁটে অফিস যাওয়া, সর্বদা মাস্ক এঁটে বাইরে বেরোনো, অফিসে চার পাঁচ বার করে সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া, এরপরেও ওসব করোনা টরোনা কিছু হতে পারে না, এগুলোর মধ্যেই কিছু একটা হবে!! কিন্তু নরম্যাল রিপোর্টও যে এমন হতাশ করে এই প্রথম দেখলাম!!
দ্বিতীয় ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া হল, তৎক্ষণাৎ চেষ্ট এক্সরে করিয়ে তিনি রিপোর্ট দেখা মাত্র বললেন নিউমোনিয়া।antibiotic বদল হয়ে আরও চড়া ডোজের তিন ধরণের antibiotic লিখে দিলেন, বললেন এর জন্যই প্রেসার কমছে। কিন্তু প্রেসারের ওষুধ বন্ধ করা চলবে না। ডাক্তার তো বলে দিলেন 90/60 এ না নামা পর্যন্ত চিন্তা নেই , এই অব্দি নামলে হসপিটালাইজড করতে হবে। কিন্তু সামনে থেকে রুগীকে ঐভাবে ঝিমিয়ে পড়তে দেখে কী করে প্রেসারের ওষুধ দিই !! 100/65 থেকে 90/60 এ নামতে কতক্ষণ সময় লাগবে!! রাত পেরোবে তো!! যা থাকে কপালে, ঝুঁকি নিয়েই বন্ধ রাখলাম প্রেসারের ওষুধ। আগের পরিচিত ডাক্তার বয়সে তরুণ হলেও তাঁর ডাক্তারী চোখ অনেক খানি পরিণত এবং সৌভাগ্যবশতঃ তাঁর ক্ষেত্রে ইগোজনিত প্রতিবন্ধকতা অনেকটাই কম বলে এবং যেহেতু তিনি বাইরে থাকার কারণে রোগীকে সরাসরি দেখতে পান নি, তাঁকে আমরা যখন দ্বিতীয় ডাক্তারের করানো এক্সরে রিপোর্ট পাঠালাম, উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন সিটি স্ক্যান তো অবশ্যই করা উচিত, কেন ইনি বললেন না বুঝতে পারছি না!
কী অদ্ভুত এক পরিস্থিতি!! বর্ধমানের খোসবাগান হল ডাক্তারপাড়া, সারাদিন সেখানে অজস্র রোগীর ভীড়, সেই ভীড়ে, স্ক্যান সেন্টারের বেডে নিয়ে গিয়ে শোয়াতে হবে এই দুর্বল মানুষকে !! পারবো তো!! অথচ উপায়ও তো নেই!! কিন্তু এখন তো জ্বর মানেই অচ্ছুত !! পাড়ার রিক্সাওয়ালার রিক্সায় চাপতেও কেমন যেন চুরি করছি করছি ফিলিংস!! যাই হোক তবু এঁনার ভাই ভাগ্যটি খুবই ভালো, প্যাথোলজি সেন্টারে টাকা জমা করে রক্ত নেবার লোক ধরে আনা থেকে শুরু করে, স্ক্যান সেন্টারে যোগাযোগ করা, রিপোর্ট আনা সব কিছু নির্দ্বিধায় করে না দিলে পরিস্থিতি আমার জন্য বোধহয় আরও কঠিন হয়ে উঠতো। এদিকে জ্বর যখন দু তিন দিন পরেও কমলো না দেখেছি , সেদিন থেকেই দুই মেয়েকে ওপরে আলাদা করে দিয়েছি, ওরা নিজেরা ওপরেই নিজেদের মতো রান্না খাওয়া করে নিচ্ছিল। আমার নিজের ভিতরে ভিতরে যাই হোক, আমি একটু একটু করে দুর্বল রুগী মানুষটিকে মানসিক ভাবে তৈরি করতে শুরু করেছিলাম, কোনো চিন্তা নেই, মনে জোর রাখো, ওটাই আসল,নিউমোনিয়া তো নতুন নয়, তবে আজকাল তো চারিদিকেই ভাইরাসের ছড়াছড়ি, হতেই পারে করোনার attack , কিন্তু আমরা তো জলে পড়ে নেই, ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যদিও বুঝতে পারছিলাম, আমার মুখে ফেনা উঠে গেলেও, আসল জায়গায় হাইপারটেনশনের দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করে কথা গুলো কতোটা ভিতরে ঢুকতে পারছে খুব সন্দেহ!!
রিপোর্ট এলো। সন্দেহকে জোরদার করে দেখা গেল ground glass haze in both lobe of lungs ( lower lobe>upper lobe), যেটা নাকি একান্ত ভাবে ঐ করোনার দিকেই ইঙ্গিত করে!! কাজেই পর দিনই বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে সোয়াব টেস্টের জন্য হাজির হলাম। মালদা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ননদের ছেলে তার এখানকার বন্ধুদের বলে ফর্ম ফিলাপ সংক্রান্ত সব কাজ করিয়ে রেখেছিল, তারপরেও প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষার শেষে যখন লালারসের sample দেওয়া শেষ হল, জানলাম রিপোর্ট পেতে চারপাঁচ দিন !! ততদিন কী করে রাখা হবে এই রুগীকে!! যে কোন মুহূর্তে নার্সিংহোমে দেবার প্রয়োজন হতে পারে, অথচ জ্বর থাকলে কোনো নার্সিংহোম নেবে না !!রিপোর্টে যদি পজিটিভ আসে, সরকারী হাসপাতালের ঐ সীমিত চিকিৎসায় অবস্থার আরও অবনতি বৈ উন্নতি হবে না !! তাহলে কী করণীয়? কোথায়? কোথায় নিয়ে যাবো এই অসুস্থ মানুষটিকে? কীভাবে নিয়ে যাবো? এই অবস্থায় আমি তো কাউকে ডাকতে পারবো না, যে যতো প্রিয়জনই হোক, সবাইকার নিজস্ব পরিবার আছে, কারুর গোটা পরিবারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেবার মতো দাবী আমি কখনোই করতে পারি না। কলকাতায় বেসরকারী নার্সিংহোমে ভর্তি বা চিকিৎসার পরিস্থিতি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া বা খবরে যা দেখতে পাই তাতে এই দূর মফঃস্বল থেকে গিয়ে একা মানুষ কীভাবে কী করবো ভেবে যেন অথৈ জলে পড়লাম মনে হল!!
তবে আমার জীবনে বারে বারে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, মাথা ঠাণ্ডা রাখলে, কী হবে কী হবে ভেবে হাঁফিয়ে না পড়লে , সমাধান ঠিক কোন না কোনো ভাবে হাতের মুঠোয় চলে আসে।
6 th আগস্ট টেস্ট করিয়ে আসার পর ঐ দিনটায় আমার বাবা, আমার নন্দাই এবং আমার দেওর এঁরা তিনজন যে কী হন্যে হয়ে সারাদিন কোলকাতার সব বেসরকারী নার্সিংহোমে যোগাযোগের খোঁজখবর নিয়েছিলেন সেটা আমি পরে বুঝতে পারলাম, যখন রাত নটার সময় দেওর ফোন করে বললো, বৌদি, কাল নটার মধ্যে তৈরী হয়ে যাবে, দাদাকে নিয়ে যেতে হবে, ঢাকুরিয়া অ্যামরি কিম্বা বেলভিউ দুটোর কোন একটাতে। সকাল দশটা পর্যন্ত টানাপোড়েন চলল, একবার ফোন আসছে অ্যামরি যেতে হবে, একবার ভাবা হচ্ছে বেলভিউ। আমি ফোন attend করবো, নাকি রোগীকে দেখবো, নাকি রোগীর খাবার তৈরী করে তাকে খাইয়ে রেডি করবো!! নাকি রোগীর সম্ভাব্য জিনিসপত্র গোছাবো, নাকি নিজে রেডি হবো!! কোনদিকে যাই!! তার মধ্যে সব শুনে রোগী স্বয়ং বেঁকে বসেছেন , যদি না insurance এর ক্যাশলেস পেমেন্ট সম্ভব হয়, আমি কোত্থাও যাবো না, তাতে আমাকে যদি স্বাস্থ্যদপ্তর সনকাতে নিয়ে যায় তাই যাবো!!
যাই হোক, শেষ মেশ এক পরিচিত সোর্সের সুবাদে বেলভিউতে আশ্বাস পাওয়া গেল, রোগীকে টেস্ট করে নেওয়া হবে, যদি পজিটিভ হয়ও তবে শিফ্ট করতে বলা হবে না , কোভিড ওয়ার্ডে একটা বেড পাওয়া যাবে। এবং ক্যাশলেস পেমেন্টের ব্যবস্থা আছে। দশটার মধ্যে ambulance এসে গেলো, আমাদের দুজনকে নিয়ে ppe পরা চালক হূ হূ করে গাড়ি ছোটালো। পথের বিপদ তেমন কিছু হয় নি , শুধু দেওর বলেছিল পথে নাকি পুলিশ গাড়ি আটকাতে পারে, তখন যেন না বলি যে লাংস ইনফেকশানের পেশেন্ট নিয়ে যাচ্ছি!! যদিও পেল্লাই সাইজের সিটি স্ক্যান রিপোর্ট সাথে নিয়ে কীভাবে কী মিছে কথা বলবো, সেটা সেই মুহূর্তে দুশ্চিন্তা করে মাথা খারাপ করতে চাই নি। আর কোলকাতায় ঢোকার পর কখন একটা যেন ড্রাইভার বলে বসলেন, আপনারা অ্যামরি যাচ্ছেন তো? সেই শুনে রোগীর আরেক প্রস্থ ধড়ফড়ানি, কারণ আমরা কোলকাতার কিছুই চিনি না!! যাই হোক তাকে ছেলে ভোলানো মতো শান্ত করে ড্রাইভারকে জানালাম, আমরা বেলভিউ যাবো। এরপর আর সমস্যা হয় নি, অভিজ্ঞ ড্রাইভার দুপুর আড়াইটের মধ্যে আমাদের বেলভিউর ইমার্জেন্সির সামনে পৌঁছে দিলেন।
ইমার্জেন্সিতে রোগীর প্রাথমিক পরীক্ষা এবং পেপার ওয়ার্কের পর দেখি নার্সিংহোমের একজন কর্মী এসে রোগীকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে আমাকে বললেন, “এঁনাকে ফ্লোরে নিয়ে যাচ্ছি, আপনি আসুন।” আমি তো সঙ্গে সঙ্গে তার পিছু পিছু চললাম। মেন বিল্ডিং এর বাইরে দিয়ে অনেকটা ঘুরে যখন লিফটে ওঠার মুখে, তখন হুইল চেয়ার বাহক আমাকে জিজ্ঞাসা করেন কিনা অ্যাডমিশনের কাগজ এনেছেন!! কাগজ? কাগজ তো কিছু আনলাম না!! যান যান, আপনি কাগজ নিয়ে অ্যাডমিশন ডেস্কে যান, আমি এঁনাকে ফ্লোরে নিয়ে যাচ্ছি। আবার ছুটতে ছুটতে এলাম ইমার্জেন্সি কাউন্টারে। আমাকে দেখেই ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলে উঠলেন, ফর্মটা না নিয়ে আপনি চলে গেলেন!! যাই হোক ফর্ম নিয়ে এবার ভিতরে ভিতরেই লিফটে উঠলাম ফার্স্ট ফ্লোরে অ্যাডমিশন কাউন্টার। ঝকঝকে তকতকে করিডোর ডানদিকে বাঁদিকে ছড়িয়ে গেছে পিঁপড়ের সুড়ঙ্গের মতো। জিজ্ঞাসাবাদ করে কাউন্টারে তো পৌঁছালাম, সেখানে আমাকে বেশ কিছু কাগজপত্র দেওয়া হল ফিলআপ করার জন্য, কিন্তু আমার পেশেন্টের তো দেখা নেই !! এদিক ওদিক তন্ন তন্ন করে খুঁজেও না দেখতে পেয়ে, ফোন করতে লাগলাম। তিন চার বার চেষ্টা করেও না ধরতে পেরে যখন প্রায় অস্থির হয়ে উঠেছি, তখন তার ফোন বাজল!! “দেখো, আমাকে তো কোথায় একটা ঢুকিয়ে দিলো, বলছে আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না!! ” বলে কী!! শুনে তো আমার মাথায় বাজ!! একে ঐ হাইপারটেনশনের রোগী, কোনো মানসিক প্রস্তুতি নেই, হঠাৎ করে কোথায় ঢুকিয়ে দিলো!! শুধু কী তাই, তার কাছেই ব্যাগের মধ্যে রয়ে গেছে জমা দেবার জন্য আনা insurance এর সব কাগজ পত্র, বেশ খানিকটা টাকা !! ওগুলোই বা কী করে নেব!!
আমি তো গিয়ে কাউন্টারে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, দেখুন, আমার পেশেন্টকে কোথাও একটা ঢুকিয়ে দিয়েছে, আর নাকি দেখা করতে দেবে না!! কিন্তু আমাকে তো দেখা করতেই হবে!! আমার insurance এর সব কাগজ যে তার কাছে!! অ্যাডমিশন কাউন্টারে বসা মিষ্টভাষী তরুণী ভরসা দিলেন , ঠিক আছে যান কোভিড ওয়ার্ডে সিস্টারদের বলুন, ওঁনারা এনে দেবেন। থার্ড ফ্লোরে যখন লিফট থেকে নামছি, হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন একজন, গ্লাভস পরুন, গ্লাভস পরুন!! আর নিকুচি করছে গ্লাভস!!সাগরে পেতেছি শয্যা শিশিরে কী বা ভয়!! থমথমে করিডোরে ppe পরা সিস্টার নার্স কিম্বা আপাদমস্তক সুরক্ষা মোড়কে ঢাকা কর্মীদের মাঝে odd man out হয়ে প্রবেশ করলাম। যাই হোক কাউন্টারের সিস্টাররা যখন শুনলেন আমিই পেশেন্টের সঙ্গে এসেছি, তখন তারা আমাকে বললেন, ঠিক আছে যান দেখা করে আসুন। ধড়ে প্রাণ এলো যেন। আইসোলেটেড কেবিনে পেশেন্টকে ততক্ষণে নার্সিংহোমের পোশাক পরানো হয়ে গেছে। কাগজপত্র, টাকাকড়ি সব নিলাম, রোগীকে খানিকক্ষণ ভরসা দিলাম, সাহস দিলাম। রোগী তখনও বলছে, যদি ক্যাশলেস ট্রিটমেন্ট না হয়, আমি কিন্তু এখান থেকেই নেমে যাবো!!কোনরকমে শান্ত করে নেমে এসে অ্যাডমিশনের কাজ গুলো সম্পূর্ণ করলাম। আর চোরের তো নেই বাটপাড়ের ভয়, তাই আসার আগে আরেক বার গটগটিয়ে কোভিড ওয়ার্ডের আইসোলেটেড কেবিনে গিয়ে নার্ভাস মানুষটিকে আরেকবার একটু সাহস দিয়ে এলাম। ইতিমধ্যে আমার জন্য বর্ধমান থেকে পাঠানো নন্দাইএর গাড়ি এসে তার উপস্থিতি জানান দিয়েছে । একটা প্রবল অনিশ্চয়তাকে পিছনে রেখে সন্ধের কোলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।
ফোনে জানলাম বিকেল থেকেই শুরু হয়ে গেছে একের পর এক টেস্ট এবং বিভিন্ন রকম protective treatment, শুরু হয়ে গেছে অক্সিজেন দেওয়া, যদিও ভেন্টিলেশন নয়। রাত এগারোটার সময় ফের সিটি স্ক্যান, রাত বারোটা পনেরোর সময় ppe পরা সিস্টার খাইয়ে গেছে ষোলোখানা ট্যাবলেট!! শুরু হয়েছে intravenous antibiotic injection এবং নানা আনুষঙ্গিক ওষুধ, এদিকে পরের দিন অর্থাৎ আটই আগস্ট বর্ধমান মিউনিসিপ্যালিটির স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে ফোন করে আমাকে জানানো হল, আমি কোভিড পজিটিভ! যদিও ভীষণ রকমই প্রত্যাশিত ছিলো, তবু আশ্চর্য এটাই যে আবারও প্রমাণ হল, যে খায় চিনি যোগায় চিন্তামণি!! তাই একজন গুরুতর ভাবে আক্রান্ত, তখনও পর্যন্ত সাসপেক্টেড কোভিড পজিটিভ পেশেন্টের কেয়ার গিভার হিসেবে কাজ করতে পারার জন্যই বোধহয় আমি পজিটিভ হয়েও রয়ে গেলাম পুরোপুরি asymptomatic!! আমাকে একদিন, একমুহূর্তের কোন দুর্বলতার জন্যও একটা প্যারাসিটামল পর্যন্ত খেতে হয় নি!! যাই হোক, পরদিন বর্ধমান মিউনিসিপ্যালিটির নিয়ম মোতাবেক থানা থেকে দারোগাবাবু এসে আমার বাড়ির গেটে বাঁশের ব্যারিকেডের ব্যবস্থা করে গেলেন। ওরাই হোম ডেলিভারি সংস্থার নম্বর দিয়ে গেলেন। দুই মেয়েকে পুলিশের গাড়িতেই দুদিন পর নিয়ে গিয়ে টেস্ট করিয়ে আনা হল ।ওরা নেগেটিভই হল।
ইতিমধ্যে দুদিন পর বেলভিউ থেকে রিপোর্ট এলো সেখানেও করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ হয়ে গেছে !! তিন দিনের দিন নন কোভিড ওয়ার্ডে ট্রান্সফার করা হল। যদিও গলার স্বর তখনও ভীষণই ক্ষীণ , দুর্বলতা তখনও খুবই, তবুও তিনদিন পর থেকেই কমতে থাকল জ্বর আর কাশি, চার পাঁচ দিনের মধ্যেই একটু একটু করে বাড়তে থাকল নেমে যাওয়া প্রেসার আর নষ্ট হয়ে যাওয়া খিদে। সেই সঙ্গে ফিরতে লাগল বাড়ির জন্য দুশ্চিন্তা। আমাকে আবার শুরু করতে হল কাউন্সেলিং এর ক্লাস, প্রায়শঃই যার শেষ হত এই বাক্যে, এবার তুমি রাখো তো!! অগ্রিম ভাবার অভ্যেসটা এবার বন্ধ করো!! আমরা সবাই ঠিক আছি!!!
ঠিক সাতদিনের মাথায় শেষ হল antibiotic এর কোর্স, এর মধ্যে রাতে এবং দিনে যে দুজন ডাক্তারবাবু দেখছিলেন তাঁরা অন্ততঃ চার পাঁচ বার বিভিন্ন সময়ে (এমনকী ওঁনাদের রুগী দেখা শেষ করে রাত সাড়ে এগারোটাতেও) ফোন করে পেশেন্টের কন্ডিশন জানিয়েছেন। সাত দিন পরে আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধে আবারও একবার লালারস পরীক্ষা করিয়ে দেওয়া হল, তাতে দ্বিতীয় বারও নেগেটিভ হবার পর দশ দিনের মাথায় ডিসচার্জ দেওয়া হল। চিকিৎসার খরচ কেমন হবে সেসব নিয়ে এ কদিন ভাবার অবকাশ ছিলো না, তখন মানুষটার সুস্থতাটাই ছিলো প্রধান ভাবনা। যাই হোক ডিসচার্জের দিন দেখা গেল যে টাকা জমা না দিলে কোলকাতার কোনো কোনো বেসরকারী নার্সিংহোম এই রকম কোনো পেশেন্টকে ভর্তি নিতে চায় না, সেই খরচেই দশদিনের আরামদায়ক থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা সব করে রুগীকে সুস্থ করে তুলল বেলভিউ!!
এদিকে আমি তো তখনও পজিটিভ, রোগীকে আনবে কে!! নন্দাই আবারও উদ্ধার করলেন। কোলকাতা যাবার জন্য কোনো গাড়িকেই যেখানে রাজী করানো যায় না, সেখানে মা গঙ্গাই জানেন কী ভাবে যেন আবারও একটা গাড়ি বুক করে দিলেন। দেওর একটু ভয়ে ভয়ে ছিলো, ড্রাইভারকে পেশেন্ট পার্টির তরফ থেকে একটা অথারাইজেশন লেটার দেবার জন্য বাড়িতে আসতে বলেছিলাম , তো ও বললো বৌদি, তোমার গেটে ব্যারিকেড দেখে মনে হয় ও আর যাবে না। কিন্তু নির্লিপ্ত ড্রাইভার যখন আমার গেটের ব্যারিকেড টপকে আমার কাছ থেকে অথারাইজেশন লেটার নিয়ে হাসিমুখে বলে গেল, আমি পৌঁছে আপনাকে ফোন করে দেবো, তখন মনে হচ্ছিল , ঈশ্বরের মুখ কি এর থেকে খুব কিছু আলাদা হয়!! এদিকে আমি নিজে পজিটিভ হলেও আমার খুব চিন্তা ছিলো, কোলকাতার নার্সিংহোম ফেরত রুগ্ন মানুষটাকে বাড়িতে ঢোকাতে কোনো সমস্যায় পড়বো না তো!! যিনি ব্যারিকেড করিয়ে গেছিলেন, সেই দারোগাবাবুকেই ভয়ে ভয়ে ফোন করলাম, উনি সোজা বলে দিলেন বাঁশের ফাঁক গলে ঢুকিয়ে নেবেন !! সবিনয়ে জানালাম, ফাঁক গলে ঢোকার মতো তো নয়!! তখন নির্দেশ এল মাঝের বাঁশটা খুলে নেবেন। নিশ্চিন্ত হলাম। সেই সঙ্গে জানিয়ে দিলাম,সামনে টাঙানো সতর্কতা বাণী সমেত প্লাস্টিকের ফেস্টুন কিন্তু চুরি হয়ে গেছে, চুরির জন্য কিন্তু আমরা দায়ী নই। নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ফিরবার সময় এইমতো প্রবেশাধিকারের সংবাদ শুনে আমার পেশেন্ট সিদ্ধান্তে এলেন, বাঁশটা তাহলে খুলবে যখন ঘরে ঢুকিয়ে নিও, যতোই হোক পুলিশের বাঁশ, যদি এটাও চুরি হয়ে যায় আর চুরি হয়ে যাবার পর যদি হিসেব চায়, মুশকিলে পড়ে যাবে!!
যাই হোক দশ দিন পর বাঁশের ফাঁক গলে দুর্বল শরীরে তিনি বাড়ি ঢুকলেন। দোতলায় বাকি দুই নেগেটিভ সদস্যের পাশে, তৃতীয় একটি ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম।যেরকমটি বলা হয়, অতো পুঙ্খানুপুঙ্খ নিয়ম মানা বাস্তবে সম্ভব হয়ে ওঠে না, আমি অন্ততঃ পারি নি। মোটামুটি নিয়ম মেনে রোগীর পথ্যের ব্যবস্থা আমিই নীচ থেকে করে গেছি দূরত্ব রেখে।কারণ এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। আমার পজিটিভ রিপোর্ট আসার সতেরো দিন পর, যেহেতু ওষুধ না খেয়েও আমার কোন উপসর্গ নেই, জ্বর নেই, তাই স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে আমাকে মেলে ফিট সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও আমি এখনও যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখেই রোগীর ডায়েটের দিকে নজর রাখার চেষ্টা করছি, এ ব্যাপারে নার্সিংহোমের ডায়েট চার্টের সঙ্গে সঙ্গে আমার এক ডায়েটেশিয়ান ভাগ্নীও আমাকে খুব গাইড করে চলেছে। কারণ গত পনেরো কুড়ি দিন ধরে যে ওয়েট লস এবং মাসল এর বিশেষ করে পায়ের মাসলের যে উইকনেস তৈরি হয়েছে, সেটা কমতে এখনও যথেষ্টই সময় লাগবে বলে মনে হয়। নার্সিংহোম থেকে আসার পর দেখতে দেখতে পনেরো দিন পার হয়ে গেলো। গতকাল তিনি গুটিগুটি অফিস মুখো হয়েছেন। প্রথম দিনই যেভাবে সহকর্মীরা সহানুভূতির সঙ্গে তার উপস্থিতি কে accept করেছেন, সেটা আমাদের কাছে আশাতীত পাওনা!
খুব সত্যি কথা বলতে কী, চারিদিকে মিডিয়ার প্রচারে এবং পরিচিত মানুষজনের কাছে ও যেভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার কাহিনী শুনে এসেছি, যেটাই সম্ভবতঃ মূল মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই রোগে, আমি এবং আমরা যে তার কোনো আঁচই সেভাবে বুঝতে পারি নি, ঈশ্বরের এ এক অসীম আশীর্বাদ বলেই মনে করি!! একটু আধটু ব্যতিক্রম তো থাকতেই পারে, কারণ এই রোগ এবং রোগীর সম্পর্কে ভীতি একটি সাধারণ হিউম্যান সাইকোলজি, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু যেভাবে এই বিগত পনেরো কুড়ি দিন ধরে আমার পরিবার, পরিচিত বন্ধুরা, আশেপাশের প্রতিবেশীরা, আমার স্কুলের এবং ওর অফিসের কলিগরা প্রতিনিয়ত পাশে থেকে আশ্বাস যুগিয়ে গেছেন,বুঝিয়ে দিয়েছেন স্যোশাল ডিস্ট্যান্সিং মানে শুধুই ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিং, কোনভাবেই মেন্টাল ডিস্ট্যান্সিং নয়, যেভাবে বেলভিউর চিকিৎসকরা, সিস্টার নার্সরা অতি আপনজনের মতো ভরসা দিয়ে চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে গেছেন,তাতে নতুন করে বিশ্বাস রাখতে শিখলাম, “সব ঠিক হয়ে যাবে”এই মন্ত্র কে ইচ্ছেশক্তির জোর মিশিয়ে আত্মস্থ করতে পারলে অনেক অনতিক্রম্য বাধাও অতিক্রম করা সম্ভব হয়ে ওঠে। এই সময় জুড়ে আমার কাছের এবং দূরের যে সমস্ত প্রিয় মানুষরা তাঁদের শুভকামনায় আমার পরিবারকে সর্বদা ছুঁয়ে থেকেছেন সকলের প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা ।