সাঁঝের প্রদীপ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে) **** মৃত্যুঞ্জয় রায়চৌধুরী

সাঁঝের প্রদীপ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
মৃত্যুঞ্জয় রায়চৌধুরী

একটা ছোট ফেস্টুন। মলিন হয়ে গেছে, তাতে বড়ো করে লেখা ‘ সাঁঝের প্রদীপ ‘ । নীচে একটু ছোট অক্ষরে – আমরা ৫০ জন। তার নীচে স্থাপিত: ১৪১০ সাল। আর আজ ৩১ শে ডিসেম্বর ১৪৩০, অর্থাৎ কুড়িতম বছর। রক্ত করবী গাছ টা ঠিক বেঁচে আছে, পঞ্চাশটি প্রদীপ নিভে গেছে। এই পার্কের কেয়ার টেকারের হঠাৎ চোখ পড়ে ফেস্টুনের সামনে উদাস হয়ে বসে থাকা রবির প্রতি। চমকে ওঠে, একজন ও বেঁচে নেই! ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন , বললেন— রবি, সাঁঝের প্রদীপ কি সব নিভে গেল? তা— তুমি সব জেনেও বসে আছো কেন?
রবি — কে মনাদা? বসো। জানো মনাদা কুড়ি বছর আগের সেই দিনটির কথা খুব মনে পড়ছে। সেদিন এঁদের কয়েক জন আমার দোকানে গিয়ে হাজির। তখন আমি বাইস কি তেইস। পঞ্চাশ জনের ফিস্ট শুনে কাজটা লুফে নিয়েছিলাম। ( রুদ্ধ কন্ঠে) এই সেই রক্ত করবী গাছ যার ডালে এই ফেস্টুন টা আমি ই তৈরী করে এনে বেঁধে দিয়েছিলাম। প্রতি বছর বেঁধেছি, আজ ও বেঁধে বসে আছি।গত বছর ও দশ জন ছিল।

১৪১০ সালের সেদিন রবি, হন্তদন্ত হয়ে মেরী পার্কে প্রবেশ করেছিল। পিছনে পিছনে নিয়ে এসেছিল ট্রলি ভর্তি মালপত্র গ্যাস সিলিন্ডার, রান্না করার বাসন, চাল, আলুর বস্তা, সব্জি, মাছ, তেল, মশলা সবকিছু। রান্না হবে প্লেন ভাত, কিছু আনাজপত্র দিয়ে মাছের পাতলা ঝোল, মুগের ডাল আর আলুভাজা। ব্রেকফাস্টের ঝামেলা নেই। প্রায় সকলেই মুড়ি , কেউ চিড়েভাজা, কেউ বিস্কুট ওসব নিজেরা সঙ্গে করে নিয়ে আসত । তখন ও আটটা বাজে নি কিন্তু পাকা চুলের মানুষ গুলো এত ঠান্ডায় ঐ সকাল বেলাতেই হাজির হয়ে গেছে। তার বিস্ময় কাটিয়ে একজন ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বললো— তুমি একদম তাড়াহুড়ো করবেন না বাবা । তুমি তো ঠিক সময়ে ই এসেছ, আমরা সবাই একটু আগে আগে চলে এসেছি। বুঝলে ভাইয়া একসঙ্গে জড়ো হওয়ার আনন্দে রাতে কারো ভালো ঘুম হয় নি। তুমি একটু গুছিয়ে নিয়ে এককাপ করে চা হাতে ধরিয়ে দাও, ব্যাস তোমার সকালের দায়িত্ব শেষ।
জানো মনাদা,ক্রমে ক্রমে বয়স্ক মানুষ গুলোর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। সারা বছর ওরা ফোনে আমার খোঁজ নিতে ভুলতে না। সব সময় বলত ,’তোমার ক্যাটারিং কেমন চলছে? তোমার মা, বৌ, বাচ্চা কেমন আছে? যখন যা দরকার হবে, বলবে, এই বুড়ো গুলো কে আপন ভেবে বলবে।’ আর একটা কথা আজকে আমাকে বলতেই হবে, তুমি তো জানো আমার বাবা নেই,আর মা কোনো পেনসন পায় না। এসব শুনে ওরা ওদের ‘সাঁঝের প্রদীপ ফান্ড’ থেকে প্রতিমাসে মায়ের একাউন্টে টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। বলত, ‘ তোমার মা যে কদিন বাঁচবে, স্বাধীন ভাবে বাঁচবে।’ টাকা কটা হাতে তুলে দিয়ে মায়ের সেই খুশি খুশি মুখটা দেখতে আমার যে কি লোভ হতো, তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।মানুষ গুলোর কোনো দাবি ছিল না। কেবল একটাই দাবী ছিল,মনে করিয়ে দিত,’ ৩১শে ডিসেম্বর যেন কোনো ভাবেই কামাই না হয়।’ ঐ দিনটার অপেক্ষায় সারা বছর বসে থাকত। বলত যাহোক করে এখানে আসবই , তবে অসুস্থ হয়ে বিছানা না নিলে কেউ কামাই করবে না। তখন জানিয়ে দিতে হবে।নতুবা ধরে নেওয়া হবে সে আর পৃথিবীতে নেই ।
পঞ্চাশ জন বিপত্নীক বৃদ্ধ নিয়ে ‘সাঁঝের প্রদীপ’ এর যাত্রা শুরু।পিকনিক শেষে সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে ফটো তুলতো, তখন সবাই হৈ হৈ করে হাসবে।গোনা হবে ক’জন এক বছরের ব্যবধানে গত হয়েছে। কিন্তু কোনো শোক নয়, সবাই মিলে স্বর্গতঃ বন্ধুদের প্রতি হর্ষধ্বনি করে বলবে, ‘ওখানে খুব আনন্দ করো,আর আমাদের জন্য জায়গা রাখতে ভুলোনা কিন্তু। আসছি, একটু অপেক্ষা করো।’
এবার যেতে হবে রবিকে, কিন্তু ফেস্টুন টা আর খুলবে না। কি হবে আর ওটা কাছে রেখে ? মানুষ গুলোই যখন মরে গেল। হঠাৎ এম্বুলেন্সের হুটারের শব্দে ঘুরে দাঁড়ায়। ভাবল পিকনিক করতে এসে হয়ত কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু না, এ যে নবী বাবু। সে ছুটে গিয়ে নবী বাবু কে ধরতে যায়। কিন্তু তাঁর ছেলে আর ছেলের বৌ ততক্ষণে তাঁকে দুহাত সযত্নে ধরে এগিয়ে নিয়ে আসছে।
ছেলে – আপনি রবিবাবু। নমস্কার, বাবার মুখে আপনার কথা খুব শুনেছি। আজকে বুঝলাম কেন আপনি এঁদের বড়ো প্রিয় পাত্র। এই অসুস্থ শরীর নিয়েও মানুষটা জেদ ধরেছিল, “ আমি না গেলে যে রবি শেষ ফটো টা তুলতে পারবে না রে বুড়ো। উপরে আমার বন্ধুরা যে অপেক্ষা করছে, বৃত্তটা আমাকে সম্পূর্ণ করতেই হবে।ওরে শেষ পাতাটাই যে প্রমাণ করবে একদিন আমরা পঞ্চাশ জন এই পৃথিবীতে ছিলাম , হাসতাম, খেলতাম , ফিস্ট করতাম। তোরা সবাই একটু হাসতো বাবা, জোরে জোরে হাস। আমি কথা রাখতে পেরেছি। এই দ্যাখো তোমরা আমি কেমন আমার দৌড় শেষ করছি। ”
হঠাৎ বুকের ভিতর কষ্ট অনুভব করেন নবী বাবু। আসলে অক্সিজেনের মাস্কটা খুলে গাড়িতে রেখে এসেছেন জোর করে।ওটার নাকি আর দরকার নেই।
নবী—- রবি, হাতে আর সময় নেই বোধহয়। এই ফেস্টুন আর এই করবি গাছটাকে নিয়ে ছবিটা তুলে ফেল তো। একটু তাড়াতাড়ি করো, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না । ছবিটা কিন্তু তোমার কাছে রাখবে। বড়ো করে বাঁধিয়ে রাখবে।।
আমার ব্যাগে উনিশ টা ছবি আছে।সবাইকে বলবে আমরা পঞ্চাশ জন একদিন এই পৃথিবীতে বেঁচে ছিলাম। ঐ ব্যাগে আর একটা কাগজ পাবে। আমাদের ‘ সাঁঝের প্রদীপ ফান্ড’ এর নমিনি করেছি তোমাকে। যা টাকা আছে তাতে তোমার নিশ্চিন্তে চলে যাবে। আমার কাজ শেষ।আঃ, কি আরাম।এবার আমি যাই।’
হসপিটাল থেকে কিছুক্ষণের জন্য ছুটি নিয়ে এসেছিলেন নবী বাড়ুজ্জে। অক্সিজেন চলছিল। সেদিন রবির কোলে মাথা রেখে, ছেলে ও বৌমার কোলে পা রেখে শেষ নিঃশ্বাস যখন ত্যাগ করলেন বাড়ুজ্জেমশাই তখন কয়েক ‘শ মানুষ তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন চোখ মুচ্ছিল। রবি বলে চলছিল ‘সাঁঝের প্রদীপ’ এর সাতকাহন। কিন্তু স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল,’ দয়া করে চোখের জল ফেলবেন না। ওঁরা আজকে, আনন্দ করতেন, খুব আনন্দ করতেন। নাচতেন, গাইতেন, খুনশুটি করতেন।সত্যি একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো।’
ভীড়ের মধ্যে থেকে কোনো একজন গান ধরলেন , ” না যেও না, ও শেষ পাতা গো শাখায় তুমি থাকো, ছিলে তুমি, ছিলাম আমি …..।”
নবী বাঁড়ুজ্জে হাসতে হাসতে স্বর্গের পথে পা বাড়ালেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *