আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্যিক হয়ে ওঠার লড়াই *** © মোনালিসা সাহা দে

আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্যিক হয়ে ওঠার লড়াইটা অত সহজ ছিল না। “মেয়েদের লেখা মানেই পাতি লেখা… মেয়েরা আবার লিখতে পারে নাকি?” এমন নানান টিপ্পনি শোনা তো সে সময়ে ছিল অনিবার্য বিষয়। কিন্তু সামাজিক, পারিবারিক সকল বাধা অতিক্রম করে তিনি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলেন। আর পাঁচটা ঘরোয়া নারীর কথা জোর গলায় বলতে তিনি সমাজের চোখ রাঙানিকেও উপেক্ষা করেন। তিনি নিজেও বলেছিলেন যে তাঁকে দিয়ে জোর করে লিখিয়ে নেন স্বয়ং বিদ্যার দেবী নিজেই। তাই তো তিনি মা সরস্বতীর স্টেনোগ্ৰাফার।

“এত আলো পৃথিবীতে, তবু পৃথিবীর মানুষগুলো আজও অন্ধকারে কেন?” প্রশ্ন উঠেছিল তাঁর কলমে। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই প্রশ্ন আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক।

“নারীর জন্ম কি শুধু পুরুষজাতিকে মুগ্ধ করবার জন্যে? বাঁচবার জন্য নয়?”- এ প্রশ্নও তুলেছিলেন তিনি। সেই যুগে দাঁড়িয়ে একজন নারীর কন্ঠে এই প্রশ্ন ওঠা কতটা সাহসের পরিচয় বহন করে তার বলার অপেক্ষা রাখে না।

হয়ত প্রত্যেক বাঙালি নারীই আশাপূর্ণা হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন বা আজও চান। কারণ আশাপূর্ণার তেজ, আশাপূর্ণার ঘর এবং বাইরের অবিরাম সংগ্রাম, সর্বোপরি রান্নার হেঁসেলে বই পড়ার বাতিক এ যুগের মেয়েদের সঙ্গেও একাত্ম হয়ে যেতে পারে যেকোনো সময়।

যিনি প্রায় দুশোটি উপন্যাস লিখেছেন, প্রায় দুই হাজার গল্প লিখেছেন, ভাবতে অবাক লাগে সেই আশাপূর্ণা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা, সামান্য স্কুলেও যাননি কোনোদিন। পড়াশোনা যা শেখার সব ওই দাদাদের পড়া শুনে আর পত্র-পত্রিকা পড়ে। তাই ছোটো থেকেই একপ্রকার জেদ তাঁকে পাগলের মতো সবকিছু ভাবিয়েছে। এমনকি বিয়ে হওয়ার পর শ্বশুরবাড়িতে গেলেও কাগজ-কলমের সঙ্গ ছাড়েননি।

হ্যাঁ, দক্ষিণ দিকে একটা বারান্দা প্রয়োজন, ভীষণ প্রয়োজন। প্রত্যেক নারীর জীবনেই এই বারান্দাটুকু প্রয়োজন। এই বারান্দা না থাকলে নারীরা নিজেরা নিজেদেরকে চিনতে শেখে না। এই বারান্দা না থাকলে নারীরা নিজেদেরকে একটুও ভালোবাসতে শেখে না। এই বারান্দার এক ঝলক রোদের অভাবে সারা জীবন তলিয়েই থেকে যায় কত শত নারী। কিন্তু এই বারান্দার প্রয়োজনীয়তা সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবীই এত ভালোভাবে আমাদের সকলের সামনে প্রথম তুলে ধরেছিলেন।

আজকের নারীরা সাধারণত এই বারান্দা চিনতে ভুল করে না। তাই দৈনন্দিন প্রাত্যহিকতার সাথে নিজের জন্য এক টুকরো সময় তারা রাখে সেই খোলা বারান্দার জন্য। কারও জীবনে গান, কারও কারো জীবনে আবার সেই বারান্দা সূচিশিল্প। কারও জীবন তো আবার পুরোপুরিই বারান্দাময়। তারা নিজেরা এতটাই উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছেন যে তাদের জীবনকে বারান্দা না বলে খোলা আকাশই বলা যায়।

আশাপূর্ণা দেবীর একাধিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। তিনি সম্মানিত হয়েছিলেন ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ সহ দেশের একাধিক সাহিত্য পুরস্কার, অসামরিক নাগরিক সম্মান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে প্রদান করেন পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সম্মান ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’। ভারত সরকার দ্বারা তিনি ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান ‘সাহিত্য অকাদেমি ফেলোশিপ’- এ ভূষিত হন।

আশাপূর্ণা দেবী আজও সাহিত্য জগতের এক গোধূলি আকাশ, যে বর্ণে রামধনু হয়ে ভেসে বেড়াই আমরা সকলে। হাজার পরাজয়ের পরেও এ মনে স্বপ্ন দেখার সাহস জাগে বারবার। জন্মদিনে এই মহীয়সীকে জানাই আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে প্রণাম।

© মোনালিসা সাহা দে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *