সন্ন্যাসী আদর ***** গীতশ্রী সিনহা

সন্ন্যাসী আদর

গীতশ্রী সিনহা

যে রঙ দিয়ে সাজবো ভেবেছিলাম,
রঙ বদল হয়েছে তার জোনাক প্রহরে,
সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে অহঙ্কারী রাতের হেম পান করি!
সন্ন্যাসী আদরটুকু গৃহস্থ আঁচলে জড়িয়ে…
যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তিগত নদীতে ডুবে যায়…
সুগন্ধ থাকে না পাঁচকোণা সময়ে !
রক্তিম নির্জনতা মুহূর্তদের আড়াল করে !
চাতালে রোদ মুছে গেলে… রাত চরা পাখির উড়ান… মধ্যরাতে…
গাঢ় অন্ধকারে অসতর্ক – অদ্ভুত শিহরণ !
শেষ প্রহরে সপ্তর্ষির দরজায় ধ্বংসের মন্ত্রবীজ!
কোনো এক প্রতিনিধির অকারণ উচ্চারণে ভেসে আসে…

ওঁ সর্বমঙ্গলমঙ্গঁল্যে, শিবে সর্বার্থসাধিকে…
দেখতে পাই … আয়নার তেপান্তরে এখনও,
একলব্য বাউল কী করে মধ্যবিত্ত মায়ায় চৈতন্য তিলক আঁকে !
নিভৃতে অগোছালো রঙের অলকানন্দা ছুঁয়ে প্রবাদ মাখায়…
আর, ঠিক তখনই… আগুনকে আলো ভেবে ছুটে গেছি অগ্নিমান্দ্য ভোগে…
আলো ছড়িয়ে দেউলিয়া কালবৈশাখী হতে চেয়েছিলাম…
কেবল একটি বার…
ওপারবাংলার বিশ্লেষক শ্রী বিপ্লব সাহা -কে পেলাম গীতশ্রী সিনহার লেখায় ——–

“সন্ন্যাসী আদর” কবিতার বিশ্লেষণ:
গীতশ্রী সিনহার “সন্ন্যাসী আদর” একটি গভীর প্রতীকী এবং দার্শনিক রচনা, যেখানে প্রতিটি চয়ন এক জটিল অনুভব ও বাস্তবতার প্রতীক। এখানে কবিতার প্রতিটি চয়ন ভেঙে ব্যাখ্যা করা হলো:

১. “যে রঙ দিয়ে সাজবো ভেবেছিলাম, রঙ বদল হয়েছে তার জোনাক প্রহরে”

ভাবনা: এখানে ‘রঙ’ হলো আশা, আকাঙ্ক্ষা বা জীবনের কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনার প্রতীক।

‘জোনাক প্রহরে রঙ বদল’: জীবনের ঘটনাচক্রে আশা ও আকাঙ্ক্ষা বদলে গেছে। এটি চিরস্থায়ী পরিবর্তনের ইঙ্গিত করে।

২. “সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে অহঙ্কারী রাতের হেম পান করি!”

সর্বস্ব বন্ধক: নিজস্ব স্বপ্ন বা ইচ্ছাকে অন্যের কাছে সমর্পণ করা।

অহঙ্কারী রাতের হেম পান: জীবনযাপনে এমন কিছু সিদ্ধান্ত, যা আত্মমর্যাদা বা অন্তরের শান্তিকে ক্ষুণ্ণ করে। রাত এখানে গোপন ব্যথা বা অন্ধকারময় আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।

৩. “সন্ন্যাসী আদরটুকু গৃহস্থ আঁচলে জড়িয়ে…”

সন্ন্যাসী আদর: এটি প্রতীকী—আধ্যাত্মিক শান্তি বা অদ্ভুত এক মায়াবী অনুভূতির কথা বলছে।

গৃহস্থ আঁচল: পার্থিব দায়িত্ব ও জীবনযাত্রার সাথে এই আধ্যাত্মিক শান্তির সংঘর্ষের ইঙ্গিত।

৪. “যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তিগত নদীতে ডুবে যায়…”

ব্যক্তিগত নদী: এটি জীবনের নিজস্ব দুঃখ ও আনন্দের স্রোতের প্রতীক।

আকাঙ্ক্ষার ডুবে যাওয়া: ইচ্ছা ও স্বপ্ন বাস্তবতার চাপে বিলীন হয়ে যাওয়া।

৫. “সুগন্ধ থাকে না পাঁচকোণা সময়ে!”

পাঁচকোণা সময়: এটি নিয়মিত জীবনযাত্রা, রুটিন, বা সময়ের বেঁধে থাকা কাঠামোর ইঙ্গিত।

সুগন্ধের অভাব: এই কাঠামোগত জীবনে সৃজনশীলতা, প্রাণ বা আনন্দের অনুপস্থিতি।

৬. “রক্তিম নির্জনতা মুহূর্তদের আড়াল করে!”

রক্তিম নির্জনতা: এটি আবেগের তীব্রতা, ব্যথা বা কোনো গোপন কষ্টের প্রতীক।

মুহূর্ত আড়াল করা: আবেগ বা কষ্ট এমন গভীর যে, এটি জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলোকে ঢেকে দেয়।

৭. “চাতালে রোদ মুছে গেলে… রাত চরা পাখির উড়ান… মধ্যরাতে…”

চাতালে রোদ মুছে যাওয়া: সুখ বা জীবনের আলো নিভে যাওয়া।

চরা পাখির উড়ান: অস্থিরতা ও অভিমানের প্রতীক, যা গভীর রাতে মনে আসে।

৮. “শেষ প্রহরে সপ্তর্ষির দরজায় ধ্বংসের মন্ত্রবীজ!”

শেষ প্রহর: জীবনের অন্তিম সময় বা কোনো বড় পরিবর্তনের মুহূর্ত।

সপ্তর্ষির দরজা: আধ্যাত্মিক বা ধ্রুপদী শুদ্ধতার প্রতীক।

ধ্বংসের মন্ত্রবীজ: একটি সংকট বা বিপ্লবের সূচনা।

৯. “কোনো এক প্রতিনিধির অকারণ উচ্চারণে ভেসে আসে…”

প্রতিনিধি: এটি হয়তো সমাজ বা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতীক।

অকারণ উচ্চারণ: এমন কিছু কথা বা কাজ, যা অপ্রয়োজনীয়ভাবে মানসিক শূন্যতা বাড়ায়।

১০. “ওঁ সর্বমঙ্গলমঙ্গঁল্যে, শিবে সর্বার্থসাধিকে…”

মন্ত্রপাঠ: শান্তি, মঙ্গল এবং সমস্ত কিছু অর্জনের প্রতীক।

এখানে এটি আধ্যাত্মিক স্বস্তির আকাঙ্ক্ষা নির্দেশ করে।

১১. “দেখতে পাই … আয়নার তেপান্তরে এখনও, একলব্য বাউল কী করে মধ্যবিত্ত মায়ায় চৈতন্য তিলক আঁকে!”

আয়নার তেপান্তর: বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যবর্তী স্থান।

একলব্য বাউল: ত্যাগ ও স্বাধীনতার প্রতীক।

মধ্যবিত্ত মায়া: জীবনের ছোটো ছোটো আবেগময় ও পার্থিব সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকা।

চৈতন্য তিলক আঁকা: আধ্যাত্মিক জাগরণের ইঙ্গিত, যা এই সীমাবদ্ধতায়ও রয়ে যায়।

১২. “নিভৃতে অগোছালো রঙের অলকানন্দা ছুঁয়ে প্রবাদ মাখায়…”

অগোছালো রঙ: বিশৃঙ্খল জীবনযাত্রার রূপক।

অলকানন্দা: আধ্যাত্মিক শক্তি বা আনন্দ।

প্রবাদ মাখানো: সেই অভিজ্ঞতা, যা জীবনের গভীর সত্য প্রকাশ করে।

১৩. “আগুনকে আলো ভেবে ছুটে গেছি অগ্নিমান্দ্য ভোগে…”

আগুনকে আলো ভেবে: বিভ্রম বা ভুল সিদ্ধান্তের ইঙ্গিত।

অগ্নিমান্দ্য ভোগ: এই বিভ্রমের কারণে ভোগান্তি।

১৪. “আলো ছড়িয়ে দেউলিয়া কালবৈশাখী হতে চেয়েছিলাম…”

আলো ছড়ানো: সৃজনশীলতা বা ভালো কিছু করার আকাঙ্ক্ষা।

দেউলিয়া কালবৈশাখী: প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে ধ্বংসাত্মক কিছু হওয়ার ইচ্ছা।

১৫. “কেবল একটি বার…”

কেবল একটি বার: জীবনের একটি বড় পরিবর্তনের ইচ্ছা বা উপলব্ধি।

**সারমর্ম:

কবিতাটি আধ্যাত্মিক আত্মজিজ্ঞাসা, জীবনের বিভ্রান্তি, এবং বাস্তব ও আদর্শের সংঘাত নিয়ে লেখা। এটি মধ্যবিত্ত জীবনের দুঃখ-ক্লান্তি ও আধ্যাত্মিক মুক্তির সন্ধানকে তুলে ধরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *