সীতা বিসর্জন ——– জয়তী রায় মুনিয়া

সীতা বিসর্জন
———————–
জয়তী রায় মুনিয়া
—-এত অহংকার কেন সীতা? তুমি আমার হাতে বন্দিনী। আজ কয়মাস হয়ে গেল! কেউ তো এল না তোমার খবর নিতে? তবে? আমাতে সমর্পিতা হও।
—- ইচ্ছা বিনা নারী আগুনের সমান। সেকথা জেনেও, তাকে ছুঁতে এস না রাবণ। আর অহংকারের কথা যদি বলো, সে আমার নিজস্ব। কারো দয়ার উপর তা নির্ভরশীল নয়।
—-চেয়ে দ্যাখো। আমি হলাম সেই পুরুষ যাকে কামনা করে সব পেতে পারো তুমি। সমস্ত। সুখ, ঐশ্বর্য, ক্ষমতা– আর কি চাইতে পারে নারী?
—-আহ! রাবণ। নারীর চাওয়া বলতে এই ই বোঝো তুমি? কাম? আর প্রাচুর্য? শোনো কামুক,
তুমি বেদ পাঠ করেছ। জ্ঞানী তুমি। স্বর্ণলংকার সম্রাট? অথচ, তোমার বোধ নীচ। নিম্ন গতির।
—-চুপ করো। চুপ করো। নারী। আমি বোধহীন নই । নই পাষন্ড। কিন্তু , মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, তোমার ঐ জ্বলন্ত রূপ আমি পিষে নেব দুই হাতে। তোমার স্তন, তোমার শরীরে আমূল বেঁধাব নখ—আমি পুড়ে যাচ্ছি কামনায়।
—রাবণ। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্পর্শ করে তুমি পাবে, কিছু রক্ত, মাংস চামড়া— যা পচে গলে খসে খসে পড়বে। নেবে তুমি আমার ত্বক? আমার চুল? আমার উপরের আবরণ? টুকরো করে ছিঁড়ে ফেল। বেরিয়ে আসুক ভিতরের হাড় মজ্জা।
—- সীতা। তোমাকে হরণ করেছিলাম প্রতিশোধ নিতে। আমার অধিকৃত অঞ্চলে প্রবেশ করে, আমার বোনকে লাঞ্ছনা করেছিল আর্য যুবক–তাঁর পত্নী হরণ করে, উচিত শিক্ষা দেওয়া ছিল উদ্দেশ্য।
—- রাবণ। এই তোমার পুরুষকার? নারী হরণ?
—থাক সীতা। পুরুষকারের কথা বরং থাক। তার জবাব দেবে ইতিহাস। কিন্তু, একথা কি করে বোঝাব? যখন প্রথম দেখলাম তোমায়, মনে হল–এই মুখ আমি স্বপ্নে দেখতাম? তুমি আসার পর কেটে গেছে অনেক গুলি মাস। রোজ একবার তোমাকে না দেখলে , বীণায় আমার সুর ওঠেনা! সীতা, আমি একলা কেঁদে ফেলি মাঝে মাঝে। স্বর্ণ মহল নারী পূর্ণ, বিলাস ঝলমল– অথচ আমার বুকের মাঝে ঘুরে বেড়ায় এক নিঃসঙ্গ ঘুঘু। সারাদিন অশোক বনের ধারে বসে থাকি। ফিরেও দেখো না তুমি! তবু বসে থাকি। আশ মেটেনা সীতা। তুমি একটু তাকালেই, বুকে কেমন কাঁপন লাগে। এমন কখনো হয় নি আগে।
—আমি রামের সীতা। তাঁকে ছাড়া ,কাউকে ভাবিনা কখনো। আর তুমি আমায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে, এক বৎসর রামচন্দ্রের জন্য অপেক্ষা করবে। তবে আজ কেন এই উন্মাদনা?
—-উন্মাদ? ধিক নারী। ভালোবাসা কোনোদিন দেখোনি তুমি! পুরুষ যদি ভালোবাসে, যদি হৃদয়ে ধারণ করে কাউকে–এমন হয় সে। তোমার কি একটু মমতা হয় না? কিংবা কৃপা?
—- অবাক আমি? অহংকারী সম্রাট। অবাক আমি। সামান্য নারীর জন্য এত আবেগ? শোনো সম্রাট! পরপুরুষ সম্পর্কে চিন্তা করা মহাপাপ আমার! তুমি ফিরে যাও।
—পাপ! কিসের পাপ? কে বলেছে? ভালোবাসলে তা পাপ?
—ভালোবাসা আর কামনা এক নয় রাবণ। আমি আর ইচ্ছুক নই কথা বলতে।
—-সীতা। এক বছর কেন আমি হাজার বছর অপেক্ষা করব তোমার জন্য। হয়ত বা মৃত্যু পর্যন্ত।
—তিনি আসছেন রাবণ। আমার প্রভু রাম।তিনি উদ্ধার করবেন আমাকে। যত শক্তি তোমার থাক। উড়ে যাবে ,ঝড়ের মুখে কুটোর মত।
—আমি কি নিয়ে যুদ্ধ করব সীতা? আগুনে পুড়ে যাওয়া শস্য ক্ষেতের মত একলা পড়ে আছি। শুধু এই টুকু জানি, শরীরে এক ফোঁটা রক্ত থাকলেও, তোমাকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না।
—- তুমি উন্মাদ।
—- সীতা! দূরে ওই কোলাহল শোনা যায়। সমুদ্র গর্জন ছাপিয়ে ঢুকে পড়ছে রাম লক্ষণের উল্লাস। যুদ্ধ জয় অথবা পরাজয়–দুটোতেই ফল সমান আমার–সীতা বিসর্জন। তাই আমি পরাজিত প্রেমিক এক।
তবু বলে যাই–যদি একলা মনে করো কোনোদিন –যদি নিঃসঙ্গ বালুচরের মত পড়ে থাকো অবহেলায়–একবার মনে করো এই উন্মাদের মুখ। মৃত্যুর পরেও পাখি হয়ে, জানলায় এসে বসব। চাঁদ হয়ে উঁকি মারব তোমার শয়ন কক্ষে। ফুল হয়ে মুছিয়ে দেব চোখের জল। মনে করো একবার।
**
—-হে রাম। প্রিয়তম। অগ্নি পরীক্ষা দিতে হবে আমায়? কেন স্বামী? একবছর তোমার বিরহের আগুনে পুড়ে ,একলা কাটিয়েছি, এখন শরীর চাইছে প্রিয় পুরুষের নিবিড় আলিঙ্গন। এখন এই জনতার মাঝে, নগ্ন পায়ে দাঁড়িয়ে আছি। সূর্যের দুরন্ত তাপ –শত লোকের উগ্র দৃষ্টি–তার মধ্যে অগ্নি পরীক্ষা? কেন স্বামী?
—-প্রশ্ন করোনা নারী। সমাজ তোমাকে অবিশ্বাস করে। তোমাকে প্রমাণ করতে হবে, রাবণ তোমাকে স্পর্শ করে নি।
— সমাজ অবিশ্বাস করে! আর তুমি?
—আমি সমাজের বাইরে নই।
—অগ্নি আমার শরীরের শুদ্ধতা প্রমাণ করবে হয়ত, কিন্তু মন?
—সীতা! স্তব্ধ হও।
—হে রাম! আপনার সম্মান রাখতে ,অগ্নি প্রবেশ করব আমি। কিন্তু সমাজ জানুক–মনের সতীত্ব প্রমাণ করতে পারে এমন পরীক্ষা কখনো আবিষ্কার হবে না।
—-সীতা। নারী সমাজের শোভা। তার সতীত্ব সমাজের অলংকার।
—তাকে রক্ষার দায় ও তবে আপনাদের। রক্ষা যদি না করতে পারেন তবে অগ্নি পরীক্ষা নেবেন কেন?
—-সীতা। সময় নেই। সময় নেই। যাও। ওই লেলিহান আগুনে নিজেকে সম্পর্পণ করো। যদি অক্ষত ফিরে আস, বুঝব তুমি সেই আগের সীতা।
—-হে রাম! ওই আগুন থেকে ফিরে যে আসবে, সে আর আপনার সীতা থাকবে না। আমার মনের মধ্যে ভালোবাসার ছোট্ট পাখিটি পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আপনার হাতে হাত রেখে কাটিয়েছি কত রাত, আপনার শরীরে যুক্ত করেছি আমার শরীর, কখনো আলাদা ভাবিনি নিজেকে–নিজেকে পৃথিবীর সেরা সুখী নারী ভেবেছি–আপনার হৃদয়ের সিংহাসনের অধিকার আমার একথাই ভেবেছি ,এত কাল। সে সব মিথ্যে? সত্য কেবল লঙ্কা বাসের একটি বছর?
—সীতা। নারীকে এত প্রশ্ন করতে নেই।
—-আজ মনে পড়ছে এক বীনাবাদকের কথা।
—বীণ বাদক? কে সে?
—আজ মনে পড়ছে, দুটি ব্যাকুল চোখের কথা।
—-সীতা? কার চোখ?
—-আজ মনে পড়ছে , ভালোবাসায় ভরা এক হৃদয়ের কথা।
—সীতা!
—স্তব্ধ হও হৃদয়হীন পুরুষ। রাষ্ট্রের শাসনে বদ্ধ এক মূক জীব! সমাজ আর রাষ্ট্রের জন্য বলি দেবে প্রাণ? প্রাণের অস্তিত্ব তাঁর নিজ গুণেই মহান। প্রাণের কোনো লিঙ্গ হয় না।
এখানে উপস্থিত হাজার পুরুষের আত্মা তৃপ্ত হোক। অন্ধকার আরো ঘনীভূত হোক। সমাজ শৃঙ্খল আরো কঠিন হোক। আমি সীতা। অগ্নিতে প্রবেশ করলাম।