সম্পাদকীয় মাতৃরূপেণ সংস্থিতা / ছন্দা চ্যাটার্জি

সম্পাদকীয়

মাতৃরূপেণ সংস্থিতা / ছন্দা চ্যাটার্জি

নরেনবাবুর নাতনি শ‍্যামলাঙ্গী চারুলোচনা ষোড়শী শিবানী দাদুর পাশে এসে বসলো।-“আচ্ছা দাদুভাই,বলো তো মা কালী কেন কালো?দুগ্গা,লক্ষ্মী,সরস্বতী,শেতলা,মনসা,এমনকি বনবিবি পর্যন্ত সবাই ফর্সা।সাদা কিংবা হলুদ রঙের।শুধু মা কালী কেন আমার মতো?”-দাদু নরেন্দ্র ঘোষাল শাস্ত্রজ্ঞ বলে বিখ‍্যাত।শান্তিপুরের পণ্ডিত মানুষ।আজ তাঁর বাড়িতে কালীপুজো।কিশোরী নাতনির কথায় ঠাকুরদালানে বিরাজমানা মাতৃপ্রতিমার উদ্দেশ‍্যে প্রণাম জানিয়ে তিনি বলতে লাগলেন -“জানি দিদিভাই,এই একটা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে তুমি ক্ষান্ত হবে না।এরপর বলবে এলোকেশী কেন?চারটে হাত কেন?জিভ বের করে আছে কেন?”-
শিবানী বলে-“না না,এটা আমি জানি দাদুভাই।স্বামীর বুকে পা দিলে লজ্জা তো হবেই।আমি জানি চণ্ডিমণ্ডপের আসরে তুমি একটু অন‍্য রকম ভাবে ব‍্যাখ‍্যা করো।আমি সেই গুলোই শুনতে চাই।”- কিশোরী নাতনির জ্ঞানার্জনের আগ্রহ নরেনবাবুকে
খুশী করে।তিনি শুরু করেন-“শোন দিদিভাই,মা কালীর রং,রূপ সবই প্রতীকী।কালো রং কালের প্রতীক।তা ছাড়া সব রংকেই ধারণ করে কালো রং
।আঁধার তিমিরেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের আলো
। মা সেই কালোকে নিজের অঙ্গের ভূষণ করে নিয়েছেন।মা ত্রিনয়নী।কপালের ঐ নেত্র দিব‍্যদৃষ্টি বা ভবিষ্যৎ দর্শনের প্রতীক।”- হঠাৎ শিবানী প্রশ্ন করে-“দাদুভাই,আমাদের ঠাকুর তো কালো নয়। নীল।কেন?”-নরেনবাবু বলেন-“ভালো প্রশ্ন।শোন তবে।সমুদ্রমন্থনে যে গরল উঠেছিল তা মহাদেব নিজের কন্ঠে ধারণ করে নীলকন্ঠ হয়েছিলেন।তবু কিছু বিষ ছড়িয়ে পড়েছিল দ্বেষ,হিংসা,সামাজিক হানাহানি ইত‍্যাদি রূপে।বিষের রং যে নীল তা তো তুমি জানো।মা সন্তানের কল‍্যাণের জন‍্য সেই নীল নিজ শরীরে মেখে নেন।এটাও প্রতীকী বলেই আমি মনে করি।অবশ‍্য আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। আজকাল তো গুগুলের যুগ।খুঁজে দেখতে পারো।শিবানী বলে-“ঠিক বলেছ দাদুভাই,আমি দেখবো।তবে মনে হয় তোমার ধারণার সঙ্গে মিলে যাবে।এবার আরো কিছু বলো।”–

নরেনবাবু বলতে থাকেন-“মা দিগ্বসনা।দিদিভাই,দশ দিকই যার বসন,তার আর বসনের কী দরকার? লজ্জা তো ঢেকে দিয়েছে নর-কর-মেখলা।আচ্ছা,বল তো দিদিভাই,হাত কিসের প্রতীক?”-
শিবানী বলে-“শক্তির”-।নরেনবাবু খুশী হয়ে বলেন-
-“সাবাশ!এর আর একটা অর্থও তো হতে পারে?
কটিদেশ ঘিরে নর-কর-মেখলা।অর্থাৎ কোমরের জোর?কন্ঠে নরমুণ্ডমালা,হস্তে ধৃত নরকপাল, কিসের প্রতীক দিদিভাই?বুদ্ধির-মুণ্ড বুদ্ধির প্রতীক।বক্ষে দোদুল‍্যমান বুদ্ধি সাহসের ইঙ্গিত দেয়।দেবী চতুর্ভূজা।এক হাতে বর অর্থাৎ আশীর্বাদ,আর এক হাতে অভয়।অন‍্য এক হাতে খড়্গ,যা অশুভকে বিনাশ করার জন‍্য উদ‍্যত,অন‍্য করোদ্ধৃত মুণ্ডটি অসুরের।মহাশক্তির হস্তে বিনষ্ট দুষ্টবুদ্ধির প্রতীক।”-

-“মা লোলরসনা।জিহ্বা কিসের প্রতীক?
লোভের।মা দন্ত দ্বারা জিহ্বাকে দংশন করে রেখে
ছেন।দন্ত কিসের প্রতীক?অন্তরের শুভ্রতা এবং
সংযমের।মা যেন বলতে চাইছেন এই ভাবেই লোভকে সংযত করো।মা শিবের বুকে চরণ রেখেছেন।আগেই বলেছি,শিব মহাকাল।তাঁর হিসেবের খাতায় সব লেখা থাকে।পাপের হিসেব,পূণ‍্যেরও।সেই মহাকালের বুকে চরণ রেখে মা মহাকালকেও জয় করেছেন। আমি তো তাই মাকে দ্রোহের দেবী বলেও মনে করি।

মায়ের মূর্তির পরিকল্পনায় কত বড় শিক্ষা লুকিয়ে আছে ভাবো তো দিদিভাই!আর সবচেয়ে বড় কথা হলো,শক্তির আরাধনায় নারীশক্তিকে সম্মান দেওয়াই আসল উদ্দেশ্য। আজ আমাদের সমাজকাঠামোয় ঘুন ধরে গেছে। সেখানে নারীদের বড়ো অসম্মান করা হয়। নারীকে পণ্য ও ভোগ্যের উপাদান মনে করে অনেকে। মাতৃমূর্তির নিগুঢ় অর্থ না জেনে পুজো করা মানে মাকেই অমর্যাদা করা”–
শেষের দিকে আবেগকম্পিত কন্ঠে উদাত্ত স্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করে উঠলেন নরেনবাবু—-

-“মহা মেঘপ্রভাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভূজাং
কালিকাং দক্ষিণাং মুণ্ডমালা বিভূষিতাং”—

দু চোখ ভরা জল নিয়ে দাদুর দিকে তাকিয়ে রইলো ষোড়শী কিশোরী।যে মেয়েটি কাউকেই মুখ ফুটে বলতে পারেনি তার গোপন প্রেম আর অপমানিত ও প্রত‍্যাখ‍্যাত নারীত্বের কথা। সে যে কালো!তার যতই কালো হরিণ চোখ থাক,কেউ পড়তে চায় না সেই চোখের ভাষা!!সে যে কালো!!!বড্ড কালো !!!

এই সংখ্যায় সম্পাদকীয় কলমে উপস্থিত আছেন ছন্দা চ্যাটার্জি প্রাসঙ্গিক কলমে।
আবার প্রমাণিত হয়ে গেল দিনাজপুর ডেইলি ওয়েবসাইট ম্যাগাজিন আমাদের সকলের প্রচেষ্টার ফসল।
ঠিক এইভাবেই এগিয়ে যাবো আগামীর দিকে। শুভকামনা শুভেচ্ছা রইল সকল সাহিত্য সাথীদের প্রতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *