নেশা ✒️✒️ নিরঞ্জন_ঘোষ
নেশা
নিরঞ্জন_ঘোষ
“জানিস, বাংলা ভাষাতে নেশা শব্দটিকে শুধুমাত্র খারাপ চোখে দেখা হয়। নেশা শব্দটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে একটা টলটলায়মান লোক নিজেকে সামলাতে ল্যাম্পপোস্ট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিম্বা একটা লোক জুয়ায় সব কিছু হেরে গিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ছে। আবার হয়তো দেখলি একটা লোক বাসে ট্রেনে মেয়েদের পেছন পেছন ঘুরছে। নানা রকম নেশা। কিন্তু আদতে তো নেশা মানে সবসময় খারাপ কিছু নয়। ভালোও আছে।“
সত্যদা হাতের সিগারেটটাতে একটা লম্বা টান দিলেন।
“কিরকম?” শ্যামল জানতে চাইল।
“তাহলে শোন”, সিগারেটটা নিভিয়ে সত্যদা বললেন, “এই যে আমি সিগারেটে টান দিচ্ছিলাম, এটা একটা ভয়ঙ্কর নেশা। যে টানে তার তো ক্ষতি হয়ই, যারা তার পাশে থাকে তারাও পরোক্ষ ধুমপানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাকগে ওসব কথা থাক, একটা ভালো নেশার গল্প শোন। না, গল্প নয়, একদম সত্যি।“
“তখন আমি উত্তর প্রদেশের ওবরা নামে একটা জায়গায় থাকি। ওখানে বিশাল একটা লেক আছে। আছে ওবরা থার্মল পাওয়ার ষ্টেশন। জায়গাটার নাম ওবরা ড্যাম। চোপান রেল ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে রেল লাইন ওবরা ড্যামের উপর দিয়ে চলে গেছে সিংগরৌলি হয়ে মধ্যপ্রদেশে। আমি যখন ওখানে চাকরি করতাম, তখন রেললাইন দিয়ে মালগাড়ি ছাড়া কোন প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলত না। শুধু প্রত্যেক সোমবার ওবরা থেকে একটা মালগাড়ির সঙ্গে দুটো সেকেন্ড ক্লাশ কামরা জুড়ে দেওয়া হতো রেলের স্টাফেদের জন্য। সপ্তায় একদিন। ওবরা থেকে সিংগরৌলি পর্যন্ত।
তো সোমবার সোমবার ঐ কম্পার্টমেন্ট দুটোতে যা ভীড় হতো, সবই ওদিককার আদিবাসিদের। রেলের স্টাফ খুব বেশি হলে কুড়ি পঁচিশ জন থাকত। আদিবাসিদের দল মির্চাধুরি, করেইলা রোড ষ্টেশনে নেমে যেত। জঙ্গলে যেত কাঠ কাটতে। আবার সন্ধ্যেবেলায় ঐ গাড়িটাই ফেরত আসত ওবরা ষ্টেশনে। আদিবাসিদের দল ফেরার সময় কাঠের বোঝা, ময়ুর মেরে নিয়ে ফিরত। সপ্তায় ঐ একদিনই – সোমবার। আর ঐ ট্রেন থেকে রেলের কোন লাভ হতো না, কারণ রেলের লোকেদের টিকিট কাটার কথাই নয় আর আদিবাসিরা টিকিট কি বস্তু কোনদিন চোখেই দেখেনি। রেল পুলিশও তাদের কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারত না। খেতেই পায়না, পয়সা কোথা থেকে দেবে।
আমি চাকরি করতাম রেলের পি ডব্লু আই অফিসে – ইঞ্জিনীয়ারিং ডিপার্টমেন্টে। আমাকে মাঝে মাঝে সিংগরৌলি অফিসের কাজে যেতে হতো। রেলের লোকেরা একটা কম্পার্টমেন্টের একদিকে একসঙ্গে বসত। আদিবাসিদের সঙ্গে বসত না। অবশ্য তার কারণও আছে। লোকগুলোর শরীর দিয়ে একটা বিজাতীয় গন্ধ বেরোত, সহ্য করা যেত না। তার উপরে ফেরার সময় দুনিয়ার কাঠের বোঝায় একটা কম্পার্টমেন্ট ভর্তি থাকত, পা রাখার জায়গা পর্যন্ত থাকত না।
আমি মাঝে মাঝে দরকার পড়লে সিংগরৌলি যেতাম, তবে প্রতি সোমবার নয়। অফিসের প্রয়োজনে। যখনই যেতাম, দেখতাম এক ভদ্রলোক একটা হোমিওপ্যাথির বাক্স নিয়ে আদিবাসিদের মধ্যে ওষুধ বিলি করছেন। ওদের সঙ্গে ওদের ভাষায় কথা বলতেন। সে এক অদ্ভুত ভাষা। হিন্দীর মতো, অথচ হিন্দী নয়। যাইহোক, দেখতাম ভদ্রলোক পরম মমতার সঙ্গে যার যা প্রয়োজন ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। উত্তর প্রদেশের লোক। তবে রেলের লোক ছিলেন না। সম্ভবতঃ ওবরা থার্মল প্ল্যান্টের লোক ছিলেন। যাইহোক, আসল কথায় আসি।
আমাদের অফিসটা ষ্টেশন থেকে বেশ দূরে ছিল। একদিন আমি কোন প্রয়োজনে ষ্টেশনের দিকে আসছি, দেখা হয়ে গেল সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে। প্ল্যাটফর্মের একটা বেঞ্চের উপর বসে। ওনাকে দেখেই মনে পড়ল, আরে আজ তো সোমবার। ভদ্রলোক আজ সিংগরৌলি যাননি।
এর আগে কোনদিন কথা বলিনি ভদ্রলোকের সঙ্গে। কাছে গিয়ে নমস্কার দিয়ে হিন্দীতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি আজ সিংগরৌলি যাননি?’
বিষাদ ভরা মুখটা তুলে প্রতি নমস্কার জানিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গাড়িটা ফেল করেছি। যেতে পারলাম না। আমার ভালো লাগছে না।‘
আমি বললাম, ‘আপনার অনেক ক্ষতি হয়ে গেল তাহলে? আজকে পেশেন্টদের থেকে কিছু পেলেন না।‘
ভদ্রলোক অবাক হয়ে আমার দিকে চাইলেন। আস্তে আস্তে বললেন, ‘আমি তো পেশেন্টদের থেকে কিছুই নিই না। তাছাড়া ওরা পাবেই বা কোথা থেকে, ঠিকমতো খেতেই পায়না।‘
আমি বললাম, ‘তাহলে আপনার অসুবিধা কোথায় হলো? যান, বাড়ি গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে রেস্ট নিন।‘
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘হোমিওপ্যাথি আমার পেশা নয়। শুধু ওষুধ দেবার বাহানায় ওদের সঙ্গে মিশি। এই ভাবে না মিশলে ওরা তো আমার সঙ্গে কথাই বলবে না।‘
আমি হাঁ হয়ে গেলাম। ‘তার মানে?’
‘মানে কিছুই নয়। আসলে আমি ওদের ভাষা শিখি। হারিয়ে যাওয়া ভাষা শেখা আমার নেশা।“
===================