জীবনবিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু কথা- পর্ব ৬ ✍️ডরোথী দাশ বিশ্বাস

জীবনবিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু কথা- পর্ব ৬

✍️ডরোথী দাশ বিশ্বাস

এডুকেশনাল ট্যুর বলতে দীঘা পুরী বা কাজিরাঙা- সবসময় সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে অর্থ ও সময়- দুইই প্রয়োজন। এছাড়া নিরাপত্তার দিকটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থী তার চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে জানবে। জানবে পরিবেশের জৈব ও অজৈব উপাদান সম্পর্কে। জানবে তাদের পারস্পরিক মিথোষ্ক্রিয়া সম্পর্কে।

পথ চলতে চলতে কথা হোক সূর্যালোকের ফোটন কণা, বাতাসের অতিপরিচিত গ্রীনহাউস গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড, বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কঠিন কণা- যানবাহন থেকে নির্গত কার্বন কণা, সবুজ পাতায় থাকা ক্লোরোফিল নিয়ে। এলাকার জলাভূমি বুজিয়ে সেখানে গড়ে উঠেছে ইমারত, বৃক্ক যেমন রক্তকে পরিষ্কার রাখে, তেমনি জলাভূমিও প্রকৃতিতে থাকা দূষক সংগ্রহ করে এলাকাকে দূষণমুক্ত রাখে। তাই তো জলাভূমি প্রকৃতির বৃক্ক, জলাভূমির গুরুত্ব এভাবে ব্যাখ্যা করলে জলাভূমি সংরক্ষণের বদলে বুজিয়ে ফেললে এর সুদূর প্রসারী কুফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা সহজেই বুঝতে পারবে। শিক্ষার্থীরা কোনো নির্দিষ্ট এলাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব আনন্দের সাথে সুন্দরভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম। এ কাজে শিক্ষক অবশ্যই সহায়তা করবেন। খাদ্যসঙ্কটের একটি অন্যতম কারণ হলো অস্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় কৃষিজমির অপ্রতুলতা। ফিল্ড সার্ভে করার সময় শিক্ষার্থীরা এসব জ্ঞান হাতে কলমে অর্জন করতে পারবে। যেহেতু পরিবেশের সাথে মানবস্বাস্থ্যও জড়িত, সেহেতু শিক্ষার্থীরা ফিল্ড সার্ভে করার সময় মনুষ্যসৃষ্ট রোগগুলি সম্পর্কেও জানতে পারে।

বাড়ি থেকে বের হয়ে ছায়াবৃতা উদ্ভিদরাজ্যে প্রবেশ করলেই কোন্ এক মায়াবলে বিষাদের চত্বর হয়ে যায় বিলীন। আমার বাড়িতে দু’দিন সময় হাতে নিয়ে আত্মীয়, বন্ধু- কেউ এলেই একটা Outing এর ব্যবস্থা করা হয়। আর ভোরে উঠে সারাদিনের খাবার তৈরী করে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া- এটাই ছিলো রেওয়াজ। “কি আছে, শুধু গাছ আর গাছ- কিছু দেখার নেই …”- এমন কথা সহযাত্রীদের কাছে শুনেছি অনেক।

পাহাড়ী পথ ধরে চলেছি সোনালী ফার্ণের দেশে, উপরিপাওনা ছিলো খরস্রোতা জলঢাকার কলগর্জন, বিশুদ্ধ বাতাস ও নৈসর্গিক দৃশ্য। সমগ্র যাত্রাপথে ভাবনার ছায়ায় ডোবা মন, আপাত নীরব নিশ্চুপ। পথপার্শ্বে দু’দিকেই চাপড়ামারী অরণ্য, ব্যাকুল দৃষ্টি দূরে সরে সরে যাওয়া গাছগাছালির অন্তরালবর্তিনী বলয়ে, সংশয়- দৃষ্টির অগোচরে কিছু হারিয়ে না যায়! দূর বহুদূর পেরিয়ে সে যাত্রায় দেখা পেয়েছিলাম সে সুন্দরীর – অনিসিয়া অরাটাম, সোনালী ফার্ণ। জিতি- অপূর্ব পাহাড়ী জনপদ। পথের বাঁ-দিকে পাহাড়ের দেওয়ালে ধাপগুলো এমন যেন মনে হয় বই সাজিয়ে রাখা যাবে সেখানে। না, বই নয়, প্রকৃতি নিজ হাতে সাজিয়ে রেখেছে অসাধারণ অভূতপূর্ব সব ফার্ণ, আমি অবাক বিস্ময়ে প্রত্যেকটি ফার্ণ স্পর্শ করলাম, উল্টে দেখলাম অসাধারণ সুন্দর সাজানো স্পোর, আনন্দে নেচে উঠলো মন। প্রকৃতি ও সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে একটা করে নমুনা সংগ্রহ করলাম। ঐ জায়গার নাম দিলাম “ফার্ণ লাইব্রেরী- জিতি।”

এক সময়ে সংগ্রহে ছিলো ৫৮ রকমের ফার্ণ। সব সনাক্তকৃত হয়েছিলো আর ছিলো ৫ টি ব্যাক্তবীজী উদ্ভিদের নমুনা। ব্যাক্তবীজী উদ্ভিদ সদস্যের নাম সাইকাস (Cycas), পাইনাস (Pinus), ট্যাক্সাস (Taxus), থুজা (Thuja) ও জামিয়া (Zamia)। গিঙ্গো বাইলোবার খোঁজ করেছি নিয়ত। শৈল্পিক পাতা। ধবধবে সাদা পেয়ালার কিনারায় সবুজ রঙের গিঙ্গো বাইলোবা (Ginkgo biliba)- র পাতা অঙ্কিত দেখেছি। শুধু ছবি দেখতাম। এতো যাকে চাই, তার দেখা পাবো না, এটা হয় না। পরে NBU – এর বোট্যানিকাল গার্ডেনে একে দেখে ও তার বন্ধু নিটাম (Gnetum) কে দেখে আদর করে তবে শান্তি।
ফার্ণ ও ব্যাক্তবীজী উদ্ভিদ সহ ৬৩ জন সদস্যের হার্বেরিয়ামের ছবি অস্বাভাবিক ক্লান্তি ও সময়াভাবে ছবি তুলে রাখা সম্ভব হয় নি। হার্বেরিয়ামগুলো শিলিগুড়ি কলেজ- সব নিয়ে নিয়েছে।

এবারে উদ্ভিদ নমুনা সংগ্রহশালা বা Herbarium – এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু বলবো।
১) অনেক সময় বইপত্র পড়ে, হাতে আঁকা ছবি দেখে বা বইয়ে উদ্ভিদের ছবি দেখে ফুলের বর্ণ, ফুলের পাপড়ি ও স্তবকগুলোর সজ্জারীতি, পাতার বর্ন-গঠন-পত্রবিন্যাস-শিরাবিন্যাস, কান্ডের আকৃতি, ফলের প্রকৃতি অর্থাৎ উদ্ভিদের সামগ্রিক সঠিক গঠন, তুলনামূলক পাঠগ্রহণ বা সনাক্তকরণ সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে সদ্য সংগৃহীত নমুনা সনাক্ত করতে বা সাদৃশ্য খুঁজতে বিভিন্ন মহাবিদ্যালয়ের, বিশ্ববিদ্যালয়ের বা বনবিভাগের সংগ্রহশালায় রাখা প্রকৃত নমুনা (হার্বেরিয়াম স্পেসিমেন) -এর প্রয়োজন হয়।
২) সংগ্রহশালার বয়স যাই হোক না কেন, সংগ্রহশালায় বহু পুরোনো হার্বেরিয়াম স্পেসিমেন সংরক্ষিত থাকে। এসব নমুনা ভবিষ্যত উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের কাছে বিস্ময় বৈকি। বহু পুরোনো সংরক্ষিত হার্বেরিয়াম স্পেসিমেন থেকে উক্ত উদ্ভিদের প্রাপ্তিস্থানের তৎকালীন পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা জন্মে তাঁদের।গবেষণামূলক কাজের দ্বারা বর্তমানে সেসব উদ্ভিদ সেখানে Endemic Endangered কি না সহজেই বোঝা যেতে পারে। এ থেকে আবহাওয়ার পরিবর্তন, ভূ-প্রকৃতির গঠনে পরিবর্তন ও সামাজিক বিন্যাস সম্পর্কে ধারণা ও প্রমাণসহ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।
৩) বহুদিন ধরে সংরক্ষিত হার্বেরিয়াম স্পেসিমেন থেকে অজানা প্রজাতি সম্পর্কে আরো খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করে বিজ্ঞানীরা গবেষণামূলক কাজের মাধ্যমে নতুন নতুন অজানা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে ও তা সংযোজন করে ঐ প্রজাতির বিজ্ঞানসম্মত নামকরণ নতুন করে করতে পারেন। এমন উদ্ভিদ আছে যার পূর্বের নাম ছিলো Quercus dilatata (ওক গাছ) যাতে অনেক বৈশিষ্ট্য বা তথ্যের অপ্রতুলতা ছিলো। বর্তমানে পরিমার্জন ও সঙ্গতিপূর্ণ করে এর নাম হয়েছে Quercus floribunda. বেশ কিছু গাছের পরিবারের নামকরণ বিজ্ঞানী Carolus Linnaeus স্বয়ং করে গেছেন যেগুলোকে বিকল্প নাম হিসেবে এখনও চিহ্নিত করা হয়, যেমন : Gramineae, Palmae, Labiatae, Compositae এগুলোর পরিবর্তে যথাক্রমে Poaceae, Arecaceae, Lamiaceae, Asteraceae নামগুলি বর্তমানে ব্যবহার করা হয়। পূর্বের Malvaceae, Bombacaceae, Tiliaceae, Sterculiaceae এই চারটি Bentham & Hooker Classification – এ ছিলো। কিন্তু বর্তমানে APG ।।। Classification এ সবগুলিকে একসাথে নিয়ে একটা পরিবার Malvaceae -র অন্তর্গত করা হয়েছে।

লাইকোপোডিয়ামের কথা বলেছিলাম। আমার অনেক লেখায় এই নরম সুন্দর ফার্ণটির কথা আছে। রঙ্গো থেকে এনেছিলাম লাইকোপোডিয়াম। শ্রেণীকক্ষে মেয়েদের এর ছবি দেখিয়েছিলাম। বড়ো আদুরে এরা। আমার বাড়ির সবচেয়ে ছায়াচ্ছন্ন শীতল কোণে মাটিতে লাগিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন প্রায় দু’বছর বেঁচে ছিলো, আমার ব্যস্ততার দিনে আমার অজান্তেই পশ্চিমের অস্তগামী সূর্যরশ্মীতেই গেল ঝলসে। দিন সাতেক পর শরতের সূচনায় ব্যস্ততা কমলে ওদের যত্ন নিতে পারতাম। তা আর হলো না। সব শেষ হয়ে গেলো। পাহাড়ি পথে যেতে যেতে সেটা সংগ্রহ করেছি। এসব গল্প পড়ানোর ফাঁকে বলা হয়েছে। কারণ- উৎসুক শিক্ষার্থীরা সমবেত কণ্ঠে জানতে চেয়েছে- কোথায় পাওয়া যায় ম্যাম? কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন?

এ এক অন্য সকাল,
এ এক অন্য পথ,
যে পথে কখনো পড়ে নি তোমার পায়ের চিহ্ন।
আজ যাবে নামচির পথে।
অনন্তপ্রসারী পথের দু’ধারে সারি সারি অরোকেরিয়া, ধুপিবন,
অভ্যর্থনার আঙ্গিকে দাঁড়িয়ে সতেজ সবুজ।
আজ এ পথে এঁকে দাও তোমার পদচিহ্ন।

প্রাত্যহিক কর্মব্যস্ততার জীবন,
যানযট-তুচ্ছ ক্লেদ গ্লানি-মান-অভিমান-বেদনা, ঈর্ষা ও অহংকারের দূষণ, ক্লান্তিকর সময় অতিক্রম করে
দু’দন্ড কলহাস্যে দিগন্ত-আকাশ-বাতাস হোক উতরোল।

নিজস্ব বৃত্ত ছেড়ে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে দেখো,
সূর্য থেকে আলো কেমন ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে,
ছড়িয়ে পড়ছে অমল বাতাস,
জীবনের সব রসদই পরিপূর্ণ এখানে।
বনস্থলী ধূপের গন্ধে পবিত্রভূমি।
মন্ত্রপূত রঙ-বেরঙের সার সার ধর্মীয় পতাকা উড়ছে বাতাসে।
রঙীন পোশাকে সজ্জিত,নাকে
কাঁচা সোনার নোলক, পায়ে রূপোর ভারী মল,
গলায় রঙিন পাথরের মালা,
রৌদ্রের আঁচে আর্দ্র কুঞ্চিত ত্বক,
সহজ সরল হাসিমুখ,
অথচ কতো নির্লিপ্ত পাহাড়ি নারী পাকদন্ডী পথ বেয়ে
চলেছে মেঘবাড়ির ঠিকানায়।

ধ্যানগম্ভীর প্রকৃতির রূপ দেখো আর শুধু স্তব্ধ হও।
সমস্ত ইন্দ্রিয় একত্রিত করে
পান করো ধরার এ অমৃতরূপ।

আজই কি আসবে ফিরে,
চড়াই উৎরাই ভেঙে সমতলে, চা- বাগান, ছায়া গাছ, অরণ্য ঘেঁষা পড়ন্ত বিকেলের ঝিমধরা আলোয় ?

না হয় একরাত থেকে যাও,
টুপ্ করে জ্বলে ওঠা সন্ধ্যাতারা আর
বনজোছনার সাথে পরিচিত হতে।
তোমার উপস্থিতিতে বনস্থলী শনশন হাওয়া, অতলতম খাদে ছলছল ঝর্ণা,
কুলকুল শব্দে এঁকে বেঁকে বয়ে চলা শীর্ণ জলধারা,
ঝরঝর পাতাঝরা শব্দে মাতোয়ারা।

স্মৃতি হিসেবে নিয়ে এসো
সেখানকার মাটিসহ
অন্ততঃ একটি চারাগাছ,
স্থান দিও তাকে টবে বা উঠোনের এক কোনে,
সে হোক না সেলাজিনেল্লা,
লাইকোপোডিয়াম বা
অনিসিয়া অরাটাম।

এ ফুল লতা পাতার কৌলীন্য নেই সুগন্ধে বা রূপে। ফুলের জলসায় ব্রাত্য হলেও ভালোবাসার চোখ মন প্রাণ দিয়ে এ প্রকৃতির দানকে দেখলে দেখা যাবে সব মিলিয়ে আঙ্গিক সৌন্দর্য এদের কিছু কম নয়। দেবতার পুজোয়, প্রিয়জনকে উপহার দিতে এদের দিকে কেউ হাত বাড়ায় না। তবে প্রত্যেকটি লতা পাতারই কম বেশী ভেষজগুণ আছে।নির্লিপ্তভাবে নিজ নিজ কর্ম সম্পাদনেই যেন এরা বিকশিত হয়। শিক্ষকের এ কথাগুলোই গেঁথে যাবে শিক্ষার্থীদের কোমল মনে।

হারবেরিয়াম নিয়ে আমার লেখা আরও একটি কবিতা দিয়ে শেষ করবো আজকের পর্ব—

টুপটাপ ঝরে পড়া বৃষ্টি, বালিঝড় সাইক্লোন ছাঁট—
সব ছুঁয়ে সকাল বেলা খুলে দিলো দরজাটা হাট।

নীল নীল আকাশটা ডুব, মেঘে মেঘে চন্দনী ঢেউ,
শুনশান ভরদুপুরে অফিস কক্ষেতে নেই কেউ।

এই আমি অ্যাডহেসিভ হাতে, মরা ডাল নিষ্প্রভ ফুল,
বছর দশেক আগেকার ছন্দের গানে মন আকুল।

প্রযুক্তি ঠাসা নিরালায় দুধ সাদা পাতার দেয়ালে
গাছেদের প্রাণহীন শাখা বাঁধা পড়ে স্বপ্নের জালে।

কোথা ছিলে কোথা এলে বলো, কার হাত ঘুরে কার হাতে?
পাখিরা কি ছুঁয়েছিলো ঠোঁট, মরমীয়া সেই ঠিকানাতে?

সইতে না পেরে ফলভার, টুক করে কোথা যে পালালি!
জোর করে ছিঁড়ে নিলে ফুল বেজে ওঠে ব্যথার গীতালি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *