পিতৃপক্ষ ✒️✒️ সুনৃতা রায় চৌধুরী ©

পিতৃপক্ষ
সুনৃতা রায় চৌধুরী ©

পুরোহিত মশাই বললেন,” দক্ষিণ দিকে মুখ করুন।”
আবক্ষ জলে দাঁড়িয়ে আছি আমি। অঞ্জলিতে ধরা কুশি, তাতে তিলোদক। পুরোহিত বলে চলেছেন, “এদিকে ষোলো বার, ওদিকে বারো বার….”! আরো কত কিছু। যন্ত্রচালিতের মতো করে চলেছি। তাড়া দিচ্ছেন তিনি। ঘাটে থিকথিকে ভীড়। আমাকে ছেড়ে আরেকজনকে ধরবেন।
বাবা, তুমি কি তুষ্ট হয়েছ?, তুমি, তোমার পিতৃপিতামহ, তাঁদেরও পূর্ব পুরুষেরা ওই সামান্য তিল জলে, অর্থ না বোঝা মন্ত্র উচ্চারণে তৃপ্ত হয়েছ?
তোমার মনে আছে বাবা, আমার প্রথম চাকরির প্রথম বারের বেতন পেয়ে তোমার জন্য নিয়ে এসেছিলাম তোমার প্রিয় দোকানের রসগোল্লা। তোমার ছলছলে চোখে কী তৃপ্তির ছাপ দেখেছিলাম সেদিন! আমাদের সব প্রয়োজন, সমস্ত চাহিদা মিটিয়ে তোমার নিজের পছন্দগুলি চাপা পড়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও সেই মিষ্টির দোকানের নাম তোমার গল্পে ফিরে ফিরে আসতো।
পুজোর আগে এই সময়ে অন্যান্যবার তোমার জন্য ধুতি জামা কিনে আনলে খুশি হয়েও বারবার বেহিসেবি না হওয়ার পরামর্শ দিতে। একটু রাগ হতো আমার। কেন পুরোপুরি খুশি করতে পারিনা তোমাকে!
গঙ্গা থেকে ফিরে আসছি যখন, পাড়ায় পাড়ায় লাউডস্পীকারে বাজছে ‘মহিষাসুর মর্দিনী’। যা আগে ছিল আকাশবাণীর বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান। সেই সুরে সুরে ফিরে গেলাম সেই শৈশবে। শেষ রাতে ঘুম থেকে তুলে দিতে তোমার সস্নেহ স্পর্শে। আগের রাতে অনেক উত্তেজনা নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া আমি এক ডাকে উঠেই মুখেচোখে জল দিয়ে দাঁত মেজে তৈরি হয়ে রেডিওর সামনে হাজির। সেই ভোরে মা ধূপধুনো জ্বালাতেন, বাগান থেকে ভেসে আসতো শিউলির গন্ধ। ভোরের শিরশিরে হাওয়ায় ঐ দুই গন্ধ মিশে, সংস্কৃত স্তোত্র পাঠে একটা পবিত্র পরিবেশ রচিত হতো। কেমন পুজো পুজো ভাব। শুনতে শুনতে কখন যেন চোখে আবার ঘুম জড়িয়ে আসতো, আবার সজাগ হয়ে উঠতাম যখন, তখন চলছে, ” রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।”
সেই গমগমে আওয়াজের রেডিওর দিন চলে গেছে সেই কবেই। ট্র্যানজিসটার এসেছে তার জায়গা দখল করতে। এখন তো সোশাল মিডিয়া সবাইকে সজাগ করে দেয় আর পাড়ায় পাড়ায় পুজো মণ্ডপে বেজে চলেছে তাবৎ বাঙালির আবেগের সুর।
সব কিছু আছে, নেই শুধু তোমার স্পর্শ, ধুনোর গন্ধও আর পাইনা। বাগানের শিউলি গাছটা বুড়ো হয়েছে, ফুল হয়ে এসেছে ছোট ছোট। তবুও ফুল ফুটিয়ে চলেছে হাসিমুখে। তাতে যেন মায়ের হাসি দেখতে পাই।
মা তো চলে গেছেন কবে! তোমার দুহাত দিয়ে তখন আগলে রেখেছিলে আমায়। ভোলাতে চেয়েছিলে মাতৃশোক। তার পর সেই দুটো হাতও মাথার ওপর থেকে সরে গেল। প্রখর রোদে বাদলে ছাতা ধরার মতো কেউ রইলো না। পড়ে রইলো তোমার প্রিয় ইজিচেয়ার, তোমার ব্যবহারের রূপো বাঁধানো লাঠি, ঘড়ি, স্টেনলেস স্টীলের ঝকঝকে পানের ডিবে, চিরতার জল খাওয়ার শ্বেত পাথরের গেলাস।
সব জাগতিক প্রয়োজন তোমার ফুরিয়ে গেছে বাবা। আজ পিতৃপক্ষের অবসানে মহালয়ার পুণ্য লগ্নে গঙ্গা বক্ষে সহস্র জনতার ভীড়ের মাঝে তর্পণে নয়, সারাদিনে প্রতি মুহূর্তে একান্ত স্মৃতিতর্পণে তৃপ্ত হও তুমি। ফিরে যাও সেই স্বর্গলোকে, যেখানে তোমার বাস। তোমার আশীর্বাদ ঝরে পড়ুক আমার ওপর তারায় তারায়, বৃষ্টি ধারায়, সদ্য ফোটা ফুলে, ভোরের হাওয়ায়,সোনা রোদে।
আজ পিতৃপক্ষের শেষ, আগামীকাল দেবীপক্ষের শুরু। সবাই মেতে উঠবে উৎসবে। আমি আবার একটি বছর অপেক্ষা করবো আরেকটি পিতৃপক্ষের জন্য।

কলমে -সুনৃতা রায় চৌধুরী ©
ছবি – সায়ন্তন ধর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *