অবস্থান্তর ✒️✒️ মৃত্যুঞ্জয় রায়চৌধুরী
অবস্থান্তর
মৃত্যুঞ্জয় রায়চৌধুরী
দু’দিনে দুটো দেওয়াল ঘড়ি ভেঙে ফেললাম। মাথায় হাত। মাথায় হাত এইজন্য নয় যে দুটো দামী ঘড়ি ভেঙে ফেললাম বলে। আসলে পরপর দু’দিনে দুটো ঘড়ি ভাঙাটা নাকি গিন্নির মনে জমে থাকা নানা প্রশ্নের সমাধান করেছে।
এখন বাড়িতে তো দুজন মানুষ। ডাক্তার একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল, বউদির সঙ্গে ঘরের কাজ ও একটু আধটু করবেন। মনে মনে বললাম আপনি তো এই চেয়ারে বসে ই সারাদিন এ চেম্বার ও চেম্বার করে কাটিয়ে দিচ্ছেন। ঘরের তো কাজ করতে হয় না, তাও এই বয়সে নারুগোপালের মতো চেহারাটা রাখেন কি করে? কিন্তু পাশে বসে থাকা গিন্নির কাছে কথাটা খুব মনে লেগেছে। ‘ আমি বললে তো ঝগড়া করতে আসো। লোকের কাছে বলে বেড়াও আমি নাকি তোমার ঘরে বসে থাকা নিয়ে খোঁটা দিই। এখন মানছতো, তোমার ভালোর জন্যই বলতাম। ঠিক আছে বাজারটা নাহয় আগেও আমি করতাম এখনও ওটা আমার কাছে থাক। ওসব টাকা পয়সার ব্যাপার তুমি গুলিয়ে ফেলবে। তার থেকে ঘরের কাজ করো।’
সেদিন থেকে কোনো কথা না বলে ঘরের কাজ শুরু করে দিলাম। মনে মনে মেনে নিলাম, পাগলা মনডারে ছাগলের দড়ি দিয়ে বাঁধার সময় হয়ে গেল। দেখলাম এতে বাড়ীর কাজের মেয়ে মিনুর পয়া বারো হলো। সে খুব খুশি। ‘ কাকুর হাতেপায়ে জোরটা ঠিক থাকবে, খুব ভালো করেছ কাকীমা। আর আমি ঐ সময়ে তোমার হাত পা গুলো টিপে দেবে। তুমি বলছিলে না, বাতে তোমার হাত পা চলে না। দেখবে কেমন আরাম পাবে। একদম গড়গড় করে চলবে। কেবল সিনেমা দেখতে মাঝে মাঝে কটা টাকা দিও তাহলেই হবে।’
সংসারে এই নুতন ইকোয়েশন কার পক্ষে গেল আর ভাবার সময় নেই।এক ডাক্তার আমাকে কাৎ করে দিল। যাহোক টুকটাক কাজ করে দিনগুলো বেশ কেটে যাচ্ছিল। সকাল হলে শরীরটাকে সচল রাখতে হবে এই ভেবে কাজ খুঁজে বেড়াই।একদিন শোবার ঘরের দেয়াল ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেল অর্থাৎ ব্যাটারি খতম। কাজটা নুতন, আগে ছেলের খবরদারিতে থাকত ঘড়ি গুলো। প্রায় প্রতি ঘরে একটা করে দেওয়াল ঘড়ি। ঘুম থেকে উঠে অভ্যাস মতো সবে চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবছি,’ কি হলো আটটা বাজে! এত দেরি হয়ে গেল আজকে!’
—- ঘড়ি টা অতক্ষণ ধরে দেখার কিছু নেই। ওটার ব্যাটারি পাল্টাতে হবে। তুমি কি পারবে, না হলে মিনুকে বলবখন।
সুতরাং চ্যালেঞ্জ নিতে হবে, এখনো সমান কর্মঠ আছি তার প্রমাণ করতে হবে। মিনু পারবে আর আমি পারব না। সুতরাং হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। ব্রেকফাস্ট করে কাজে লেগে গেলাম।
কিন্তু চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে হাত বাড়িয়েছি কি ‘ওরে বাবা ‘, পাটা যেন কেঁপে উঠলো। তৎক্ষণাৎ নেমে এক ঢোক জল খেয়ে গুন গুন করে একটা গান গাইতে গাইতে পুরো ব্যাপারটা মাথায় নিয়ে এবার ঘড়ির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। একদম ফিট। নো পা কাঁপা। কিন্তু ঘড়ি টা খুলে হাতে নিতেই চেয়ারের পায়ার শব্দ কানে এলো ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্। এই বয়সে পড়ে গেলেই নিপাতন হয়ে যাব । নিপাতন আমার বাগান পরিষ্কার করত। গাছ থেকে পড়ে কোমর ভেঙেছে। এখন অদ্ভুত ভাবে লাঠি নিয়ে ল্যঙরাতে ল্যাঙরাতে হাঁটে।ওর ছবিটা মনে পড়তেই আত্মরক্ষার জন্য হাত দুটো ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি বেঁচে গেলাম কিন্তু অতবড় ঘড়িটা সশব্দে মাটিতে পড়ে খান খান হয়ে গেল।
—- বীরপুরুষ! ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর কি হবে? এ্যাই মিনু চেয়ারটা ধর। দয়া করে আর চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে আমাকে বিপাকে ফেলো না।
কেমন মিউ মিউ করতে করতে ফিরে এলাম। কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
পরের দিন ঘরের ঝুল ঝাড়ার ইচ্ছে হলো। খুব সাবধানে ঝুলঝাড়ু দিয়ে ঝুলগুলো পাকিয়ে পাকিয়ে নামিয়ে আনছিলাম। গিন্নি কোমরে হাত দিয়ে জরিপ করে বলল, “ঠিক আছে, তাহলে পাশের ঘরটাও করে ফেলো। খুব গদগদ হয়ে বললাম,’ মিনুকে এককাপ চা ফরমাস কর তাহলে ‘।
অতঃপর চা খেয়ে খুব ফুর্তি নিয়ে অন্য ঘরে কাজ শুরু করলাম । দেওয়ালে টানানো টিউব লাইট, পিকচার গুলো সামলে ঘড়ির কাছে আসতেই সাবধান হয়ে গেলাম, কারণ গতকালের ঘটনা। ভেবেচিন্তে ঝুল ঝাড়ুটা সবে ঘড়িতে ঠেকিয়েছি অমনি পকেটে ফোন তারস্বরে চিৎকার করে বেজে উঠলো। চমকে একহাতে পকেট থেকে ফোন টা সবে বের করেছি ফোনটা হাত থেকে পিছলে গেল। ঝুঁকে দু হাত দিয়ে ফোনটা ধরে ফেললাম কিন্তু আবার প্রচন্ড শব্দ। দেখি ঘরঝাড়ুর খোঁচা খেয়ে ঘড়ি টা দেওয়াল থেকে মেঝেতে পড়ে খান খান হয়ে গেছে। আর তৎক্ষণাৎ দুয়ারে হাজির হয়ে কোমরে দুহাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গিন্নি আর তার চোখের ইসারায় ঝাঁটা হাতে হাজির মিনু, যেন ওরা আগে থেকেই জানত এমন হবে।— শোনো, যদি আমি বারণ করতাম, বলতাম ‘ছাড়ো ওসব। বই পড়া, টিভি দেখা নিয়েই থাকো’ মানতে না, রাগ করতে। আমার ও মনে হতো, হয়তো আমি ঠিক করছি না।সারা জীবন অফিস আর বাড়ি করেছ , সংসারের খোঁজ রাখনি। এখন কি নুতন করে কিছু হয়? তার উপর বয়স হয়েছে সেটা বুঝলে তো? দুটো ঘড়ি ভাঙাটা এমন কিছু বেশি না, নিজের অবস্থাটা একটু বোঝো। তুমি আর আগের মতো নেই।
সেই প্রথম বুঝলাম যে আমি আর আগের মতো নেই। সংসারে থেকে নিজে বুঝতে পারলে ভালো, নাহলে কেউ তোমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে ছাড়বে যে ‘তোমার এখন কাঁঠালের পাতা চিবিয়ে খাওয়ার সময়, সেটি ই মন দিয়ে খাও।’