জীবনবিজ্ঞান সংক্রান্ত কিছু কথা— পর্ব- ৩ ডরোথী দাশ বিশ্বাস
জীবনবিজ্ঞান সংক্রান্ত কিছু কথা— পর্ব- ৩
ডরোথী দাশ বিশ্বাস
শিক্ষার উদ্দেশ্য নির্ণীত হয় সামাজিক চাহিদা ও ব্যক্তিগত চাহিদার প্রেক্ষিতে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা হল শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা। জীবনবিজ্ঞান শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল সমাজের ও শিশুর চাহিদার পরিপূর্ণতা লাভ করা, নিজেকে জানা, নিজের গঠনতন্ত্রকে জানা ও সবশেষে চরম সত্যে উপনীত হওয়া।
পথচলতি এক পুরোণো ছাত্রীর সাথে দেখা হলো। সেই হাসি মুখ। বিয়ে হয়ে গেছে, একটা ছোট্ট ছেলে তার। মায়ের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে চলেছে। ছেলেকে দেখিয়ে বললো, ‘দিদিমণি, ওর আলুসিদ্ধ ভাত ওর প্রিয় খাদ্য। আপনি বলেছিলেন না— আলুসিদ্ধ ভাতও সুষম খাদ্য। এটা মনে করে ‘ও অন্য কিছু খেতে না চাইলেও’ আমার মন খারাপ হয় না। যখন বড় হবে তখন নিজেই অন্য কিছু খেতে চাইবে।
মনে পড়ে, নবম শ্রেনীতে পুষ্টি বিপাক পরিপাকের অংশটুকু পড়াতে গিয়ে আমি ক্লাসে জিজ্ঞেস করে নিতাম কে কি খেয়ে এসেছে আজ— অধিকাংশই আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের ছাত্রী। ওরা প্রথমে লজ্জা পেতো বলতে। তারপর একটু জোর করলেই বলতো— বেশিরভাগের উত্তর হলো— পান্তা বা আলুসিদ্ধ ভাত। তো লজ্জার কি আছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া ছাত্রীদের কারো বাড়িতেই রেফ্রিজারেটরের কোনো গল্প নেই। তাদের বাবা কেউ রিক্সাচালক, টোটোচালক, ভিনরাজ্যের শ্রমিক বা রাজমিস্ত্রীর যোগালি। মা- হয়তো বাসাবাড়িতে কাজ করে, বা মেসে রান্না করে। সকালে রান্নার পাট নেই। রাতে বেঁচে যাওয়া ভাতে জল ঢেলে পান্তা করে রাখে। ওটাই লবন, সরষের তেল, লেবুপাতা, কাঁচা লঙ্কা ও পেঁয়াজ দিয়ে খেয়ে যে যার গন্তব্যে যায়। পান্তা খেলে ঘুম পায়। পান্তা খেয়ে স্কুলে এসে ক্লাসে ঘুমিয়ে যেতে দেখেছি মেয়েদের। জীবনবিজ্ঞান শিক্ষিকা হিসেবে দায় থেকে যায় পান্তার উপকারিতা বা অপকারিতা জানার বা জানাবার।
পান্তা ভাতে কি আছে দেখে নিই—
কথায় আছে— “পান্তাভাতের জল, তিন পুরুষের বল।” সকালে পান্তা খেয়ে কাজে বের হলে সারাদিনের কর্মশক্তির ঘাটতি হবে না। এ খাবার মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধ। এতে বিশেষ করে ঢেঁকি ছাঁটা চালের পান্তায় আছে ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম (সাধারণ ভাতের তুলনায় প্রায় ৪০ গুণ বেশি), ম্যাগনেসিয়াম (এনজাইম সক্রিয়কারক), লৌহ (সাধারণ ভাতের তুলনায় প্রায় ২১ গুণ বেশি, যা রক্তাল্পতা কমায়), জিঙ্ক, ভিটামিন বি-৬, বি-১২ প্রভৃতি। এতে ল্যাকটিক অ্যাসিড সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া প্রচুর পরিমাণে থাকে, তাই এটি প্রোবায়োটিকসমৃদ্ধ, অন্ত্রবান্ধব খাবার যা গ্যাসট্রিক আলসার হতে দেয়না, এবং হলেও নিরাময়ে সাহায্য করে। ভাতে উপস্থিত অ্যান্টিনিউট্রিশনাল ফ্যাক্টর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টগুলিকে বেঁধে রাখে, ফলে শরীর ভাতের থেকে সেগুলো গ্রহণ করতে পারে না। পান্তাভাতে ভাতের অ্যান্টিনিউট্রিশনাল ফ্যাক্টর ক্ষয়ীভূত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে পান্তাভাত থেকে শরীর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টগুলি গ্রহণ করতে পারে। ভাত জলে ভিজিয়ে পান্তা করা হয় বলে ভাত বাতাসের অক্সিজেনের স্পর্শে আসে না, অক্সিডাইজ্ড হয় না। তাই গেঁজে ওঠা ব্যাপারটা অর্থাৎ আনএয়ারোবিক ফারমেন্টেশনটা সুন্দর হয়। এর ফলে কার্বোহাইড্রেট ভেঙে তা সহজপাচ্য হয়ে ওঠে। তাহলে কি দেখলাম? পান্তাভাত সহজে হজম হয়। নিয়মিত পান্তা খেলে হজম শক্তি বাড়ে।
পান্তাতে বিটাসিস্টোস্টেরল, কেম্পেস্টেরল, আইসোর-হ্যামনেটিন-৭-গ্লুকোসাইড ফ্ল্যাভোনয়েড- নামক মেটাবোলাইটস্ থাকে। প্রথম দুটো প্রদাহ উপশমকারী, তৃতীয়টি ক্যান্সার প্রতিরোধকারী উপাদান।
পান্তা সম্পর্কে আর একটা সন্দেহ মানুষের মনে জাগে। তা হল: পান্তা খেলে কি শরীরের ওজন বাড়ে? কখনোই না। এটি ওজনহ্রাসকারী। গরম ভাতে যে পরিমাণ ফ্যাট থাকে সমপরিমাণ পান্তাভাতে ফ্যাটের পরিমাণ তার ৬ ভাগের একভাগ। তবে উচ্চ ক্যালোরিসমৃদ্ধ। প্রচুর জল থাকায় শরীরে জলসাম্য বজায় রাখে, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাইতো এ কম খরচের খাদ্যটি ক্লান্তিনাশক, সানস্ট্রোকরোধকারী, কোলাজেন বৃদ্ধিতে, দুর্বলতা নিরাময়ে, অনাক্রম্যতা বৃদ্ধিতে, ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্যরক্ষায় ভীষণ উপযোগী। তবে ডায়াবেটিক, ওবেসিটি ও বয়স্ক মানুষের জন্য এ খাবার নয়। এখন তো শহুরে মানুষও শখে পান্তা খায়, নববর্ষে পান্তা খাবার চল হয়েছে। ইলিশ মাছ ভাজা, মুসুর ডালের বড়া, অন্যান্য পদ সহযোগে পান্তা পরিবেশিত হলে পান্তার পুষ্টিগুণ বাড়ে।
শিক্ষক-অভিভাবকের সভায় অনেক মা-কেই বলতে শুনেছি— ‘কি করবো দিদিমণি, তেমন তো আয় নেই, ভিটামিন খাওয়াতে পারি না। ব্রেন হবে কোথা থেকে। পড়ে কিন্তু মনে রাখতে পারে না।’
ভিটামিন বলতে এঁরা মাছ মাংস ডিম- কেই বোঝান। জীবনবিজ্ঞান শিক্ষকের দায়িত্ব বেড়ে যায় তখন। যাদের মাছ মাংস ডিম কেনার পয়সা নেই, তাদের জন্য প্রাতরাশে পান্তা একটা আশ্চর্যজনক খাদ্য। এটি আয়রন, পটাসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। এটি ভিটামিন বি৬ এবং বি ১২ ভিটামিনের উৎস। এই খাদ্যটি তারুণ্য এবং উজ্জ্বল চেহারা ধরে রাখতে সহায়তা করে!— এটুকু বললে ‘পান্তা’- গরীবের এই প্রচলিত খাদ্যটি গুরুত্ব পায়। ঠিক সেরকমই—
এবারে আসি আলুসিদ্ধ ভাতের গল্পে। ভাত কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার সমৃদ্ধ, ভিটামিন বি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভালো উৎস। পরিমাণমতো ভাত রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। আলু মাখবে সরষের তেল, লবণ, পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা দিয়ে। এবারে জেনে নিই আলু সরষের তেল, পেঁয়াজ, লঙ্কা, লবণে কি কি খাদ্যগুণ আছে?
আলু কার্বোহাইড্রেট (যা প্রোটিন বাঁচোয়া খাদ্য), অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধ। এছাড়াও আলু থেকে পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, আয়োডিন, আয়রন এবং জিঙ্কের মতো খনিজগুলি পেয়ে থাকি। সরিষার তেল ওমেগা ৩, ৬; ফ্যাটি অ্যাসিড এবং এম ইউ এফ এ সমৃদ্ধ। এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল) কমাতে এবং ভাল কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বাড়াতে সাহায্য করে যার ফলে হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে এবং ধমনীতে প্লাক তৈরিতে বাধা দেয়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
স্নায়ু ও পেশীর কাজ ঠিক রাখতে ও শরীরের তরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে লবণ। পেঁয়াজ বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি সরবরাহ করে, বিশেষ করে ভিটামিন সি, ভিটামিন বি৬, ফোলেট, পটাসিয়াম এবং ম্যাঙ্গানিজ। এছাড়াও পেঁয়াজ খাওয়ার সময় সামান্য ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, দস্তা, তামা, সেলেনিয়াম, কোলিন এবং অন্যান্য ভিটামিন এবং খনিজও আমরা পেয়ে থাকি। কাঁচা লঙ্কার মধ্যে ক্যালসিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক এবং কপারের মতো খনিজও যেমন রয়েছে তেমনই রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি, এছাড়া ভিটামিন এ এবং ভিটামিন বি এর মতো ভিটামিনও রয়েছে।
ক্লাস নিতে নিতে শিক্ষক নিশ্চয়ই লক্ষ্য করবেন যে এরা কি মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনছে! শুনবেই তো, এসব যে তাদের জীবন থেকে নেওয়া, দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধের অঙ্গ।
খাবারদাবারের গল্প করে হোক না একটা ক্লাস নষ্ট, তবু তো এ সারা জীবনের পাঠ হয়ে থাকবে!
ছাত্রীদের পরিবারে বড়োদের থেকে অনেকেই শুনতে অভ্যস্ত, ‘এর ব্রেন নেই’। কথাটি শুনতে খুব নিরীহ মনে হলেও এর সুদূরপ্রসারী ফল মারাত্মক। আত্মবিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিতে এই কথাটির জুড়ি নেই। জীবনবিজ্ঞান শিক্ষকের দায়িত্ব— প্রথমেই এই আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেওয়া। তোমার হাত পা চোখ মুখ নাক কান আছে। এগুলি আমরা দেখতে পাই। লিভার কিডনি হার্ট মন সব আছে। এদের কার্যকারিতা আছে। এগুলি দেখতে পাই না। অনুভব করি। তেমনি বুদ্ধি, চেতনা, স্মরণশক্তি, সব আছে। কেউ খারাপ কথা বললে মন খারাপ হয়, কেউ বকলে কষ্ট হয়, কেঁদে ফেলি। আনন্দে চিৎকার করি, লাফালাফি করি, খুশিতে হাসি। এ সবই বোধ। আর এই বোধের জন্ম মস্তিষ্কে। মস্তিষ্ক খুব সুরক্ষিত করোটি নামক হাড়ের বাক্সে। বাইরে থেকে মস্তিষ্ক বা ব্রেন দেখতে পাই না। তাই বলে বলে দেবো— ব্রেন নেই?
জীবনবিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় হামেশাই। এই বিষয়টির ভিতরেই নিহিত আছে এরকম হাজারো প্রশ্নের উত্তর। সেই উত্তর যথাযথ পেলে বা শারীরবৃত্তীয়সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশ্নের যথাযথ উত্তর বা ব্যাখ্যাই পারে শিক্ষার্থীর যাপনপ্রণালীতে বা জীবনশৈলিতে সঠিক ও ফলদায়ক পরিবর্তন আনতে। জীবনবিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ভিতর শুধু আচরণগত পরিবর্তনই নয়, সামগ্রিক পরিবর্তন আনা, তাদের জীবনসংক্রান্ত বিষয়ে জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলনই জীবনবিজ্ঞান শিক্ষার উদ্দেশ্য, আর এই উদ্দেশ্যগুলিকে ব্যাপক প্রেক্ষাপটে খুব সাধারণভাবে উল্লেখ করলে তাকে লক্ষ্য বলে।
জীবনবিজ্ঞান শিক্ষার উদ্দেশ্যকে প্রথমতঃ দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য ও স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্য।
১। দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য হল যে উদ্দেশ্য পরোক্ষভাবে দীর্ঘদিন শিক্ষালাভের মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চার দ্বারা সিদ্ধ হয়। উদাহরণ: আগ্রহ, দৃষ্টিভঙ্গী, প্রশংসা, দক্ষতা, অবসর বিনোদনের জন্য নিজেকে তৈরি করা ইত্যাদি। দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্যকেই প্রকৃত অর্থে শিক্ষার লক্ষ্য বলে।
ক) আগ্রহ সৃষ্টিকারী উদ্দেশ্য: জীবনবিজ্ঞান শিক্ষার একটি উদ্দেশ্য হল: জীবজগৎ সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করা। এটি সময়সাপেক্ষ কাজ। তবে শিশুর চাহিদার উপযুক্ত পাঠক্রমের মাধ্যমে উন্নত শিক্ষণপদ্ধতির সাহায্যে ও মূল্যায়ণের বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করলে শিক্ষার্থীর ভিতর দ্রুত আগ্রহ সৃষ্টি করা যায়। আগ্রহ সৃষ্টি হলে শিক্ষার্থী ১) বিজ্ঞানধর্মী সাহিত্য পড়বে, ২) বিজ্ঞানের ছবি আঁকবে, ৩) মডেল তৈরি করবে, ৪) নমুনা সংগ্রহ করবে, ৫) বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে জানতে জীবনী পাঠ করবে, ৬) বিজ্ঞানমূলক বিতর্কে ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করবে, ৭) বিজ্ঞানমেলা, বিজ্ঞানসমিতি, সামার ক্যাম্প, নেচার স্টাডি- প্রকৃতিবীক্ষণ শিবির, বিজ্ঞানমূলক প্রদর্শনী- প্রভৃতিতে অংশগ্রহণ করবে, ৮) জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষামূলক ভ্রমণে যাবে।
খ) দক্ষতা: দ্রুত ও নির্ভুলভাবে কাজের অভ্যাসই হল দক্ষতা। জীবনবিজ্ঞানে ব্যবহারিক কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থী দক্ষতা অর্জন করবে। দক্ষতা অর্জন করলে শিক্ষার্থীর আচরণগত পরিবর্তন হয়। তখনই বলা যায়- জীবনবিজ্ঞানের আচরণগত উদ্দেশ্য বর্তমান।
আচরণগত উদ্দেশ্য: শিক্ষার্থী দক্ষতা সহকারে ১) পরীক্ষা সম্পাদন ও পরীক্ষালব্ধ ফলের সংব্যাখ্যান করতে পারবে। পরীক্ষালব্ধ ফলকে যথাযথভাবে গ্রাফ ও গণনার সাহায্যে লিপিবদ্ধ করতে পারে। ২) প্রয়োজনীয় অঙ্কণ যেমন: ব্যাপন বা অভিস্রবন সম্পর্কিত উপস্থাপিত পরীক্ষা ব্যবস্থার যথাসম্ভব নিখুঁত পরিষ্কার নির্দেশিত চিত্র আঁকতে পারবে, সংগৃহীত তথ্যকে চার্টের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারবে, ছবি তুলতে পারবে। ৩) যন্ত্রপাতি নির্মাণ ও মেরামত করতে পারবে।
গ) প্রশংসা: জীবনবিজ্ঞান শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে জীবনবিজ্ঞানের প্রতি প্রশংসা ও শ্রদ্ধার ভাব জাগানো। শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশংসার মনোভাব গড়ে উঠলে শিক্ষার্থী ১) মানব সভ্যতায় জীবনবিজ্ঞানের অবদান উপলব্ধি করবে। ২) বৈজ্ঞানিকদের কর্মপদ্ধতি ও আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে। ৩) জীবনবিজ্ঞানের অনুশীলণে আনন্দ অনুভব করবে।
ঘ) বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী গঠন: উপযুক্ত পাঠক্রম, উপযুক্ত পরিবেশ, শিক্ষণ পদ্ধতি ও ব্যবহারিক কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে ওঠে। তখন তাদের মধ্যে যে আচরণগত পরিবর্তন দেখা দেয় তা হল: ১) পরিবেশ ও জীবজগৎ সম্পর্কে কৌতূহলী হবে, ২) সত্যের প্রতি আস্থা গড়ে উঠবে, ৩) নতুন আবিষ্কার ও ধারণাকে স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হবে না, ৪) নিজের ভাবনাকে সহজে সংক্ষেপে প্রকাশ করবে, ৫) প্রয়োজনে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে প্রস্তুত থাকবে, ৬) আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভর, সৎ, পরিশ্রমী, অধ্যাবসায়ী, বিনয়ী ও পরমতসহিষ্ণু হবে, ৭) কুসংস্কারমুক্ত উদার দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী হবে।
ঙ) অবসর বিনোদনের শিক্ষা: জীবনবিজ্ঞান অবসর বিনোদনের শিক্ষা দেয়। যেমন: অবসর সময়ে ফুলবাগান করলে মানসিক ক্লান্তি দূর হয়, ফুলবাগান করতে গেলে ফুলের যত্ন জানতে হয় আর এজন্য উদ্ভিদ হরমোন, বীজের অঙ্কুরোদ্গম, শাখা কলম, জোড় কলম, দাবা কলম- প্রভৃতি অঙ্গজ জননের বিভিন্ন প্রকারভেদ সম্পর্কে জানতে হয়, অসম্পূর্ণ প্রকটতা, ইমাসকুলেশন- এসব জানতে হয়। এক কথায়- ফুলবাগান, সব্জীবাগান বা ফলবাগান চা-বাগান করতে গেলে নানা বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বন করতে হয়।
২। স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্য: যে উদ্দেশ্যগুলি রুটিনমাফিক ক্লাসে জীবনবিজ্ঞান পাঠদানের মাধ্যমে সরাসরি রূপায়িত করা সম্ভব। জ্ঞান, বোধ ও প্রয়োগমূলক উদ্দেশ্য হল স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্য।
ক) জ্ঞান: শিক্ষকের কাছ থেকে জেনে, পাঠ্যপুস্তক পড়ে বা পর্যবেক্ষণের দ্বারা শিক্ষার্থী নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান লাভ করবে। যে ছাত্র সালোকসংশ্লেষের সংজ্ঞা মুখস্ত বলতে পারে, মেণ্ডেলের পৃথকভবনের সূত্র বলতে পারে, স্বাধীন সঞ্চারণ সূত্র জানে, প্রকটতার ও অসম্পূর্ণ প্রকটতার বিষয়টি স্মরণে আনতে পারে- তার ঐসব বিষয়ে জ্ঞান হয়েছে বলতে হবে। জীবনবিজ্ঞানের জ্ঞান আহরণের ফলে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য, নীতি, সংজ্ঞা স্মরণ করতে পারবে, বৈজ্ঞানিক নিয়মগুলি সম্পর্কে অবগত থাকবে।
খ) বোধ বা ধারণামূলক উদ্দেশ্য: উপলব্ধি মানসিক প্রক্রিয়ার একটি উন্নততর স্তর। শিক্ষার্থী তখনই কোনো বিষয়কে উপলব্ধি করবে যখন সে বিভিন্ন তথ্যগুলির মধ্যে একটা সম্পর্ক খুঁজে পায়, তথ্যগুলিকে কোনো নিয়ম বা সূত্রের সাথে যুক্ত করতে পারে। উপলব্ধি আসে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য বা জ্ঞান থেকে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে আচরণগত পরিবর্তন আসে সেগুলি হল: ১) শিক্ষার্থী দুটি তথ্যের বা জ্ঞানের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য নির্ণয় করতে পারবে। যেমন: অযৌন জনন ও যৌন জননের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবে, স্ব-পরাগযোগ ও ইতরপরাগযোগের মধ্যে বৈসাদৃশ্য নির্ণয় করতে পারবে, সংযোগরক্ষাকারী প্রাণীর মধ্যে কোন্ কোন্ পর্বের সাদৃশ্য আছে তা বলতে পারবে। ২) কোন সংজ্ঞা, প্রক্রিয়া, তথ্য পরিবেশনে ত্রুটি নির্ণয় করতে পারবে, ৩) কোন ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারবে। যেমন: ঘরের এক কোণে ধূপকাঠি জ্বালালে ঘরের যে কোন জায়গা থেকে গন্ধ পাওয়া যায় কেন, বা আগের দিন রাতে কিসমিস জলে ভিজিয়ে রাখলে পরদিন সকালে কিসমিস ফুলে আছে দেখা যায় কেন- বা ছোলা বীজ অঙ্কুরিত করার জন্য বীজটিকে কেন জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়— তার কার্যকারণ ব্যাখ্যা করতে পারবে ব্যাপন, অভিস্রবণ বা অঙ্কুরোদ্গমের সংজ্ঞা স্মরণের মাধ্যমে। ৪) ঘটনার সামান্যীকরণ করতে পারবে। যেমন: বাষ্পমোচন, শোষণ অন্তঃ অভিস্রবণ, মূলজ প্রেষ- প্রভৃতি ঘটনার সামান্যীকরণ করে রসের উৎস্রোত সম্বন্ধে জানতে পারবে। ৫) জীবনবিজ্ঞানসংক্রান্ত যে কোনো সূত্রের সত্যতা উপলব্ধি করতে পারবে।
গ) প্রয়োগমূলক উদ্দেশ্য: শিক্ষার্থীকে নতুন পরিস্থিতিতে বা কোন সমস্যা সমাধানে অর্জিত জ্ঞান ও উপলব্ধিকে প্রয়োগ করতে সমর্থ করা জীবনবিজ্ঞানের প্রয়োগমূলক উদ্দেশ্য। এটি উপলব্ধির চেয়ে বেশি উন্নততর মানসিক প্রক্রিয়া। এর ফলে শিক্ষার্থীর মধ্যে যে আচরণগত পরিবর্তন দেখা দেয় তা হল: ১) জীবনবিজ্ঞানের জ্ঞান ও উপলব্ধির দ্বারা নতুন নতুন তথ্যাবলী বিশ্লেষণ করতে সমর্থ হবে। যেমন: জীবদেহের ব্যাপনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কঠিন তরল ও গ্যাসীয় পদার্থের ব্যাপন ক্রিয়া বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে। ২) জীবদেহের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলির গুরুত্ব যাচাই করতে পারবে। ৩) সালোকসংশ্লেষে অক্সিজেন সৃষ্টির পরীক্ষার সবচেয়ে উপযোগী পদ্ধতি নির্বাচন করতে পারবে। ৪) প্রশ্নের মাধ্যমে নতুন নতুন সমস্যা সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে বা তুলে ধরতে সমর্থ হবে।
✍️ডরোথী দাশ বিশ্বাস