#নজরুল সাহিত্যে নারী ও তাঁর ভাবাদর্শন ✍️মমতা শঙ্কর সিনহা(পালধী)
#নজরুল সাহিত্যে নারী ও তাঁর ভাবাদর্শন
✍️মমতা শঙ্কর সিনহা(পালধী)
“মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি,
আর হাতে রণ তুর্য”[কবিতা-:বিদ্রোহী]
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমন এক হাতে তুলে নিয়েছিলেন সুমধুর বাঁশের বাঁশি,তেমনি অন্য হাতে কলমের রর্ণ তুর্যের ঝরনা ধারায় সমাজে সৃষ্টি করেছিলেন এক প্রবল আলোড়ন।
নারীর বঞ্চনা,লাঞ্ছনা ও গঞ্জনায় পুরুষ চিরকালই হাসাহাসি করে এসেছে।নারীর প্রেমে কবি হৃদয় রঙিন প্রজাপতির মত দক্ষিণা হাওয়ায় উড়লেও নারীর অপমানে অনেক কবি সাহিত্যিক থেকেছেন নীরব। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে নারী পুরুষের দুটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্ত্বা স্বীকৃতি লাভ করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখের লেখায়।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন-
” নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা?
যাব না বাসর কক্ষে বধু বেশে বাজায় কিঙ্কিনি/আমারে প্রেমের বীর্যে করো অশঙ্কিনী।”[সবলা:মহুয়া]
বিদ্রোহী কবি,দুঃখুমিঞা,নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য বিস্ময়কর প্রতিভার নাম।তিনি একেবারেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাঁর সৃষ্টিকর্মের শৈল্পিক ছোঁয়ায় সাহিত্যের ধারা কখনো উত্তাল সমুদ্রের তরঙ্গে ভীষণরূপে তরঙ্গায়ীত, কখনো আগ্নেয়গিরী ভিসুভিয়াসের অগ্নুউৎপাতের মত উদ্বেলিত, কখনো মৃদু-মন্দ হিন্দোলে দোলায়িত।সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী কাব্য প্রতিভায় পরস্পর বিপরীত ধারার সংমিশ্রণ ও সুসামঞ্জস্যপৈর্ণ পরিস্ফুটনে নজরুল সাহিত্যে নারী দখল করে আছে যুগপৎভাবে এক বাস্তব ও বর্ণিল স্থান।
বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে বাংলা সাহিত্যে গগনে কাজী নজরুল ইসলাম নামের যে দ্বীপ সূর্যের মত সৃষ্টিকর্মের ময়দানে আলো ছড়িয়ে ছিল তার একটি ব্যাপক অংশ জুড়েই রয়েছে নারী।প্রেম-বিরহ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না,বিদ্রোহ-বিপ্লব জীবনের নানা পরতে পরতে অঙ্গাআঙ্গিক জড়িয়ে থাকা নারী যেনো নজরুল সাহিত্যে সমান ভাবে বিজড়িত।তাঁর সাহিত্যে যেমন একদিকে ঝঙ্কৃত হয়েছে বিদ্রোহের ঝনঝনানী তেমনি অপরদিকে নারীকে কেন্দ্র করে তাঁর হাতে বেজে উঠেছে প্রেমের মোহন বাঁশি।কন্যা,জায়া রূপে মানব জীবনে নারীর স্থান যেমন অপরিহার্য তেমনি নজরুল সাহিত্যে নারীর উপস্থিতও অনিবার্য। মানব মুকুরে প্রেয়সী রূপে নারীর ছবি যেমন প্রতিবিম্বত হয় তেমনি জীবনের মানোন্নয়নে ও সমাজ বিপ্লবের সকল ধরায় নারীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি অপরিহার্য এক অনুসঙ্গ হয়ে ওঠে।বোধকরি সে কারনেই যুগপৎভাবে বীর রস,করুণ রস ও প্রেম রসের নারীকে দেখা যায় নজরুল ইসলামের বিভিন্ন সাহিত্যের পাতায় পাতায়।
সমকালীন বাংলা সাহিত্যে ধারার অপর দুই কবি কবিগুরু ও জীবনানন্দ দাশের থেকে খানিকটা ভিন্নরূপে নারীর চরিত্র চিত্রায়িত হয়েছে কবি নজরুলের কাব্য “মনীষায়”।কারন তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানব মনে জগতের যে সুখ-দুঃখ তা কেবল নারী-প্রেম কেন্দ্রিকই নয়,বাস্তব ও সংঘাতপূর্ণও বটে।বিদ্রোহী কবির ভাষায়-
“প্রেমেও আছে গুরু,যুদ্ধও আছে,বিশ্ব এমনই ঠাঁই,
ভালো নাহি লাগে,ভালো ছেলে হয়ে,ছেড়ে যাও মানা নাই।
আমি বলি-গুরু বলো তাহাদের কোন বাতায়ন ফাঁকে,
সজিনার ঠ্যাঙা সজনীর মত হাতছানি দিয়ে ডাকে।”
[কবিতা-:সর্বনাশের ঘন্টা]
রবি ঠাকুর বিধাতার কাছে দাবী করলেন নারীর ভাগ্যকে জয় করার অধিকার। আর কাজী নজরুল ইসলাম এগিয়ে গেলেন আরো এক ধাপ।তিনি বললেন-বিধাতা ভাগ্য জয় করার অধিকার কি দেবেন?অধিকার তো আদায় করতে হবে। নিজেকেই জাগতে হবে সবার আগে।”মায়া মুকুর” কবিতায় কবি লিখছেন-” ভাঙো ভাঙো এই ক্ষুদ্রগন্ডি এই অজ্ঞান ভালো
তোমাকে জাগেন যে মহামানব,তাহারে জাগায় তোলো।”
নারীমুক্তি,নারীস্বাধীনতা ও সমাজে নারীর নিজস্ব মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে নারীকেই। নারী জাগরণের এমন প্রতক্ষ্য আহ্বান ইতিপূর্বে কোন কবির কবিতা,গানে তেমনভাবে হয়নি যেমনটা হয়ছিলো বিদ্রোহী কবির লেখনীর মধ্য দিয়ে।সব আনাচার, অবিচার মুখবুজে সহ্য করতে করতে নারী যেনো মাটির মূর্তিতে পরিণত হয়েছে।কোন প্রতিবাদ নেই,কোন জাগরণ নেই, কোন প্রাণের উদ্বোধন নেই। কিন্তু পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও জাগতে হবে।গাইতে হবে জীবনের জয়গান।ভেঙে দিতে হবে সকল অচলায়তনের প্রাচীর।তাই তো মাটির মূর্তির উপমায় নারীকে জাগতে কবি নজরুল ইসলাম আহ্বান করেছেন তাকে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের চেতনায় জাগ্রত হতে।সে জাগরণের অপেক্ষায় কবি যেনো অপেক্ষারত।
“আর কতকাল থাকবি বেশি মাটির ঢেলার মূর্তি আঁডাল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী চাঁড়াল।
দেব শিশুদের মারছে চাবুক বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা আসবি কখন সর্বনাশী।”
নারী কেনো জাগবে না?এই সমাজ সভ্যতার বুকে উন্নয়নে তার অবদান তো পুরুষের থেকে কোন অংশে কম নয়?তাই তো কবির চোখে নারী পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই।”নারী” কবিতায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাই গেয়েছেন সাম্যের গান।
“সাম্যের গান গাই/আমার চক্ষে পুরুষ নারীর কোন ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”
সমাজে নারীর অবদান সারাজীবনই যেনো রয়েগেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।পুরুষের শাসিত সমাজ কোন কালেই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি নারীর ওদার্য। পুরুষের রক্ত দানের ইতিহাস রচিত হলেও সে ভাবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই মেলেনি নারীর অশ্রুজলের। বোনের সেবার উদারতার হাতের পরশ মিশে গিয়েছে বিজয়ের হর্ষধ্বনির উচ্ছলতায়।তাই বলে কি নীরবে সব কিছুই সয়ে যাবে নারী? তার কি কোন কিছুই বলার নেই?নেই কি কোন প্রতিবাদের ভাষা? এমন তো চলতো পারে না!তাকে যে রুখে দাঁড়তেই হবে সমস্ত প্রতিবন্ধকতার বিরূদ্ধে।ভীরুতাকে দূরে সরিয়ে সমস্ত শিখলের বন্ধন ছিন্ন করে নিজেদের মনের সকল শক্তিকে একত্র করে জয়ী হওয়ার সংকল্পে দৃঢ় হতে হবে।তবে এখানে একটি কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য যে,নজরুলের কাব্যে যে নারীবাদীতার কথা পরিলক্ষিত হয়,তা বর্তমান কালের নারীবাদী মনোভাব থেকে দর্শনগত ভাবে ভিন্ন। এখন যারা নারীবাদীতার কথা/ নারী স্বাধীনতার কথা বলেন তা আদৌ কতটা বাস্তবতার সঙ্গে সাজুয্য তা ভেবে দেখার বিষয় আছে।নারীবাদীতা/নারী স্বাধীনতার কথা বর্তমান সমাজে আধুনিক সময়ের চোরাবালির চোরাস্রোতের মধ্য দিয়ে নারীকে ভোগবাদ, ব্যাভিচারের আরও কি নিমজ্জিত করছে!!!অবশ্যই তা ভেবে দেখতে হবে এবং যে সব বিষয়বস্তু গুলি সত্যিই নারীবাদীতার জন্য প্রযোজ্য তা আবশ্যিক ভাবে সাদরে গ্রহনযোগ্য।
কাজী নজরুল ইসলাম সে কথাটাই বোঝাতে চেয়েছেন তাঁর অমর সৃষ্টি কাব্য ও গানে।তাঁর সাহিত্যাঙ্গনে নারী ও পুরুষ একে অপরের সহযোগী,একে অপরের পরিপূরক,একজন ভিন্ন অন্যজনের চলে না,তবে নারীর নিগৃহীত অবস্থা কোনভাবেই কাম্য নয়,বাঞ্ছনীয় ও গ্রহনযোগ্য নয়।
নারী জাগরণের আহ্বানের পাশাপাশি নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা বর্ণিত হয়েছে কাজী নজরুলের সাহিত্যের শৈল্পিক অঙ্গনে।তাঁর মতে নারী পুরুষ একে অপরের প্রতিদ্বন্দি নয়—তারা একে অপরের সহযোদ্ধা, সহসঙ্গী। তাদের দুজনের সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই মানব সভ্যতা এগিয়ে চলেছে উৎকর্ষতার দিকে।
নারীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে কোন বাছবিচার করেননি কবি।বরং নারীরা যদি তাদের পাপের কারনে কিংবা অনাচারের কারনে কোথাও অপমানিত হয় তার জন্য পুরুষ কম দায়ী নয়।একজন পুরুষের অবহেলা,বিশ্বাসঘাতকতা, অনেক সময় একজন নারীকে বিপথগামী করে তার অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও। যদি যে নারী স্বইচ্ছায় বিপথগামী হয় সেটা অন্য বিষয়।নারীকে সব সময় কেন বিচারের কাঠগোড়ায় দাঁড়াতে হবে? পুরুষ কে কেনো নয়?এমন কি যারা পতিতা তাদের কেও সমাজ একপেশে করে করে লাঞ্ছিত। এক্ষেত্রে পুরুষরা কম দায়ী কিসে?বরং পুরুষেরাও দায়ী।নজরুলের “বারাঙ্গনা” কবিতা তার জলন্ত প্রমাণ। যেখানে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সম্পূর্ণ নতুন দিকের উন্মোচন ঘটেছে।
“কে বলে তোমায় বারাঙ্গনা মা,কে দেয় থুতু ও গায়ে?
হয়তো তোমারে স্তন্য দিয়াছে সীতাসম সতী মায়।
নাই হলে সতী,তবুও তোমরা মাতা-ভগ্নিরই জাতি,
তোমার ছেলে আমাদেরই মতো,আমাদেরই জাতি।
আমাদেরই মতো খ্যাতি যশ মান তারাও লভিতে পারে
তাহাদের সাধনা হানা দিতে পারে সদর স্বর্গ-দ্বারে।
স্বর্গ-বেশ্যা ঘৃতাচী পুত্র হল মহাবীর দ্রোণ
কুমারীর ছেলে বিশ্ব-পূজ্য কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ।
এইভাবেই কাজী সাহেব যুগপৎভাবে নারীর প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন এবং পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও করতে চেয়েছেন সমাজ বদলের অন্যতম অনুঘটক। কেননা পুরুষের চেতনা,মনন জাগাবার জন্য নারীরা পালন করতে পারেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।জনৈক শামসুর নাহারের কাছে ১৯২৬ সালে লেখা
একটি চিঠিতে কবি বলেছিলেন-” আমাদের দেশের মেয়েরা বড্ড হতভাগিনী।কত মেয়েকে দেখলাম প্রতিভা নিয়ে জন্মাতে, কিন্তু সব সম্ভবনা তাদের শুকিয়ে গেলো সমাজের প্রয়োজনীয় দাবিতে।তাই নারীদের বিদ্রোহিনী হতে বলি।” এমনভাবেই বিদ্রোহী কবি নারীদের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন তেজদ্বীপ্ততা,এক অদুর্দমনীয় বহ্নিশিখা,যা ঘুমন্ত পুরুষদের/সমাজকে জাগ্রত করতে সক্ষম। যা ভীত কাপুরুষদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পারে পৌরষত্ব।এমন আশা থেকেই কবি কন্ঠে সুর লহরী লাভ করেছে নারী সাহসের জয় বন্দনা:
” আমি মহা ভারতী শক্তি নারী
———————–
আমি শান্ত উদাসীন মেঘে আনি বর্ষণ বেগ
আমি তড়িৎ লতা,
পারিজাত পৌরুষে জাগায়ে তুলি
দূর করি নিরাশা দূর্বলতা।”
নারী জাগরণ,নারীর অধিকার, নারীর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন নজরুলের কবিতা ও গানকে যেমন আলোড়িত করেছে তেমনি নারী পুরুষের প্রেম -প্রীতি,ভালোবাসা ভালোলাগা,মান-অভিমান, খুনসুটি লাভ করেছে অমর বাণী।বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য রোমান্টিক কবিদের মত নজরুল ইসলামও বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায়েছেন বিধাতার অপরূপ সৃষ্টি নারীর প্রতি।
নারীর সৌন্দর্যের প্রতি নজরুলের যে দুর্নিবার আকর্ষণ, মানব সত্ত্বার গভীরতম স্থানে তার বাস।মানব সত্ত্বার এ বন্ধন দুচ্ছেদ্য,দুর্মর,চিরকালীন। ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত কবি
জন মিলটন তাঁর “প্যারাডাইস লস্ট” বইতে মানব জীবনের পিতা আদমের যে অভিব্যক্তিকে তুলে ধরেছেন সে অভিব্যক্তি শুধু আদমের নয়,কবি মিলটনের নয়,কবি নজরুলেরও নয়–সে অভিব্যক্তি সকল পুরুষের,সকল মানবের।তিনি লিখছেন—–
“O!fariest of creation!last & bast/of all God’s work.
How can I live without thee?
[হে সুন্দরতম সৃষ্টি,সর্বশেষ,সর্বশ্রেষ্ঠ, ঈশ্বরের সৃষ্টি মাঝে/আমি কি করে বাঁচতে পারি বলো তোমায় ছাড়া?]
এখানেই বোঝা যায় কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে নারীর যে অবস্থান তা কতটা সুন্দর,স্বার্থক।
“বিদ্রোহী কবি তুমি–হে কাজী নজরুল ইসলাম—তোমার কলমেই বেজেছিল অগ্নিবীনার অগ্নিবাণ।
শিখিয়ে ছিলে তুমি আপামর জনতারে-“মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম ইন্দু মুসলমান”।
‘ধূমকেতু’ হয়ে ছুটেছো অঙ্গ-বঙ্গ,কলিঙ্গ সহ বাংলাদেশের মাঠ ঘাট দেশ নদী প্রন্তর।
বিদ্রোহী কবি–তোমার কবিতা,গানে উদ্বুদ্ধ হয়ে নব-নবীনের দেহ মনপ্রাণ
তুলেছিল তারা পরাধীন এ দেশে স্বাধীনতার তরে প্রলয় ঝড়।
গরল নাকি তোমার বাঁশির সুর?
সেই বিষের বাঁশির সুর গান হয়ে আজও ঝড়ে পড়ে শিল্পীর গানে–“আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আপনায়।”
সুরের ধারায় -কাব্য,গানে বজ্র যেন ঝলসে ওঠে প্রাবল্যতায়।
তোমার দ্বীপ্ত লেখনী আজও দেশপ্রমের অনুকম্পা জাগায় হৃদয়মাঝে সর্বজনে।
দুঃখু মিঞায়র হৃদপাষাণে,বিদনারি অন্তরালে দুখেরই রূপ নতুন ভোরে–প্রলয় শেষে ক্রান্তি আনে।”
বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিল অনেকটা ধূমকেতুর মত কিংবা অগ্নিদেবতার মতো। তিনি নিজ হাতে বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত প্রথা ভেঙেছেন, আবার নিজ হাতেই গড়েছেন সাহিত্যের নবধারা। তাঁর লেখনীতে একই সাথে বিদ্রোহী ও জাতীয়তাবাদী চেতনার সংমিশ্রণ ঘটেছিল। যার কারণেই তাঁকে বিদ্রোহী কবি ও জাতীয় কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।নজরুলের কবিতা ও গানে বাঙালি জাতীয়তাবোধের যে স্ফুরণ দেখা যায়, তা বিংশ শতাব্দীর অনেক কবির রচনাতেই অনুপস্থিত। বিভিন্ন গল্প ও প্রবন্ধেও তাঁর এই চেতনার ও ভাবনার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলোতে তিনি বিশ্বসমাজে বাঙালির পিছিয়ে থাকা এবং এ থেকে মুক্তির উপায় কী হতে পারে তার বর্ণনা করেছেন। বাঙালির সমাজ, সভ্যতা, রাজনীতি ছিল তাঁর আগ্রহের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি প্রকাশ্যে ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেন। তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকর্মেই বাঙালি জাতীয়তাবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
‘ধূমকেতু’ পত্রিকা সম্পাদনার সময় নজরুল প্রতি সংখ্যার সম্পাদকীয়তে ভারতবর্ষের স্বাধিকার আদায় নিয়ে লিখতেন। তাঁর এই পত্রিকা বাঙালি তরুণ সমাজে স্বাধীনতার স্বপ্ন তৈরিতে কাজ করেছে। ১৯৪৭ এর দেশবিভাগের জন্য সংঘটিত বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নজরুলের লেখনী হয়ে উঠেছে উৎসাহ ও প্রেরণার উৎস। তার লেখনীতে প্রবল জাতীয়তাবোধের প্রকাশ স্বাধীনতাকামী মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও নজরুলের কবিতা ও গান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত নজরুলের দেশাত্মবোধক গান প্রচারিত হতো। স্বাধীনতার পর নজরুল রচিত ‘চল্ চল্ চল্’ গানটিকে বাংলাদেশ সরকার রণসংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। নজরুল ইসলাম ব্যক্তিজীবনে স্বাধীনচেতা একজন মানুষ ছিলেন। তাই তিনি জাতিগতভাবেও স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।
হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি বিশ্বাস করতেন সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতীত স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। তাই সেই বয়সেই তিনি এয়ারগান কিনে হাতের নিশানা ঠিক করার কথা ভেবেছিলেন। নজরুল বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেন। ভাবতেন ভারতবর্ষের সব মানুষের মুক্তির কথা।কাজী নজরুলের বাল্যজীবন, কৈশোরজীবন এমনকি তাঁর পুরো জীবনই ছিল দারিদ্র্যের আঘাতে জর্জরিত। এর মাঝেও তিনি সাহিত্য রচনা করেছেন, গান লিখেছেন, মানুষকে ভাবতে শিখিয়েছেন কি ভাবে সকল প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধ রুক্ষে দাঁড়িয়ে মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করতে হয়। এমন প্রতিকূলতার মাঝেও তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল পরিপূর্ণভাবেই। ধারণা করা হয়, দারিদ্র্য তাঁকে সমাজবাস্তবতার স্বরূপ চিনতে সাহায্য করেছে, যার কল্যাণে তিনি সাহিত্য রচনায় পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। নজরুল নিজেও তার দারিদ্র্যতাকে এভাবে সম্বোধন করেছেন, ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান’। দারিদ্র্যের রূপ দেখার ফলে খুব অল্প বয়সেই নজরুল অনুধাবন করেছিলেন মানুষের মুক্তির কথা। এই ধারণা তাঁকে আরও অগ্রসর করে দেশের স্বাধীনতা আদায়ে।
নজরুল অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বাঙালির এই পিছিয়ে থাকার কারণ তাদের দাসত্ব। ইংরেজদের শাসন বাঙালিকে কীভাবে শক্তিমান, সাহসী জাতি থেকে পরাধীন এক দাসে পরিণত করেছে, তা নজরুল খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করেছিলেন। বাঙালির অর্থনীতির দুর্দশা যে ইংরেজ শাসনেরই ফল এটি বুঝতেও তাঁর খুব বেশি দেরি হয়নি। তাই অল্প বয়স থেকেই ইংরেজদের প্রতি নজরুল ছিলেন প্রতিবাদী। তাঁর বিদ্রোহী কবিতাগুলোর অনেকাংশই ইংরেজদের উদ্দেশ্য করে লেখা। তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এই বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন জাতিগত স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধিকার আদায়ের জন্য।ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের বিশ্বাসঘাতক মনে করত। এ কারণে ইংরেজ সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ দেওয়া হতো না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বিশিষ্ট বাঙালি নাগরিকদের দাবির মুখে ইংরেজ সেনাবাহিনীতে বাঙালি পল্টন খোলা হয়। ১৯১৭ সালে নজরুল সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে যোগদান করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তি বাঙালিদের সাহস ও শৌর্য প্রকাশের সুযোগ হিসেবে মনে করতেন। তাই তিনি শুরু থেকেই প্রবল উৎসাহী ছিলেন সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে। নজরুলের সমগ্রজীবনই ছিল এমন। প্রতি পদক্ষেপে তিনি বাঙালিকে উচ্চাসনে দেখতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি নিজের সর্বোচ্চ শক্তি অর্থাৎ লেখনীর মাধ্যমেই বাঙালির মুক্তির আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন।
✍️মমতা শঙ্কর সিনহা(পালধী)