অগস্ত্য যাত্রা **** মৃত্যুঞ্জয় রায়চৌধুরী

অগস্ত্য যাত্রা
মৃত্যুঞ্জয় রায়চৌধুরী

( এই গল্পটি আসলে বর্তমান পরিস্থিতি উদ্ভুত সমস্যার উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টা। পড়ে মন্তব্য করলে প্রয়াস সার্থক হবে)

রাত আটটা। মুম্বাই এক্সপ্রেস ট্রেনের থ্রি-টিয়ার স্লিপার কামরায় সবাই লোয়ার বার্থে বসে রাতের খাওয়া দাওয়া সারছে। বছর ষাটের একজন বিধবা মহিলা জানলার কাছে গুটিশুটি মেরে বসে আছেন। তাঁর হয়েছে মিডল বার্থ এবং তাঁর ছেলে অমুর আপার বার্থ। অমু একটু বেশি স্মার্ট এবং চলাফেরা আর বেশভূষায় যথেষ্ট কেতাদুরস্ত। লোয়ার বার্থে আছেন একজন সাদা চামড়ার বিদেশি যুবক। হয়তো রিকোয়েস্ট করে মায়ের জন্য লোয়ার বার্থটা ম্যানেজ করতে পারত অমুক, কিন্তু অদ্ভুত একটা আক্রোশ এখনো মনে বাসা বেঁধে আছে সাদা চামড়ার উপর। যারা একদিন ভারতের উপর শোষণ নিপীড়ন করেছে তাদের কাছে হাত পাততে ঘৃণা বোধ হলো অমুর।এরা এখনো কালো মানুষকে ঘৃণা আর অবজ্ঞার চোখে দেখে । সম্প্রতি আমেরিকায় একজন নিগ্রোকে ওখানকার সাদা চামড়ার পুলিশ রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। সুতরাং ওদের কোনো সাহায্যই সে নেবে না। তার থেকে মা নাহয় একটু কষ্ট করে যাবে, এমন কষ্ট জীবনে মা অনেক পেয়েছেন।সে জানে ট্রেনের খাবারও মা খাবে না। আর এমন নাখেয়ে থাকা আর যখন তখন উপবাস করা মায়ের অভ্যাস আছে। সুতরাং নিজে খাওয়া দাওয়া সেরে মাকে মিডল বার্থে উঠিয়ে দিয়ে সে শুয়ে পড়লো এবং শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়ল।
কামরায় সবাই তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । ভদ্রমহিলা ঘাড় তুলে ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে এবার তাঁর ব্যাগ থেকে চুপিসারে পান্তা ভাতের ডিব্বা টা বের করে তাতে ছাতু, সর্ষের তেল, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মেখে তারপর কাঁচা পেঁয়াজে কষে একটা কামড় দিয়ে একগাল ভাত মুখে পুরে মনের সুখে চিবোতে লাগলেন। হঠাৎ গাড়ির ঝাঁকুনিতে ভিজেভাতের জল চলকে গেল।
অল্প আলোয় সাহেব বই পড়ছিল খুব মন দিয়ে, হঠাৎ ঠোঁটে কিছু পড়তে স্বভাব বশতঃ জীভ দিয়ে চেটে নিল।একী !এজে নোনতা জল। ধড়মড়িয়ে উঠে সাহেব দেখে অবাক। বয়স্কা মহিলা একটা পাত্রে কিছু খাচ্ছেন। পাত্রের জল চলকে গিয়ে তার মুখে পড়েছে। যাক্ তবে সে যা ভেবেছিল তা না হওয়ায় আশ্বস্ত হয়ে ভালো করে দেখে বুঝলো মহিলা খুব ভয় পেয়ে গেছেন। খাওয়ার সময় তার জন্য যদি ভদ্রমহিলা ভীত হয়ে থাকেন তাহলে তা ঘোরতর অন্যায়। খুব সুন্দর করে হেসে সে হাত জোড় করল।
মহিলা ভাবলো এতো উল্টো হলো। তিরস্কারের পরিবর্তে মাফ চাইছে কেন।সে ভেবে না পেয়ে এক থাবা ভাত বাটি থেকে তুলে দেখাল অর্থাৎ ভাত খাচ্ছে। এতে সাহেবর ঔৎসুক্য বেড়ে গেল।ভাবল তাকে খেতে বলছে। এতো ভারি মজার। চেনা নেই, তাতে সে একজন বিদেশী, এখানে সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। এই ভদ্রমহিলাকে এমনিতেই একটু অদ্ভুত লাগছে। এত রাতে চুপিচুপি খেতে বসেছে।কিন্তু এই ভাবে যখন তাকে খাবার অফার করছে প্রত্যাক্ষান করা খুব অভদ্রচিত হবে। সুতরাং সে একহাত বাড়িয়ে দিল। মহিলা তো খুব খুশি। সাহেব তার কাছে ভাত চাইছে। কিন্তু হাতে দিলে পান্তা ভাতের জল তো আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে গলে পড়বে। সে নিজে হাঁ করে সাহেব কে হাঁ করতে ইঙ্গিত করল। এবার সাহেব ঠিক বুঝতে পারল। সেও হাঁ করে এগিয়ে এলো আর অমনি টপাক করে একথাবা ছাতু, নুন, তেল,কাঁচা লঙ্কা মাখা পান্তা ভাত সাহেবের মুখে পড়ল।
ঠিক সেই মুহূর্তে যে ছবিটি কামরার অভ্যন্তরে তৈরি হলো কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার কারণে সকলের অদেখা রয়ে গেল এবং যা পরেও প্রকাশিতব্য না হওয়া স্বাভাবিক তা হলো, অবাক বিস্ময়ে এক বাঙালি গ্রাম্য অল্প বয়সে বিধবা মহিলা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে দেখছে এক ইংরাজ যুবক কেমন করে চোখ বুজে পান্তা ভাতের স্বাদ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে আর মাঝে মাঝে ফিসফিস করে বলছে, horrible, horrible . তারপর উঃ আঃ করে আবার হাঁ মুখ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পুত্র বাৎসল্যে সেই মা শেষে এক হাতে মাথাটি ধরে অন্য হাতে দলা পাকানো ভাত তার মুখের কাছে ধরে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠেলে মুখের ভিতর পুরে দিচ্ছে। হয়তো মনে মনে এই সময়ে তাঁর হারিয়ে যাওয়া কোনো ছেলে ভুলানো রূপকথার গল্প কিম্বা ঘুম পাড়ানি গান মনে পড়ছে। মনে পড়ছে সেই ছবি যখন ঘনিষ্ঠ হয়ে দুরন্ত ছেলেকে জাপটে ধরে মুখে ভাত গুঁজে তাকে না খাওয়ালে তাঁর প্রান জুড়াত না। সেই ছেলেটা আজ তার এক হাত দুরত্বে ঘুমোচ্ছে, অথচ …চোখের জল আর আটকাতে পারলেন না, দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
— Mother, you are my mother, my heavenly mother. Your drops of tears melting from the core of your heart are flows of affection and love. You are an eternal mother who can’t be bounded merely by her son and daughter only. Come on mother and be the mother of thousands of slum dwellers.
সকাল বেলায় মুম্বাইয়ের ভিক্টোরিয়া টার্মিনালে ট্রেন ঢুকছে।
— অমু, ও অমু ওঠ।
তড়বড়িয়ে উঠে পড়ে অমু। সামনের দৃশ্য দেখে আর একবার চোখ কচলে নেয়।দেখে সেই সাহেব একহাতে তার মাকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরে আর অন্য হাতে তার মায়ের ট্রলিটি। সাহেবের পিঠে একটা ব্যাগ। হঠাৎ সাহেব দুই হাত জড়ো করে নমস্কার করে — Hello, Good morning.
অমুর মা তাকে থামিয়ে বলে– অমু, এই সাহেব একজন নাম করা ক্রিকেটার ছিলেন। এনার এক বস্তিবাসী কল্যাণ সমিতি আছে মুম্বাই এ। তোরা তো সব বড়ো হয়ে গেছিস, তোর বাবা ও সব ছেড়ে চলে গেছে। আমাকে আর আটকে রাখিস না। জীবনে শেষের কটা দিন এখানে খুব ভালো থাকব জানিস। তোরাও খুব ভালো থাকবি, আমি বলছি তোরাও খুব ভালো থাকবি।
ট্রেন থেমেছে দেশি বিদেশি বেশ কিছু হোমরা চোমরা ব্যক্তি জানলায় হাত বাড়িয়ে উইশ করছে –Hi Devid! Hi Devid!
ওরা ডেভিড কে রিসিভ করতে এসেছে।
— মা, তুমি চলে যাচ্ছো? আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছ!

মা শান্ত ভাবে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।
— অমু, আমাদের শাস্ত্রে কি আছে জানিস? শেষ জীবনে সংসার ত্যাগ করে তীর্থে বেরিয়ে পড়ার নির্দেশ আছে। এখন তুই বল, হাজার হাজার ছেলে মেয়ের মা হবো আমি।এমন মহাতীর্থের হাতছানি আমি কি ফেরাতে পারি?
ঘটনার দ্রুততায় বিমুঢ় হয়ে যায় অমু। ধীরে ধীরে কামরার দরজা ধরে দাড়াঁয়, দেখে ডেভিড ও তার লোকজন একান্ত আপনজনের মতো আগলে নিয়ে যাচ্ছে ওদের মাকে। ক্রমশঃ জনসমুদ্রে মিশে গেল মা, তার জন্মদাত্রী মা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *