আত্মজা ———– ধারাবাহিক উপন্যাস অধ্যায় -১৩ সুদেষ্ণা সিনহা

আত্মজা
———–
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় -১৩
সুদেষ্ণা সিনহা

ত্রিমোহিনী হাইস্কুলের প্রার্থনা সভা হয় স্কুলের মাঠে,ঠিক সাড়ে দশটায়। মাঠে ছেলে আর মেয়েদের শ্রেণীভিত্তিক আলাদা আলাদা লাইন। ক্লাস এইট অবধি মেয়েদের স্কার্ট-ব্লাউজ ।ক্লাস নাইনে উঠলে ছাত্রীদের লাল পেড়ে সাদা শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ পড়তে হয়। দুই বিনুনির নীচে লাল ফিতের ফুল। ক্লাস এইট অবধি ছেলেদের ইউনিফর্ম  সাদা হাফ প্যান্ট আর সাদা জামা।ক্লাস নাইন থেকে ছেলেদের ফুল প্যান্ট আর সাদা জামা।
প্রার্থনা সভায় জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হচ্ছে। বুকের কাছে হাত জোড় করে সুর মিলিয়ে সবাই গাইছে –জনগনমন অধিনায়ক জয় হে ……।বারান্দায় সব শিক্ষক-শিক্ষিকা দাঁড়িয়ে আছেন।
কাল থেকে মীনার মনে মনে চরম ঝড় চলছে।অলোকস্যার কেন তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন?সে অঙ্কগুলো সব ঠিক করেছে বলে? না অন্য কিছু? কাল সারারাত সে ভেবেছে। মাকেও কোন কথা বলতে পারেনি।বড্ড ভয় করছিল তার ।মা যদি বাবাকে সব কথা বলে দেয়।বাবা ভীষন রাগী।যদি বাবা স্যারকে অপমান করেন ! স্যার তাদের বাড়িতে থাকেন।
তাকে ডেকে স্যার যদি বলেন,তোকে কি করেছি আমি?কি করেছি বল তোর বাবার সামনে ! বল!
কই মা ,বাবা বা অন্য কেউ আদর করলে তার এমন মনে হয় না তো!
গত বছর পিথুমাসির বিয়ের পর ওর শ্বশুরকে প্রণাম করতে বলেছিল মা।
পিথুমাসির শ্বশুর বেশ লম্বা।পা ছুঁতে মীনা নীচু হতেই উঁনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন মীনাকে।বেশ কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে মীনার পিঠ চাপড়াতে থাকেন উঁনি।মীনার মুখ ওঁনার বুকে আবদ্ধ। স্বচ্ছন্দে শ্বাস নিতে পারছিল না মীনা।গরম নিঃশ্বাস যদি ওঁনার বুকে ফস্ করে ছাড়া হয়,ওঁনার কেমন লাগবে যে! ওঁনার আলিঙ্গন থেকে ছাড়া পেয়ে তবে  মুক্তি।কিন্তু ওঁনাকে খুব ভাল লেগে যায় মীনার একবারও মনে হয়নি উঁনি খুব খারাপভাবে জড়িয়ে ধরছেন বা পিঠ চাপড়াচ্ছেন।
এই স্কুলে এবছরই ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছে মীনা।এর আগে সে পলাশীপাড়ায় মামারবাড়িতে থাকত। সেই স্কুলে ক্লাস এইট অবধি ছিল। অনুপমাদি তাদের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। খুব ভালবাসতেন তাকে।অনুপমাদি স্কুলের হোস্টেলে থাকতেন।খুব সুন্দর আবৃত্তি করতেন।একবার মামাবাড়ির পাড়ার বিবেকানন্দ ক্লাবে রবীন্দ্র জয়ন্তীতে ‘লুকোচুরি’ কবিতায় নাম দিয়েছিল মীনা।
অনুপমাদি বলেছিলেন,সন্ধ্যেবেলায় হোস্টেলে আসিস।দেখিয়ে দেব কিভাবে বলতে হয়।
সেবার ‘লুকোচুরি’ কবিতা আবৃত্তি করে ফার্স্ট হয়েছিল মীনা।স্টাফরুমে সবার সামনে মীনাকে জড়িয়ে ধরেন অনুপমাদি, বাহ্,তুই পেরেছিস।আমার খুব আনন্দ হচ্ছে রে।
কই সেবার তো মীনার খারাপ লাগেনি!

প্রথম ক্লাসটা বাংলার। ‘দুষ্মন্তের পতিগৃহে শকুন্তলা’ — নির্বাচিত গল্পাংশ। এই ক্লাসটা মানবস্যারের।
স্যার ব্যাখ্যা করছিলেন ,মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে দুষ্মন্ত আর শকুন্তলা একে অপরকে ভালবেসে অতি গোপনে গান্ধর্ব মতে বিয়ে সারলেন। কণ্ব খবর পেলেন শকুন্তলা সন্তানসম্ভবা এবং ভরতরাজ দুষ্মন্ত শকুন্তলার গর্ভস্থ সন্তানের পিতা।তিনি তোড়জোড় করে শকুন্তলাকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে চায়লেন….

মানবস্যার খুব ভালো পড়ান।অন্যদিন খুব আগ্রহ নিয়ে শোনে মীনা।আজ সে ক্লাসে কিছুতেই মন দিতে পারছে না। কাল রাত থেকে সেই একই চিন্তা তার মাথা কুঁড়ে খাচ্ছে।
টিফিনের সময় সোনালীর সাথে মীনার দেখা হল। এই স্কুলে এসে সোনালীর সাথে তার বেশ ভাব হয়েছে।সোনালী বোতলে জল ভরছিল। মীনা কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় আনমনে বসেছিল।
সোনালী পেছন থেকে মীনার চোখ চেপে ধরল।
—– কে ?কে রে? ছাড়্ ছাড়্।
মুখ টিপে হাসে সোনালী।সাড়া দেয় না।
—–সোনু?সোনুই ….বুঝতে পেরে গেছি।এই তো তোর হাতের রূপোর বালাটা।
সোনালী চোখ ছেড়ে দেয়।
—-বল কি ব্যাপার!আজ চুপচাপ কেন?
—–ভাল লাগছে না একদম।
—–শরীর খারাপ? তবে এলি কেন আজ?
—-না রে শরীর ঠিক আছে ।
—-তবে?
—–মনটা ভালো নেই।
—-কেন ?কি হল?

মীনা কাল রাতের সব কথা সোনালীকে বলে। সোনালী কিছুমাত্র আশ্চর্য হয় না।
বলে,তুই অলোকস্যারের কোন কথা জানিস না?
—– কি কথা?
চারিদিকে চেয়ে সোনালী বলে,অলোকস্যার ওইরকমই। সবাই জানে,তুই জানিস না? তারপর ভেবেচিন্তে বলে,তুই জানবিই বা কি করে তুই তো এবারই আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিস। সেবারে একটা ইলেভেন ক্লাসের দিদিকে এমন করে জাপটে ধরেছিল স্যার, সে কথা চারিদিকে রটে যায়।মেয়েটার গার্জেন এসে হুমকি দিয়েছিল।তারপর স্যারকে নাকি হেডমাস্টারমশাইয়ের সামনে দিদিটার বাবার কাছে ক্ষমা চায়তে হয়।
——  তবে কি হবে রে সোনু?স্যার যে আমাদের বাড়িতেই থাকে এখন। এসব কথা মাকে বললেই,মা বাবার কানে তুলবে….আর বুঝতেই পারছিস,বাবা জানতে পারলে,যদি সরাসরি স্যারকে উঠিয়ে দেয় আমাদের বাড়ি থেকে?  কি হবে রে!
মীনা শিউরে ওঠে।
সোনালী ওর হাতটা চেপে ধরে ।
বলে,ভয় পাস না একদম। তুই বরং কিছুদিন স্যারের ঘরে যাস না।
—-মা যদি কিছু জিঞ্জেস করে?
—-বলবি,শরীর ভাল নেই। সোনালীর সাথে মীনা ক্লাসরুমে ফিরে যায়।

সপ্তাহ দুই ধরে মীনা পড়তে আসে না। মীনার ছোট ভাইটা আসে।মেঝেতে মাদুর পেতে বসে। ঘন্টাখানেক অঙ্ক কষে । তারপর ইংরেজী বই রিডিং পড়ে অলোকের কাছে অর্থ বুঝিয়ে নেয় । অলোকের একটুও ভালো লাগে না। পড়ানোতে একটুও মন থাকে না এখন।বসে বসে সে খবরের কাগজটা দেখে।আসলে খবরের কাগজের আড়ালে অনেক কিছু ভাবে।  মীনার জন্য মনটা খুব খারাপ লাগে। নিজের উপর বেজায় রাগ হয়। কি যে তার হয় ডাগর মেয়ে দেখলে নিজেকে কিছুতেই সংযত রাখতে পারে না ।

ছোটবেলায় ছোটমাসিরা খুব আসত তাদের কৃষ্ণনগরের বাড়িতে।ছোটমাসির একটাই মেয়ে লিপি,টিঙ্কুর সমবয়সী। লিপি সবসময় টিঙ্কুদের সঙ্গে থাকত।একরাতে তারা দেখবার নাম করে অলোক লিপিকে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে গিয়েছিল।তারপর সুযোগ বুঝে লিপির অধরে ঘনিষ্ঠ চুম্বন দিয়েছিল ।লিপি অলোকের ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গন থেকে প্রাণপন নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করছিল।
হঠাৎ দরজায় করাঘাত ।
অলোক লিপির মুখ চেপে ধরেছিল।
কড়া নাড়তে নাড়তে টিঙ্কু বলেছিল,দাদা দরজা খোল।আমার দরকার আছে।
দরজা খুলে দিয়েছিল অলোক।তারপর টিঙ্কুর মুখের দিকে চেয়েছিল।
আট বছরের ছোট বোনের চোখের ঘৃণায় অলোক লজ্জিত ,সঙ্কুচিত। টিঙ্কু কি বুঝেছিল কিছু! তবে লিপিকে নিয়ে দুদ্দাড় নিচে নেমে গিয়েছিল সে । তারপর আর ছোটমাসিরা তাদের বাড়ি আসেনি কোনদিন ।তার বাবার কাজে মেসোমশাই একাই এসেছিলেন।
মা জিঞ্জেস করেছিলেন,অমর সাধনা আর লিপি এল না?
অমর মেসোমশাই একবার অলোকের মুখে, আর  একবার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন,বাড়িতে থাকবার লোক জোগাড় করতে পারলাম না বড়দি। আসতে পারল না বলে  ওরাও বার বার দুঃখ করছিল। কিন্তু কোন উপায় নেই।

অলোক ঠিক করে রেবতীবাবুদের বাসাটা তাকে ছাড়তেই হবে।স্বাধীনতার বাচ্চা হওয়ার পর স্বাধীনতার সঙ্গেই তাকে ওর স্কুলের কাছাকাছি থাকতে হবে।

রেবতীবাবুকে সেকথা জানাতেই তিনি বলেছিলেন,ঠিক আছে। আপনার যা ভাল মনে হয় তাই করবেন ।আমাদের কোন আপত্তি নেই।
অলোকের মনে হয়েছিল ভদ্রতা করেই রেবতীবাবু তাকে কিছু বললেন না।

মাঝে মাঝে অলোকের খুব অস্থির লাগে।তার জীবন কোনদিনই মসৃণভাবে চলে না। সে কেন আর পাঁচজনের মতো  হতে পারল না! নিজে নিজে অনেক ভেবেও সে ব্যাখ্যা করতে পারে না তার জীবনকে। সে দেখতে সুন্দর বলেই মেয়েরা তার ফাঁদে পড়ে।দেখতে সুন্দর হওয়াটা কি তার জন্মগত ত্রুটি!
কয়েকটা ঘটনা এখনও তাকে তাড়া করে। সেই অনেক দিন আগে সরস্বতী পুজোর দিন  কি  হয়েছিল তার! মাঝ রাস্তায় ফট্ করে তপুর ছোট বোন ঋতুর হাতটা ধরতে ইচ্ছে হয়েছিল কেন তার! লোকজন,সমাজ,বিধি-নিষেধ—কিছুই মাথাতে আসেনি সেদিন।বাবার কাছে মার খেয়ে যেন সম্বিৎ ফিরে এসেছিল একসময় — কাজটা মোটেও ঠিক করেনি সে। তারপর অনেক ভেবেছে।বড্ড ছেলেমানুষি হয়ে গেছে।
জয়িতা যে সময় এসেছিল তার জীবনে,সেই সময় তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত।ইউনিভার্সিটির একজন সুপরিচিত মুখ সে। সে মেধাবী ছাত্র,ভাল বাগ্মী,নাটক ভাল করে,গান গায়,কবিতাও লিখতে পারে।তার গুণে নারীরা পাগল,তার রূপে নারীরা পাগল।  নারীদের সাথে ভালবাসা ভালবাসা খেলার নেশাটা আবার এসে ভর করেছিল তার মধ্যে।  এক সময় বুঝতে পেরে একজন একজন করে সব নারীই সরে দাঁড়িয়েছিল।একমাত্র জয়িতা সরে নি। সে তার শরীর আর মন ,দুটোই সমর্পণ করেছিল প্রেমিক ঠাকুরের পায়ে।জোর করে তাকে সরিয়ে দিয়েছে অলোক।সে সময় কয়েক রাত ঘুমোতে পারেনি অলোক। অলোকের কাছ থেকে প্রত্যাখান জয়িতা  সামলাতে পারবে তো!মনে মনে যদি সে এত বড় আঘাত সহ্য করতে না পারে!যদি সে সুইসাইড করে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *