৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ ~ শান্তনু ঘোষ

৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ
~ শান্তনু ঘোষ
পর্ব-১৬

আগে যা ঘটেছে:
পাবনায় থেকে নাটোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, ঘুরে নিয়েছি। হাতে সময় বেশী ছিল না। সাকুল্যে দুই দিন। কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি দেখে এসেছি। দেখেছি লালন ফকিরের মাজার। রাশিয়ার সহায়তায় নির্মীয়মান পারমাণবিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ চলছে রূপপুরে। সেখানকার রাশিয়ান কলোনি গ্রীন সিটিতে খানিক্ষণ আড্ডা মেরে রাতে কৌস্তভদের গেস্টহাউসে ফিরে জানতে পারলাম আগামীকাল সকালে একটি গাড়ি ঢাকায় যাবে। আমারও আগামীকাল ঢাকায় যাবার কথা। কৌস্তভ ওই গাড়িতে আমার জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কাল ভোরে উঠে রওনা দেব। আমার পাবনা ঘোরা এবারের মত শেষ।

তারপর…
বেশ সকালেই উঠে পড়েছি। আজ সকাল সকাল ঢাকায় রওনা হতে হবে। গাড়ি চলে আসবে একটু পরেই।

সকালে ওঠা আমার অভ্যাস। আর পাহাড়ে ট্রেক করতে গেলে সকালে উঠতেই হয়। শুনেছি যারা এভারেস্ট সামিট করে তারা তো মাঝরাতে উঠে হাঁটা লাগায়। পাহাড়ে বেলা বাড়ার সাথে সাথে আবহাওয়া খারাপ হবার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। আমি অবশ্য অত বড় মাপের কেউ নই। তবে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি চড়া রোদে হাঁটার থেকে সকালের মিষ্টি আলোয় পাহাড়ে হাঁটা অনেক বেশী আনন্দদায়ক।

আজ তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে বলে জিনিসপত্র বেশীরভাগই কাল রাতে গুছিয়ে রেখেছি। সামান্য কিছু বাকি আছে। ব্রেকফাস্ট করে সেগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নেব।

ঢাকায় কি করব, কি দেখব, কোথায় থাকব, কেমন জায়গা, এসব নিয়ে গতকাল রাতে কৌস্তভের সাথে আলোচনা করছিলাম। ও মাঝে মাঝে অফিসের কাজে ঢাকা যায়। ও বলেছিল, গুলশান এলাকায় ভালো হোটেল আছে ওখানেই থাকতে। দামী হোটেল। খরচ একটু বেশী হবে, তবে ভয়টা কম। অন্য কোন সস্তার জায়গায় না যেতে।

আমি জিজ্ঞেস করি, ভয়টা কিসের?

ও বিশদ কিছু বলল না। শুধু বলল, ঢাকায় অনেক রকম ভুলভাল ব্যাপার আছে, তুই নতুন লোক, কিছু জানিস না, চিনিস না, বিপদে পড়ে যাবি। অচেনা লোকের কাছে ঢাকা খুব একটা নিরাপদ জায়গা নয়। চুরি ছিনতাই হবার খুব ঝুঁকি আছে।

আমাদের টুকাইদাও একই রকম কথা বলেছিল। বাংলাদেশে টুকাইদার ব্যবসা আছে। সেই কাজে ঘন ঘন কোলকাতা থেকে ঢাকায় আসে। বাংলাদেশ আসার আগে টুকাইদার কাছে একটু জ্ঞান নিতে ফোন করেছিলাম। শুনেই প্রথমে বলেছিল, পৃথিবীর এত জায়গা থাকতে হঠাৎ বাংলাদেশ কেন ?

আমি বলি, নিছক ঘুরতে।
টুকাইদা সোজা কথার মানুষ। মুখের উপর বলে দিল, বাংলাদেশ কোন অ্যাডভেঞ্চার করার জায়গা নয়। বিশেষত ঢাকা তো খুব ভয়ের জায়গা। খুব সাবধানে চলতে হয়। আমি দিনের বেলায় ছিনতাই হতে দেখেছি।

এখন কৌস্তভের মুখেও সেই এক কথা! আমি বেশ অবাক হচ্ছি। ঢাকা কেন, এখন মনে হচ্ছে পুরো বাংলাদেশ আমাদের জন্য খুব একটা নিরাপদ নয়। কি অদ্ভূত পরস্থিতি। একদিন এইটা তো আমারই দেশ ছিল। আজ আমি এই দেশে বিদেশী ও নিরাপদ নই। অথচ এদেশের লোকও বাঙ্গালী, আমরাও বাঙ্গালী। ভাবনা, চিন্তা ও শিক্ষায় নিশ্চয় বিস্তর ব্যবধান আছে।

আমি বলি, এমন হলে ঘুরব কি করে? ছবি তুলব কি করে! আমি তো ভেবেছি পায়ে হেঁটে বা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে ঢাকা শহর দেখব। যা আমি সব সময় করে থাকি। কি হবে এখন ?

ও বলল, ওসব করতে যাস না। আমিও ঢাকায় নেই, কোন ঝামেলা হলে হেল্প করতে পারব না। তার থেকে ভালো হবে, আমি একটা গাড়ি ঠিক করে দিচ্ছি। ড্রাইভার আমাদের চেনা । যে কদিন থাকবি, ওই গাড়িতেই ঘুরিস। আমি বলে দিলে টাকা একটু কম নেবে।

আমি বললাম, বেশ, তাই হোক। দুদিনের জন্য যাচ্ছি, আর ঝামেলা বাড়িয়ে কাজ নেই।

ও তখনই ঢাকার ড্রাইভারকে ফোন করে সব ব্যবস্থা করে দিল। ওকেই বলে দিল, আমাকে একটা ভালো হোটেলে নিয়ে যেতে । ড্রাইভারের নাম বলে দিল, মাতব্বর। বুঝলাম সে বেশ মাতব্বর গোছের লোক হবে।

ব্রেকফাস্ট করে কৌস্তভের কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি। বাবু তখনও ঘুম ঘুম চোখে। আমার মত পাগল নয় বলে বেশী সকালে ওঠে না। বিদায় বেলায় বলে দিল, কোন রকম সমস্যা হলে যাতে ওকে ফোন করি।

গাড়িতে উঠে বসেছি। উঠে দেখি আগে থেকেই আরো দুজন যুবক গাড়ীতে বসে আছেন। আলাপ করলাম। ওনারা অডিটর। ঢাকা থেকে রূপপুরে এসেছিলেন অডিট করতে। কাজ শেষ করে ঢাকায় ফিরে যাচ্ছেন।

ঈশ্বরদী ছেড়ে গাড়ি চলছে, একটু পরেই রাজশাহী – ঢাকা মহাসড়ক ধরল। সকাল সকাল বেরিয়েছি বলেই মনে হয় রাস্তা বেশ ফাঁকা পেয়েছি। এমন থাকলে ঘন্টা পাঁচেকের মধ্যে ঢাকা পৌঁছে যাওয়া উচিৎ। তার মানে, বেলা ১ টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছে যাব আশা করি।

আগেই বলেছিলাম, বাংলাদেশে সব বিদেশী গাড়ি। নতুন গাড়ি আছে। তবে বেশীরভাগই বিদেশী সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি। বিশেষত, ভাড়ায় চলার জন্য কেনা সবই সেকেন্ডহ্যান্ড রিকন্ডিশনিং করা গাড়ি। এটাও সেই রকমই টয়োটা কোম্পানির একটা হাইএন্ড মডেল। এখানকার ড্রাইভাররা খুব খুশি এই সেকেন্ডহ্যান্ড রিকোন্ডিশনিং করা গাড়ি নিয়ে। খুব ভালো সার্ভিস দেয় নাকি।

জিজ্ঞেস করি, ইন্ডিয়ার গাড়ি কেন এখানে চলে না ?

সে বলে, মারুতি গাড়ি নাকি একবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লোকজন তেমন পছন্দ করেনি। এই সব জাপানী গাড়ির তুলনায় তার কোয়ালিটি খুব খারাপ, আর একেবারে পাতলা টিনের তৈরি হাল্কা গাড়ি। ওসব এখানে চলে না।

গাড়ি না থেমে অনেকটা রাস্তা চলে এসেছে। এখন এদিকটায় দেখছি রাস্তা আরও ভালো ও চওড়া হচ্ছে। দুদিকে ফেন্সিং আর সার্ভিস রোড দেখতে পাচ্ছি। অনেকটা আমাদের দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ের মত। উপরে রাস্তার প্রস্থ জুড়ে প্লেস ডিরেকশন দেওয়া বড় বোর্ড। তাতে সামনে কোন জায়গা আসছে তার নাম ও দূরত্ব লেখা আছে। বুঝতে পারছি ঢাকা আর বেশী দূরে নয়।

ঢাকা আসছে। বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছে। ঢাকার নাম তো সেই জন্ম থেকে শুনে আসছি। আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটে ছিল ঢাকায়। বিক্রমপুরে।

দেশ ভাগের পরে আমার ঠাকুর্দা পরিবার নিয়ে এপার বাংলায় চলে আসেন। তৎকালীন বাংলাদেশের অত্যাচার, ভয়াভয় পরস্থিতি আর বিভিষীকার থেকে প্রাণ বাঁচাতে। কোন রকম প্ররোচনা ছাড়াই অসহায় হিন্দুদের উপরে মুসলমানদের সেই বীভৎস ও হিংস্র আক্রমণের কথা মাঝে মাঝে শুনেছি।

একরাতের মধ্যেই বর্ডার পার হতে হয়েছিল। নইলে মুসলমানদের হাতে মৃত্যু অনিবার্য ছিল। আর তার সঙ্গে চলত হিন্দু মহিলাদের উপর ধর্ষণ ও অকথ্য যৌন অত্যাচার। এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল ওরা যে, শুধুমাত্র ধর্ষণ ও অকথ্য যৌন অত্যাচার করেই ক্ষান্ত হত না, তারপর সেই মহিলাকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দিয়ে তার যন্ত্রণা ও আর্তনাদ দেখে উল্লাস করত।

ঠাকুমা কিছুই সঙ্গে আনতে পারেননি। কোনমতে দরজায় একটা তালা লাগিয়ে এক কাপড়ে প্রাণ হাতে করে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। হয়ত মনে আশা ছিল কোনদিন পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার নিজেদের ভিটেয় ফিরবেন। কিন্তু সে ফেরা আর হয়নি কোনদিন ।

শুনেছি যে, হোগলা বনে ঘেরা একটা ডোবায় গলা অবধি জলে সারারাত লুকিয়ে ছিলেন পুরো পরিবার নিয়ে। সঙ্গে ছোট ছোট আট সন্তান। তাদের বয়স ১৩ বছর থেকে ১৩ মাসের মধ্যে। জেঠু সবার বড় ছিলেন। আর সব থেকে ছোট ১৩ মাসের সন্তানকে পরে আর বাঁচানো যায়নি। হয়ত এই দুর্বিষহ কষ্ট ঐ শিশু আর সহ্য করতে না পরে মারা গিয়েছিল।

ঠাকুমা বলতেন, ঐ রাতে হোগলা বনের ফাঁক দিয়ে দূরে দেখতে পাচ্ছিলেন হাতে মশাল নিয়ে একের পর এক বাড়িতে আগুন লাগাচ্ছে মুসলমানরা, আর ‘আল্লাহ আকবর’ বলে চিৎকার করছে। আমি এখন ভাবি, এই হত্যালীলা এরা আল্লার নাম নিয়ে করত!! কোন মানুষ এমনটা করতে পারে!!
এই ‘আল্লাহ আকবর’ শব্দটা আমার ঠাকুমাকে এতটাই আতঙ্কিত করেছিল যে, ঐ শব্দটার আতঙ্ক সারা জীবন তাঁকে তাড়া করত। ঐ শব্দটা কখনো কোথাও কানে এলেই তাঁর মুখটা কেমন যেন ভীত ও ফ্যাকাসে হয়ে উঠত। শেষ সময় পর্যন্ত দেখছি উনি ঐ শব্দটা শুনলেই ভয়ে কাঁপতে থাকতেন ।

কিছুদিন আগেও তো একটাই দেশ ছিল। একই গ্রাম, পাড়া। প্রতিবেশী ছিল সবাই। আর ব্রিটিশরা একটা দাগ কেটে দিতেই সে পরিচিত মুসলমান ভাই বদলে গেল। হয়ে গেল উন্মত্ত জল্লাদ! এই খুন-হত্যার স্পৃহা কি তাহলে এত দিন রক্তে সুপ্ত ছিল !

পরে শুনেছি আমাদের সম্পত্তি নাকি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। আবার কিছুটা অংশ আশেপাশের মুসলমান প্রতিবেশীরা দখল করে নেয়।
ভাবলে হাসি বা কান্না দুটোই আসে, যে নিজেদের দেশে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি একদিন হয়ে গেল শত্রু সম্পত্তি। হায় রে আমার দেশ, আমাকেই দেশের শত্রু আখ্যা দিয়ে ভিটে কেড়ে নিলো!! এ কোন ধর্ম, কিসের ধর্ম! বাংলাদেশ সত্যিই এক অদ্ভূত দেশ।

আমারা ছিলাম ঘোষদস্তিদার। দাদু পরে আর দস্তিদার লিখতেন না। শুধুমাত্র ঘোষ লিখতেন। সেই থেকে আমরাও তাই লিখি। কেন যে দস্তিদারের বস্তা ঘাড় থেকে নামিয়েছিলেন জানি না।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে দেখি টাঙ্গাইলের কাছে এসে গেছি। এখান থেকে ডান বাঁক নিলে টাঙ্গাইল যাওয়া যায়। বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ির নাম তো এখান থেকেই এসেছে। আমরা অবশ্য সোজা যাবো ঢাকার পথে।

ড্রাইভার হঠাৎ দেখি গাড়ি ধীর গতিতে রাস্তার ধারে একটি চায়ের দোকানের সামনে দাঁড় করালো। বুঝলাম টানা গাড়ি চালিয়ে ও একটু ক্লান্ত। আমরা সকলেই নেমে এসে এক ঝুপড়ি মত চায়ের দোকানে দাঁড়িয়েছি। ড্রাইভার চারটে চা দিতে বলল।

বুঝতে পারছি এই দোকানটা হল দোকানের মালিকের বাড়ির সামনের অংশ। হাইওয়ের পাশে বাড়ি হওয়াতে বাড়ির সামনের অংশটা দোকানে পরিবর্তন করে নিয়ে একটু ব্যবসা করার চেষ্টা হয়েছে।

হঠাৎ কানে হিন্দি সিনেমার গান ভেসে আসছে । বেশ অবাক হয়ে চায়ের দোকানর ভিতরে একটু উঁকি দিলাম। দেখি একটা প্রাচীনকালের ঢাউস-বাক্স রঙ্গিন টিভি, আর তাতে একটা টিপিকাল বলিউড মুভির গানের দৃশ্য চলছে। গানটা সেখান থেকেই আসছে।

বাংলাদেশের এই সামান্য একটা চায়ের দোকানের মানুষটি বাংলা গান না শুনে এত ভালোবেসে হিন্দি গান শুনছে দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি।
জিজ্ঞাসা করি, এখানে কি হিন্দি গান খুব জনপ্রিয়?
দোকানী মুখে কিছু বলেন না, মাথা নাড়েন।
ড্রাইভার উত্তর দেয়, বাংলাদেশে, হিন্দি মুভি, হিন্দি গান, হিন্দি সিরিয়াল খুব জনপ্রিয়। হিন্দির জন্য প্রচুর দর্শক।
আমি মনে মনে ভাবি, কলকাতার ধর্মতলা বা বড়বাজারের মত এখানেও কিছুদিন পরে দোকানে গিয়ে যদি হিন্দিতে কথা বলতে হয় তাহলে সেটা হবে খুবই দুঃখের ও কষ্টের।

এমন দিন যেন না আসে যে একদিন আধুনিক বাংলাদেশে আরবীর পরে হিন্দি জায়গা করে নিল।
বাংলাদেশ আমাদের বাঙ্গালীদের গর্ব, আমাদের বাংলা ভাষার ও সংস্কৃতির আশ্রয়স্থল, ও বেড়ে ওঠা। বাংলাদেশ আছে বলেই বিশ্বের দরবারে আজ বাংলা ভাষার মর্যাদা এত বেশী। পশ্চিমবঙ্গ তো এখন নামগোত্রহীন উত্তর ভারত । কলকাতা এখন গো-বলয়ের ভাষায় ও সংস্কৃতিতে মাতোয়ারা !

২১ শে ফেব্রুয়ারির বলিদান যেন ব্যর্থ না হয়।

ক্রমশঃ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *